উত্তপ্ত খুলনার আন্ডারওয়ার্ল্ড। কিছুটা বিরতির পর আবার সক্রিয় চরমপন্থি সন্ত্রাসীরা। মৃত্যু আতঙ্কে আত্মগোপনে থাকা খুলনার শীর্ষ চরমপন্থি নেতা শেখ শাহীনুল হক শাহীন ওরফে বড় শাহীনকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। কারা এবং কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তা পুলিশ খুঁজে বের করার চেষ্টায় রয়েছে।
এদিকে গত দেড় মাস সন্ত্রাসী-চরমপন্থিদের তৎপরতা কিছুটা কম থাকলেও পুলিশের ঢিলেঢালা অবস্থানের কারণে সন্ত্রাসীরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে নগরীর বাগমারা ব্রিজের কাছে সন্ত্রাসীরা খুব কাছ থেকে শাহীনের মাথায় দুটি গুলি করে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। ময়নাতদন্ত শেষে গত রোববার দুপুরে মরদেহ তার পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
নিহত শাহীন নগরের দৌলতপুর থানার কার্তিককুল এলাকার শেখ আব্দুর রশিদের ছেলে। চরমপন্থি নেতা শাহীনের বিরুদ্ধে দৌলতপুরের আলোচিত শহীদ ওরফে হজি শহীদ হত্যা মামলাসহ ১০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। শাহীনকে হত্যার ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি। সন্দেহভাজন কাউকে আটকও করতে পারেনি পুলিশ।
স্থানীয় লোকজন জানান, হাজি শহীদ খুন হলেও তার একাধিক ভাইপো ও সহযোগীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত রয়েছে। তারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে বলে তাদের ধারণা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অস্ত্র বা জনবল তৈরি করতে চরমপন্থিরা এলাকার কিশোর ও উঠতি সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করছে এসব কর্মকাণ্ডে। পুরাতন চরমপন্থিদের নেটওয়ার্ক ও যোগাযোগ কাজে লাগাচ্ছে কিশোররা, যার কারণে খুব সহজেই বেড়েছে অস্ত্রের ব্যবহার।
এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্যসচিব নাগরিক নেতা অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার। তিনি বলেন, বারবার পুলিশ কমিশনারসহ কেএমপির শীর্ষ কর্তারা আশ্বাস দিলেও বাস্তবে মাঠ পর্যায়ে তার প্রতিফলন আমরা দেখছি না। এখন রাস্তায় হাঁটতে গেলে ভয় লাগে।
তিনি আরও বলেন, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ অকার্যকর, যে কারণে বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ের আন্তরিকতার ঘাটতি আমরা গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকেই দেখছি। শীর্ষ কর্তারা এ বিষয়ে অবহিত হলেও কোনো সফলতা দেখাতে পারছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিহত বড় শাহীন খুলনার দৌলতপুরের বিবদমান দুটি সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে আলোচিত টাইগার খোকনের বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে খুলনার দীঘলিয়া উপজেলায় একটি বাড়িতে প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে ব্রাশফায়ারে টাইগার খোকনসহ তার তিন সহযোগী নিহত হন।
এরপর থেকে টাইগার খোকনের ছোট ভাই জামিরকে হত্যা করে প্রতিপক্ষ গ্রুপ। একই গ্রুপের হাতে নিহত হয় আড়ংঘটা এলাকার পাঁচজন, যারা সবাই টাইগার খোকনের অনুসারী ছিলেন। এরপর থেকে খোকন গ্রুপের অনুসারীরা এলাকাছাড়া।
তবে ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে দৌলতপুরের চরমপন্থি গ্রুপের অন্যতম নেতা হুজি শহিদ নিহত হওয়ার পর ওই এলাকার বিবদমান সব সন্ত্রাসী গ্রুপ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ প্রভাবশালীদের আসামি করা হয়। তখন থেকে নিহত বড় শাহিন আত্মগোপনে চলে যান।
এদিকে চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি খুলনা সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপু প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীদের গুলিতে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে নিহত হন। টিপু হুজি শহিদ হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। পরে পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় এবং হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হয়।
একজন নারীকে হানি ট্রিপ হিসেবে ব্যবহার করে সাবেক কাউন্সিলর টিপুকে হত্যা করে হুজি শহিদের ভাইপো শেখ শাহরিয়ার ইসলাম পাপ্পু। চাচা হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে সে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেন মাসুম বলেন, শনিবার রাতে সন্ত্রাসীরা গুলি করে শাহীনকে হত্যা করেছে। তার মাথায় গুলির দুটি চিহ্ন রয়েছে।
পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে। কারা এবং কী কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি। তবে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করার জন্য পুলিশ কাজ করছে।
তিনি আরও জানান, দৌলতপুর থেকে শাহীনকে ডেকে বাগমারা এলাকায় নিয়ে তার পরিচিত কেউ তাকে হত্যা করেছে বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে।
এদিকে শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে নগরীর আমতলা শেরেবাংলা রোড হাজিবাড়ির সামনে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এর আগে গত ২৪ জানুয়ারি রাতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অর্ণব কুমার সরকারকে নগরের তেঁতুলতলা এলাকায় গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার পর পুলিশ মহানগরে ব্যাপক অভিযান শুরু করে।
এছাড়া চলে যৌথ বাহিনীর অপারেশন ডেভিল হান্ট অভিযান। এতে সন্ত্রাসীরা গা-ঢাকা দিয়েছিল। কিন্তু পুলিশের কার্যক্রম আবারও ঝিমিয়ে পড়ায় সন্ত্রাসীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে আবারও প্রতি রাতে কাউকে না কাউকে কুপিয়ে অথবা গুলি করে আহত করছে সন্ত্রাসীরা।
আপনার মতামত লিখুন :