দীর্ঘদিন স্থবির থাকা ই-কমার্স খাত ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এই খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিগত কয়েক মাসের তুলনায় গ্রাহকরা ই-কমার্সে কেনাকাটার পরিমাণ বাড়িয়েছেন। তবে গত বছরের ঈদুল ফিতরের তুলনায় এবারের বিকিকিনি নিয়ে আবার প্রতিষ্ঠানভেদে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এমন প্রেক্ষাপটেই গ্রাহকদের জন্য নানা অফার আর বাহারি পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন ই-কমার্স উদ্যোক্তারা।
দারাজ বাংলাদেশের মতো ই-কমার্সভিত্তিক মার্কেটপ্লেসের পাশাপাশি বেচাকেনার পালে হাওয়া লেগেছে ফেসবুকভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের পেইজগুলোতেও। তবে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে ই-লজিস্টিকস খাতে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্ডারকৃত পণ্য গ্রাহকদের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হিমশিম খাচ্ছে ই-লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠানগুলো।
প্রায়শই ছিনতাই অথবা ডাকাতির কবলে পড়ছে ই-কুরিয়ার, পার্সেলডেক্সের মতো ই-লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠানের যানবাহন এবং ডেলিভারি নির্বাহীরা। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা কামনা করছে ই-লজিস্টিকস খাতের উদ্যোক্তারা।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর মন্দা যাচ্ছিল দেশের ই-কমার্স বাজার। তবে রমজানে আসন্ন ঈদুল ফিতরের কেনাকাটায় ই-কমার্সে গ্রাহকদের কেনাকাটার পরিমাণ বেড়েছে। এই সময়ে সর্বোচ্চ গ্রাহক আকর্ষণে নানা অফারও ঘোষণা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ধারণা করা হচ্ছে, ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস এবং ফেসবুক পেইজ মিলিয়ে দৈনিক গড়ে অন্তত ২ লাখ অর্ডার জমা পড়ছে গ্রাহকদের পক্ষ থেকে।
বিগত কয়েক মাস এবং গত বছরের ঈদুল ফিতরের তুলনায় এই রমজানের কেনাকাটার তুলনা করে দারাজ বাংলাদেশের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার এ এইচ এম হাসিনুল কুদ্দুস রুশো রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘গত মাসের তুলনায় এই মাসে বিক্রি বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ।
তবে গত বছরের ঈদুল ফিতরের কেনাকাটার সঙ্গে যদি তুলনা করেন, তাহলে বিক্রি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। আগে গ্রাহকরা উল্লেখযোগ্য হারে দামি টিভি, ফ্রিজ, এসির হাই-এন্ড পণ্য কিনতেন। এবার লক্ষ করা যাচ্ছে যে, সচরাচর প্রয়োজন হয় এমন পণ্য বেশি কিনছেন গ্রাহকরা। কেউ হয়তো সর্বোচ্চ একটা মোবাইল কিনছেন।’
এমন প্রেক্ষাপটে গ্রাহকদের জন্য আকর্ষণীয় অফার দিচ্ছে দারাজ। হাসিনুল কুদ্দুস রুশো বলেন, ‘উৎপাদক বা আমদানিকারকদের থেকে সরাসরি সংগ্রহ করে গ্রাহকদের কাছে পণ্য পৌঁছাচ্ছি। ফলে গ্রাহকদের ভালো একটা ডিল দেওয়া যায়। এভাবে প্রায় ৫ কোটি টাকা সমমূল্যের কুপন দিচ্ছে দারাজ। পাশাপাশি তিনটা পণ্য কিনলে ফ্রি ডেলিভারি, চারটা কিনলে বিশেষ উপহার দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া বিভিন্ন পেমেন্ট পার্টনারের মাধ্যমে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় চলছে।’
গত বছরের ঈদুল ফিতরের তুলনায় এবারের ঈদে বেচাকেনার নিম্নমুখী প্রবণতা দেখছেন ফেসবুকভিত্তিক নারী উদ্যোক্তারাও। ‘সানভিস বাই তনি’-এর কর্ণধার রোবাইয়াত ফাতিমা তনি বলেন, আন্দোলন-পরবর্তী সময়ের তুলনায় বিক্রি এখন বেশ ভালো। তবে গত বছরের ঈদের তুলনায় বিক্রি গড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ কম।
