দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা বিএনএমের নেতাদের অনেকে এখন নিষ্ক্রিয়। আবার দলটির অনেক নেতা এখন ভোল পাল্টিয়ে বা পরিচয় গোপন করে বর্তমান আমলেও ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। গত সংসদ নির্বাচনের আগের এই ‘কিংস পার্টি’র গুলশানের বিলাসবহুল কার্যালয়টি এখন বন্ধ। দলের নেই কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড।
এদিকে বিএনএমের শুরুর দিকে উদ্যোক্তাদের দাবি, শেখ হাসিনা সরকার সংগঠনটি ছিনতাই করে নিজেদের ‘পারপাস’ রক্ষায় কাজ শুরু করলে তারা বিএনএম ছেড়ে আসেন। তাদের দাবি, নির্বাচনের আগে এটির সঙ্গে যারা ছিলেন তারা টাকা কামানোর জন্যই ছিলেন।
তবে দলটির চেয়ারম্যান শাহ মো. আবু জাফর বলছেন, গত নির্বাচনে যারা অংশ নিয়েছিল তাদের ব্যাপারে বর্তমান সরকারের নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। তাই তারা সরকারের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছেন। তারা নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বর্তমান সরকার কাজ করবে বলেও প্রত্যাশা তার। অন্যথায় রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠবে না। এ ছাড়া বিএনএম কোনো কিংস পার্টি নয় বলেও দাবি করেন তিনি। অফিস বন্ধ নয়, পরিবর্তন করা হয়েছে বলেও দাবি তার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনকে সুষ্ঠু দেখানোর জন্য সরকারের নির্দেশে উত্থান হওয়া এসব দলের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে ‘মৃত্যু’ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এ কারণেই খুব একটা সাড়াশব্দ নেই দলগুলোর।
নির্বাচনের আগে আগে অপরিচিত কয়েকটি রাজনৈতিক দল বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এসব দলকে নিবন্ধনও দেওয়া হয়। বিভিন্ন দলছুট নেতাও এসব দলে বড় পদে যোগ দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চান।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের ১০ আগস্ট নিবন্ধন লাভ করে বিএনএম। দলটির প্রতীক হলো নোঙর। মাঠ পর্যায়ে তেমন কেনো ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও বিএনএমকে তখন নিবন্ধন দেওয়া হয়।
নিবন্ধন পেয়েই হঠাৎ করেই দলটি গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তৎপরতা শুরু করে। যে কারণে শুরু থেকেই দলটি ‘কিংস পার্টি’ নামে পরিচিতি পায়।
এদিকে বিএনএম গঠিত হয় ২০২১ সালের ৭ জুলাই। গঠনের দুই বছরের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায় দলটি। বিএনএমের নেতৃত্বে ছিলেন বিএনপির সাবেক দুই নেতা। তবে দলটিতে শুরু থেকেই সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের সংখ্যা ছিল বেশি।
বিএনএমের শুরুর সময়কার আহ্বায়ক অধ্যাপক আব্দুর রহমান বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য। তিনি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরগুনা-১ আসনে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সপ্তম সংসদ নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও হেরে যান।
বেশ অনেক দিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় আব্দুর রহমান একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনও ছিলেন। দলের সদস্যসচিব মেজর (অব.) মো. হানিফ বিএনপির নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য। মেজর (অব.) মো. হানিফ ২০২১ সালের ২৮ জুন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন।
হঠাৎ হানিফের দল ছাড়ার ঘটনাকে ইঙ্গিতপূর্ণ বলেছিলেন বিএনপির নেতারা। দল ছাড়ার ১০ দিনের মাথায় নতুন দল বিএনএম গড়ে তোলেন হানিফ। হানিফের সংসদীয় এলাকা সিরাজগঞ্জ-২। তিনি সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপিরও সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। হঠাৎ করেই গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দলটি ব্যাপক আলোচনায় আসে।
