বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে একটি মিথ প্রচলিত রয়েছে, ‘সিলেট-১ আসন যার, সরকার তার’। অর্থাৎ সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে যে দল বিজয়ী হবে, সে দলই সরকার গঠন করবে। স্বাধীনতার পর থেকে কোনো নির্বাচনে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ফলে রীতিমতো মিথটি এখন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে।
২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে এই আসনে বিএনপির প্রার্থী হয়েছিলেন দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির। ফলে এবারও বিএনপির আলোচনার টেবিলে রয়েছেন তিনি।
স্থানীয় বিএনপি তাকে প্রার্থী ধরে মাঠে কার্যক্রম চালাচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে নাম উঠে এসেছে সিলেট সিটি করপোরেশনে একাধিকবার নির্বাচিত সাবেক সফল মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর।
তিনিও দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং এ মুহূর্তে সিলেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। গত কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিলেট-১ আসনে তার প্রার্থী হওয়া নিয়ে বেশ গুঞ্জন ও আলোচনা চলছে।
দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, এবারের নির্বাচন সবদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ায় প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দলের প্রধান নীতিনির্ধারক ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অনেক সতর্ক।
সিলেট বিএনপির একটি সূত্র দলের হাইকমান্ডের বরাত দিয়ে দাবি করছে, দলটির হাই কমান্ড নানা কারণে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরীকে ভাবছে।
সূত্রের দাবি, দলের তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণ সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে সিলেট-১ এ প্রার্থী হিসেবে চাইছেন।
যদিও প্রথমে আরিফুল হক চৌধুরী নিজেই সিলেট-৪ আসনে (গোয়াইনঘাট-জৈন্তাপুর) প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এ জন্য সেখানে অসংখ্য অনুষ্ঠান করেছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতেও। কিন্তু পরবর্তীতে সেখান থেকে তিনি সরে আসেন।
আরিফুল হক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজনেরা জানান, গোয়াইনঘাট-জৈন্তাপুর নিয়ে গঠিত সিলেট-৪ আসন সম্প্রতি বৃহত্তর সিলেটে চোরাচালানের সবচেয়ে ক্রাইম জোন হিসেবে চিহ্নিত।
বেশিসংখ্যক নেতাকর্মীই চোরাচালানের অবৈধ তদ্বির ও সুবিধা নিতে তার কাছে ভিড় করেন। যা তিনি পছন্দ করছেন না। এটি তাকে সেই আসনে প্রার্থী হতে নিরুৎসাহিত করেছে। জেতা সহজ জেনেও তিনি সিলেট-৪ আসনে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ থেকে সরে আসেন।
আগ্রহ দেখাচ্ছেন মর্যাদাপূর্ণ সিলেট-১ আসনে প্রার্থী হওয়ার। দলের হাই কমান্ড থেকে ‘ইশারা’ও পেয়েছেন তিনি, এমনটি বলছেন তার ঘনিষ্ঠজনেরা। আলোচনার সেই টেবিলে আছে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানের নাম।
শেষ পর্যন্ত তাকেই প্রার্থী হয়ে আসতে হতে পারে। তবে দলীয় সূত্র জানায়, আপাতত মাঠের রাজনীতিতে আসছেন না তিনি। ফলে প্রার্থিতার দৌড়ে এখন দুটি নামই সামনে। আরিফুল হক চৌধুরী এবং খোন্দকার আবদুল মুক্তাদির।
ইসলামের বিশ্ববিখ্যাত মহান দরবেশ হযরত শাহজালাল (রহ.) ও হযরত শাহপরানের (রহ.) মাজার সিলেটে থাকায় সব দল সিলেট থেকে তাদের দলের নির্বাচনি প্রচার শুরু করে। এটি এখন রাজনৈতিক রেওয়াজ। এই রেওয়াজও মিথটিকে কিংবদন্তিতে পরিণতি হওয়ায় আরও রসদ জুগিয়েছে।
‘সিলেট-১ যার, সরকার তার’- এই বিষয়টিকে সমীহ করেন সবাই। প্রার্থী বাছাইয়ে তাই সিলেট-১ এর জন্য আলাদা মনোযোগ দেয় রাজনৈতিক দলগুলো। নিজেদের হেভিয়েট প্রার্থী এখানে মনোনয়ন দেওয়া হয় এবং নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে সেই প্রার্থীকেই সরকারের কেবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ পদে জায়গা দেওয়া হয়।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনগুলোতে কখনো তারও ব্যতিক্রম হয়নি। আলোচনায় আরিফুল হক চৌধুরীর নাম উঠে এলেও দীর্ঘদিন ধরে প্রধান দাবিদার হিসেবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির।
