জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বাম রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে অনেকটা স্থবিরতা। একসময় বিভিন্ন জনইস্যু নিয়ে রাজধানীর রাজপথ থেকে মাঠপর্যায়েও সরগরম থাকত দলগুলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় থেকে সাম্প্রতিককালেও প্রায় সব আন্দোলন-সংগ্রামে ছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
মানুষের আস্থার শেষ ঠিকানাও ছিল বাম দলগুলো। কিন্তু সময়ের পরিবর্তে সেই আস্থা ধরে রাখতে পারেনি দলগুলো। রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব, সুস্পষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য না থাকা, সিদ্ধান্তে অটল না থাকা এবং ক্ষমতা বিমুখতাসহ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খণ্ডবিখণ্ড হওয়ায় বামদলগুলো দিন দিন সাইড লাইনে চলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, বামদের অভ্যন্তরীণ ও আদর্শগত বিরোধ কাটিয়ে উঠে সংঘবদ্ধ সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন না করলে কখনো জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যাবে না।
এদিকে বিগত সময়ে সিপিবি-বাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারের সমালোচনায় সক্রিয় ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশ ও আওয়ামী লীগসহ তার সহযোগী সংগঠনদের হামলা-মামলার শিকারও হয়েছিলেন।
তবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও আওয়ামী লীগের বিরোধী শিবিরে থাকা কিছু বামদলের নেতারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মাঠে সক্রিয় ছিলেন। বামপন্থি শিক্ষাবিদ আনু মুহাম্মদের নেতৃত্বে ২ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘ছাত্র-জনতার দ্রোহযাত্রা’ আন্দোলনের নতুন মোড় তৈরি করেছিল।
তবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এসে দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী শিবিরে থাকা জাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দলের মতো ধরাশায়ী হয়েছেন সিপিবি-বাসদসহ বিরোধী শিবিরে থাকা বাম দলগুলোও। তাদের নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিভিন্ন স্থানে এসব দলের কর্মসূচি পণ্ড হয়েছে গণরোষের মুখে।
সর্বশেষ গত বুধবার শাহবাগে ধর্ষণবিরোধী একটি মানববন্ধনে গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক, সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি লাকী আক্তারের অংশগ্রহণ করার পর এই বিতর্ক আরও উষ্কে ওঠে। লাকী গ্রেপ্তারের দাবিতে শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়।
অনেকেই বলছেন, বামপন্থিদের নেতৃত্বে ২০১১ সালে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ আওয়ামী লীগকে স্বৈরাচার হতে সহযোগিতা করেছিল। এই গণজাগরণ মঞ্চ বিচারহীন সংস্কৃতি তৈরি করছিল। আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী বানাতে সিপিবি-বাসদসহ অন্য বামদলগুলো কাজ করেছে। তবে তা অস্বীকার করছেন বাম নোতারা।
সূত্রমতে, বর্তমানে দেশে অন্তত ২৩টি বাম রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে কোনো দল ভেঙে দুই-তিন ভাগ হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপর্যয়ের পর দেশের কমিউনিস্ট রাজনীতিতেও বড় ধরনের ভাঙা-গড়া শুরু হয়েছিল। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলটির বিরোধী শিবিরে থাকা সিপিবি, বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), হাতেগোনা কয়েকটি এখন দল নামমাত্র কিছু কর্মসূচি নিয়ে সক্রিয় থাকে।
তবে জাসদ (ইনু), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মেনন), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), সাম্যবাদী দল (এমএল), গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-রেজাউর), কমিউনিস্ট কেন্দ্রসহ কয়েকটি বামপন্থিদল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকায় আওয়ামী লীগের পতনের পর ধরাশায়ী অবস্থার মধ্যে পড়েছেন।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তাদের নেই কোনো কর্মসূচি। গ্রেপ্তার হয়েছেন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। বাকি শীর্ষ নেতারাও দিয়েছে গাঢাকা। এর বাইরের বাকি দলগুলোও নামসর্বস্ব। মাঝেমধ্যে প্রেস রিলিজ আর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে হাতেগোনা কয়েকজন লোক নিয়ে মানববন্ধন কিংবা সমাবেশ করেন তারা।
বামদের গ্রহণযোগ্যতা হারানোর কারণ: সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে বামপন্থিদের মধ্যে নেই কোনো আগ্রহ। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও কোনো প্রার্থীরই জামানত টিকে না। যদিও বামপন্থিরা বলেন, আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।
ক্ষমতায় যাওয়া তাদের আপাতত লক্ষ্য নয়। তবে ২০২৫ এসেও তারা বলতে পারবেন না ২১২৫ সালেও তারা ক্ষমতায় যেতে পারবেন কি না। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না আসতে পেরে ধীরে ধীরে কোনঠাসা হয়ে পড়ছে বামদলগুলো।