জানা যায়, দলটি রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ছোট অফিসটি পরিবর্তন করে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে গুলশান-২ নম্বর গোলচত্বরের কাছে প্রায় আড়াই হাজার বর্গফুটের বিলাসবহুল কার্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করে বিএনএম।
সেই কার্যালয় থেকেই দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও প্রার্থী বাছাই করা হয়। মূলত বিএনপির সাবেক এবং নিষ্ক্রিয় নেতাদের নিয়ে নির্বাচনে যেতেই দলটি তৎপরতা শুরু করে। সরকারের ‘পারপাস রক্ষা’ করতে মাঠে নামে বিএনএম। নেতৃত্বেও আসে পরিবর্তন।
২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০১ সদস্য বিশিষ্ট নতুন এই কমিটিতে চেয়ারম্যান পদ শূন্য রেখে ভাইস চেয়ারম্যান করা হয় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মো. আবু জাফরকে।
চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকায় তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। নতুন মহাসচিব ও মুখপাত্র হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেন ড. মো. শাহজাহান। এর পর থেকে বিএনপির সাবেক কয়েকজন সংসদ সদস্য ও নিষ্ক্রিয় নেতাদের দলে ভেড়াতে শুরু করেন তারা।
যদিও তাতে খুব একটা সাড়া পাননি তারা। সে সময় বিএনপির অভিযোগ ছিল, দল ভাঙতেই বিএনএমকে কাজে লাগাচ্ছে সরকার। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বিএনএমে যোগদানের খবরও রটে তখন। এ ছাড়া বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বিএনএমের চেয়ারম্যান হচ্ছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে সে খবরকে গুজব বলে আখ্যা দেন।
সে সময় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকে সরকারদলীয় নেতাদের সঙ্গে বসিয়ে বাগিয়ে আনতে কাজ করতেন দলটির সঙ্গে যুক্ত বিশেষ বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। তার মধ্যে ড. কামরুল আহসান ছিলেন অন্যতম। তিনি বিএনএমের বর্তমান কো-চেয়ারম্যান বলে জানিয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান শাহ মো. আবু জাফর।
কয়েক দিন আগেও ড. কামরুল আহসান বিএনএমের ইফতার মাহফিলে ছিলেন, বলেন চেয়ারম্যান। যদিও ড. কামরুল তিনি নিজেকে মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে পরিচয় দিতেন। গত সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনএমের নেতাদের সঙ্গে ড. কামরুলের বৈঠকের একাধিক ভিডিও রয়েছে।
এ ছাড়া বিগত সরকারের একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে দেশ ও বিদেশে কামরুলের সঙ্গে বৈঠকের ভিডিও রয়েছে। বিশেষ করে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতা ও বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারকারী পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাফিস শারাফাতের সঙ্গে দুবাইয়ে বৈঠকের ভিডিও রয়েছে। এ
ছাড়া প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমেদের সঙ্গে কাতারে বৈঠক করেছেন কামরুল আহসান। তিনি নিজেকে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বন্ধু পরিচয় দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হঠাৎ করেই কামরুল নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে মেলে ধরেছিলেন বিএনএমে। বিএনএম নির্বাচনের আগে গুলশানের যে অফিসটি ব্যবহার করেছে সেটি কামরুলের নিজের অফিস বলেও জানা গেছে।
২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে ৮২টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল বিএনএম। যার সব কয়টিতে শোচনীয় পরাজয় হয় দলটির প্রার্থীদের। জামানত বেঁচেছিল একটি আসনের প্রার্থীর। তাই ভোটের পর আওয়ামী লীগেরও কোনো সহানুভূতি পায়নি বিএনএম নেতারা।
তাই ভোটের পরপরই দলটির গুলশানের সেই জাঁকজমকপূর্ণ অফিসও বন্ধ হয়ে যায়। নিজেদের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়েও শুরু হয় নানা দ্বন্দ্ব। সরেজমিনে গুলশানের সেই অফিসে গিয়ে দেখা গেছে সেখানে বিএনএম অফিসের অস্তিত্ব নেই। নির্বাচনের পর দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মো. আবু জাফর এবং মহাসচিব ড. মো. শাহজাহান অনেকটাই রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রমে তাদের দেখা যায় না।