এর আগে দল তাকে পছন্দ করে ধানের শীষ তুলে দিয়েছিল তার হাতে। সেটি ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে। সে নির্বাচনে তিনি ১ লাখ ২৩ হাজার ৮৫১ ভোট পেলেও পরাজিত হন আব্দুল মোমেনের কাছে। এবার তিনিও আশাবাদী। গত প্রায় এক দশকের কাছাকাছি সময়ে সিলেট বিএনপিতে অনেকটা একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।
৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে আওয়ামী লীগ নির্বাচনি মাঠ থেকে ছিটকে পড়েছে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণের আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। এমনকি জাতীয় পার্টিও ঝুলে আছে। ফলে আলোচনায় বিএনপি, জামায়াত এবং ছাত্রদের নতুন গঠন করা দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
আলোচনার টেবিলে রয়েছে আরও একটি দলের আগমনেরও বিষয়টি। এনসিপি সিলেট-১ এ তাদের প্রার্থীর জন্য যোগ্য মানুষের সন্ধানে রয়েছে। একাধিক ছাত্রপ্রতিনিধির সঙ্গে তারা এ নিয়ে কথাও বলেছে। তবে এখনো তাদের নাম প্রকাশ্যে আলোচনায় আসেনি।
জামায়াত অবশ্য আগেভাগেই তাদের প্রার্থী নির্ধারণ করে এ আসনের জন্য নাম ঘোষণা করেছে। সে জায়গায় বিএনপি নীরব। সিলেট বিএনপির নেতৃস্থানীয় মহল জানায়, নির্বাচনের আলোচনার টেবিলে এবারও এই আসনে খন্দকার আবদুল মুক্তাদিরের নাম রয়েছে।
আছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীও। তিনি এ আসনে প্রার্থী ‘হলেও হতে পারেন’ বলে দলীয় ফোরামে আলোচনা চলছে। দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে গত সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হননি আরিফুল হক চৌধুরী।
এই ‘ত্যাগের’ জন্য সিটি নির্বাচনের পরপরই তাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদ থেকে পদোন্নতি দিয়ে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা করা হয়। এ ছাড়া নগরে তার জনপ্রিয়তাও রয়েছে।
নিজেকে নিয়ে আলোচনা ও সম্ভাব্য প্রার্থিতার ব্যাপারে আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, কে প্রার্থী হবেন কে হবেন না- এর চেয়ে আমাদের কাছে এ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশের সব দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন ঘোষণা দেওয়া। এখনো বিএনপি কোনো জায়গায় প্রার্থী ঘোষণা করেনি। যখন সময় হবে তখন ঘোষণা করবে। তখনই পরিষ্কার হয়ে যাবে কে কোথায় বিএনপির প্রার্থী।
তিনি বলেন, আমি সিলেটে সেই ছাত্রকাল থেকে রাজনীতি করে আসছি। সিলেটবাসী আমাকে ভালোবাসেন। তারা তার প্রমাণ বারবার দিয়েছেন। তারা যদি আমাকে নিয়ে প্রত্যাশা করেন তাহলে সেটি তারা করতেই পারেন। আমার রাজনীতি তো মানুষের জন্য।
সিলেটের সাবেক জননন্দিত মেয়র বলেন, সিলেট-১ আসনে দল দেখবে, কাকে মনোনয়ন দেবে, কাকে দিলে দলের লাভ হবে। কেননা সামনের নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটি মনগড়া নির্বাচনও হবে না।
মানুষ এবার ভোট দেবে। আর তা দলীয় প্রতীক ও প্রার্থী দেখে। দল এসব এবার বিবেচনা করে প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। এ অবস্থায় জনগণ যদি চায় এবং আমার দলও যদি সেই সুযোগ দেয়, তাহলে আমি মানুষের সেবা করার জন্য প্রস্তুত।
সিলেট-১ আসনে সর্বশেষ সংসদ সদস্য ছিলেন ড. একে আবুল মোমেন। ২০২৪-এর নির্বাচনে অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আবদুল মোমেন। এর আগে এই আসনে টানা দুইবারের সংসদ সদস্য ছিলেন মোমেনের অগ্রজ, সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত।
বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান আর আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীও সিলেট-১ এর সংসদ সদস্য ছিলেন।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন এম. সাইফুর রহমান। তবে দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। সিলেট মহানগর ও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট-১ আসনে ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী একে আবদুল মোমেন ২ লাখ ৯৮ হাজার ৬৯৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন।
তার নিকটতম বিএনপির আবদুল মুক্তাদির পান ১ লাখ ২৩ হাজার ৮৫১ ভোট। এর আগে ২০১৩ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আবুল মাল আবদুল মুহিত।
আপনার মতামত লিখুন :