কর্মীরাও যোগ দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলে। জনসমর্থনও দিন দিন কমে যাচ্ছে। ছাত্ররাও এখন আর আগের মতো বামদলগুলোতে ভিড়তে চান না। বামদলগুলোর নিজস্ব যে আদর্শ বা লক্ষ্য, তা পূরণেও রয়েছে সীমাহীন ব্যর্থতা।
এ ছাড়াও অন্তর্কোন্দল আর একে-অন্যের প্রতি অবিশ্বাসেও পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো। গণবিপ্লবের জন্য রাজনৈতিক কর্মপন্থা কী হবে- তার তাত্ত্বিক নির্মাণে মতদ্বৈধতা থেকে শুরু করে একেবারে ‘খোঁড়া’ অজুহাতে দ্বিধাবিভক্ত হতে হতে ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় পৌঁছেছে একেকটি বামদল।
ইস্যুভিত্তিক কয়েকটি ছাড়া গণমানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার মতো বৃহত্তর কোনো কর্মসূচি নেই তাদের। কোনো কোনো দল দায়সারাভাবে কিছু কর্মসূচির মাধ্যমে তৎপর থাকার চেষ্টা করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বামদের দিন দিন পিছিয়ে পড়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণের কথা বলছেন। তার মধ্যে অন্যতম কয়েকটি কারণ হলো-বামদলগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্র্যান্ডিংয়ের সমস্যা, তাদের চিহ্নিত করার মতো নেই কোনো নেতা। হরেক রকম ইস্যু নিয়ে আন্দোলন আর ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নের অভাব।
তারা বলছেন, বামরা বছর ভর বিভিন্ন ব্র্যান্ডে কাজ করেন। যেমন- বড় বামদলগুলো কখনো ‘সিপিবি-বাসদ’, কখনো বাম ঐক্যজোট, কখনো বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, কখনো শুধুই সিপিবি বা বাসদ বা নিজ নিজ পার্টির নাম, কখনো তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষার নাম, এভাবে বিভিন্ন নামে এসে হাজির হন।
এদের ছাত্র সংগঠনগুলোও কখনো নিজ নামে, কখনো জোটের নামে আবার কখনো ‘সাধারণ ছাত্র’ ব্যানারে কাজ করে থাকেন। আলাদা আলাদা ব্র্যান্ডিংয়ে কাজ করার কারণে মানুষ সব মনে রাখতে পারে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুনিয়ার সবখানে রাজনীতির বড় চিহ্ন হচ্ছে নেতা। নেতা চিহ্নিত থাকলে মানুষের পক্ষে বুঝতে সুবিধা হয়। বামদের চিহ্নিত কোনো নেতা না থাকার কারণে মানুষের মাঝে সাড়া ফেলতে পারেন না। সুন্দরবন থেকে সমুদ্রতল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কাজ করার, ফলে মানুষ পরিষ্কার হতে পারেন না বামদের মূল লক্ষ্য কি?
বাম রাজনীতির স্থবিতার পেছনের কারণ হিসেবে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের বাম আন্দোলন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে একাধিক কারণে।
এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো- একসময় যারা বাম আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন, পরবর্তীতে তাদের অনেকেই নিজেদের সুবিধার জন্য শাসক দলে গেছেন, ক্ষমতাসীন জোটে চলে গেছেন আর অনেক আবার বিএনপিতেও যোগ দিয়েছেন। দ্বিতীয় কারণ হলো- বাম আন্দোলনের পক্ষে কেউ নেই। রাষ্ট্রও নেই, মিডিয়াও নেই। মিডিয়া কোনো ভাবেই বাম আন্দোলনকে প্রশ্রয় দেয় না। কারণ মিডিয়ার মালিকরা পুঁজিবাদি।
তিনি বলেন, বাম আন্দোলন দুর্বল হলে খুশি হওয়ার কিছু নেই। বাম আন্দোলন দুর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে দেশে চরম দক্ষিণ পন্থিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তারা শক্তিশালী হচ্ছে। ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করছে। সহিংসতা বাড়ছে। কিন্তু এ সমাজ এভাবে চলবে না। এখন বামপন্থিরা যদি মানুষের গণতান্ত্রিক, সামাজিক মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে পারে তাহলে সবার জন্য মঙ্গল হবে।
যা বলছেন বাম নেতারা: সিপিবি কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে বাম-ডান থেকে শুরু করে সব মুক্তিকামী গণমানুষের অংশগ্রহণ ছিল।
আমরা সব সময় মেহনতী-শোষিত মানুষের কথা বলি, অভ্যুত্থানের আগেও বলেছি, এখনো বলছি। হয়তো সেগুলো তেমন মিডিয়া কাভার পাচ্ছে না। আমরা অভ্যুত্থান পরবর্তী বাম রাজনৈতিক ধারাগুলো জোটবদ্ধ হয়ে শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে আমাদের কাজ করে যাচ্ছি।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, বামরা সবসময় নিজেদের অবস্থান থেকে রাজনীতি করে, তাদের রাজনীতির সঙ্গে ডান ধাঁচের রাজনীতি মিলবে না।
বিগত যে সরকার ছিল এবং বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছেন সবাই ডান ধাঁচের। বাম রাজনীতি মেহনতি, শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারের কথা বলে যা ধনিক শ্রেণির বুর্জুয়া রাজনীতির জন্য বাধা এ কারণে তারা আমাদের বিষয়ে বিরাগভাজন।
তিনি আরও বলেন, সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য আমরা জনগণের কাছে পুরোপুরিভাবে পৌঁছতে পারি না সত্য। তবে আমরা যখন তাদের কাছে পৌঁছে তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলি তারা আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্তা প্রকাশ করেন।