নির্বাচনের পর নিষ্ক্রিয় থাকার পর ২০২৪ সালের ১৩ জুন ব্যক্তিগত কারণে ড. মো. শাহজাহান মহাসচিবের পর থেকে পদত্যাগ করলে ড. আব্দুর রহমান নতুন মহাসচিবের দায়িত্ব পান। এ ছাড়া শাহ মো. আবু জাফর ভারপ্রাপ্ত থেকে দলের পূর্ণাঙ্গ চেয়ারম্যান হন।
২৯ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিএনএমের এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। এর কয়েক দিন পর অর্থাৎ ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনএমের কী অবস্থা সে প্রশ্ন অনেকের মাঝে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে কোনো কর্মকাণ্ডে নেই বিএনএম
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে রাজনৈতিক দল হিসেবে কোনো কর্মকাণ্ডে নেই বিএনএম। দলটির কেউ কেউ এখন বর্তমান সরকারের আনুকূল্যে যেতে চেষ্টা করছেন। গত সংসদ নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই দলটির নেতা বনে যাওয়া ড. কামরুল আহসান এখন নিয়মিত সরকারের দুই-একজন উপদেষ্টার কার্যালয়ে যাওয়া-আসা করছেন।
সেসব উপদেষ্টার সঙ্গে তার ব্যাপক সখ্য বলেও তিনি বিভিন্ন মহলে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করছেন। তিনি এখন বিএনএমের পরিচয় দেন না। বরং ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর তিনি এবং ভিন্নভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করেছে। নিজের ফেসবুকে কখনো বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে স্মৃতিচারণা, আবার কখনো রংপুরের শহিদ আবু সাঈদের ভাইয়ের সঙ্গে তোলা ছবি শেয়ার করছেন।
বিএনএম গঠনের শুরুর কয়েকজন উদ্যোক্তা: এদিকে বিএনএম গঠনের শুরু থেকেই যে কয়েকজন উদ্যোক্তা ছিলেন, তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার এম সারোয়ার হোসেন অন্যতম। তিনি জানান, একটা ভালো উদ্দেশ্যে এই সংগঠনটি আমি ও মেজর (অব.) মো. হানিফসহ কয়েকজন মিলে করতে চেয়েছিলাম।
আমাদের একজন বিএনপি নেতা মাঠে নামিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি সরে দাঁড়ান। কিন্তু যখন দেখলাম এটি ছিনতাই হয়ে গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার এটিকে কবজায় নিয়ে ব্যবহার করছে, তখন আমি বের হয়ে আসি। এ সংগঠনে শেষ পর্যন্ত যারা ছিল তারা সরকারের পারপাস রক্ষায় কাজ করেছেন।
মূল উদ্যোক্তাদের বাদ দিয়ে ধুরন্ধর মো. শাহজাহান মহাসচিব ও কামরুল আহসান মুখ্য সমন্বয়ক বনে গিয়ে সরকারের কাছ থেকে টাকা-পয়সা কামিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
আমি কোনো দিন বিএনএমের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না: ড. কামরুল আহসান
এসব বিষয়ে ড. কামরুল আহসান জানিয়েছেন, আমি কোনো দিন বিএনএমের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। অথচ দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান শাহ মো. আবু জাফর তাকে কো-চেয়ারম্যান হিসেবে দাবি করেছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, তারা আমাকে সামনে আনার চেষ্টা করেছেন।
আমি সামনে আসিনি। এমনকি গত নির্বাচনে আমাকে ভোট করারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিএনএম নেতারা। দলটির তৎকালীন মহাসচিব ড. শাহজাহানসহ একাধিক নেতার সঙ্গে দলীয় ফোরামে বৈঠকের ভিডিও আছে এমন কথা বলাতে তিনি বলেন, এটি পারসোনাল।
তৎকালীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের পাশাপাশি ও ব্যবসায়ী নাফিস শারাফাতের সঙ্গে বিদেশে সফরে ভিডিওর বিষয়ে তিনি বলেছেন, আমি ব্যবসায়ী। দেশের জন্য কাজ করি। অনেক সময় দেশের জন্য ফান্ড আনতে কাজ করতে গিয়ে তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে হয়েছে।
৫ আগস্টের পর বেগম খালেদা জিয়া ও শহিদ আবু সাঈদের ভাইকে নিয়ে পোস্ট দেওয়ার বিষয়ে কামরুল বলেন, আমি ম্যাডাম খালেদা জিয়ার সিকিউরিটি টিমে কো-অর্ডিনেটর ছিলাম। আমি আগেও তাকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছি। আমি কোনো দলের সদস্য না।
আপনার মতামত লিখুন :