শুধু আমার না, বরং পুরো ইন্ডাস্ট্রিরই একই অবস্থা। প্রত্যেক ঈদেই ব্যবসায়ীরা চান, গত বছরের তুলনায় ব্যবসা ভালো হবে; কিন্তু এবার সেই লক্ষণ দেখছি না। গতবার যিনি একসঙ্গে লাখ টাকার পণ্য কিনতেন, তিনি এখন ৪ হাজার টাকার পণ্য কিনছেন।’ ব্যবসার মন্দার পেছনে দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতির মতো বিষয়কে কারণ হিসেবে দেখছেন এই নারী উদ্যোক্তা।
তিনি বলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এখনো ‘স্টেবল’ না। ডেলিভারি নির্বাহীদের থেকে টাকা-পয়সা বা পার্সেল ছিনতাই হচ্ছে। ফেসবুক পেইজের পাশাপাশি আমাদের অফলাইন স্টোর আছে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না থাকায় গ্রাহকরা আসছেন না। বিশেষ করে মেয়েরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ জন্য তারাও রাতে বের হচ্ছেন না। আর এই সব কিছুর প্রভাব পড়ছে ব্যবসায়।’
এদিকে ই-কমার্সের পণ্য গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে বেগ পেতে হচ্ছে ই-লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। ডেলিভারি যানবাহনে হামলা এবং ডাকাতি ও ছিনতাই, ডেলিভারি নির্বাহীদের থেকে অস্ত্রের মুখে নগদ অর্থসহ ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে মূল্যবান পণ্যের পার্সেল।
গত মাসে ই-লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠান স্টেডফাস্টের দুটি গাড়ি ঢাকার কেরানীগঞ্জের খোলামুড়া ঘাটের পাশে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে। এ সময় দুজন চালককে রড দিয়ে পিটিয়ে আহত করে ছিনতাইকারীরা। ই-লজিস্টিকস খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হরহামেশাই এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাদের।
স্টেডফাস্ট কুরিয়ারের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম রিদওয়ানুল বারী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঈদুল ফিতরের কেনাকাটায় বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার তেমন ব্যবসা হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে অন্যান্য সময়ের তুলনায় রোজার সময়ে এমনিতেই দ্বিগুণ পার্সেল ডেলিভারির জন্য আসে। অবশ্য এবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির খুবই অবনতি হয়েছে।
বিভিন্ন স্থানে স্টেডফাস্টের গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। ড্রাইভারদের মারধর করে নগদ অর্থ, তাদের মোবাইল ছিনতাই করেছে। ডেলিভারির মালামাল লুট করেছে। আমাদের সঙ্গে এমন হলেও মার্চেন্টদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিই আমরা। ফলে আমাদের ব্যবসায় একটা বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা চেয়েও পাইনি। যদিও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ঘোষণার পর (যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযান) পরিস্থিতি আগের তুলনায় কিছুটা ভালো হয়েছে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ পথ এড়িয়ে ডেলিভারি ভ্যান চলাচলের চেষ্টা করছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ডেলিভারি সন্ধ্যার আগেই দিনে দিনে শেষ করার চেষ্টা করছি। কোথাও একজন রাইডারের বদলে দুজন রাইডার পাঠাচ্ছি। এভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি।
তবে গত বছরের তুলনায় ই-লজিস্টিকসে ডেলিভারি হওয়া পার্সেলের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন আরেক ই-লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠান পার্সেলডেক্স কুরিয়ারের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই রমজানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখ পার্সেল ডেলিভারি হচ্ছে ই-লজিস্টিকস কুরিয়ারের মাধ্যমে।
এটা গত বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। ঢাকা থেকে বাইরে ডেলিভারি হচ্ছে প্রায় ৬ লাখ পার্সেল, আর ঢাকায় আসছে প্রায় দেড় লাখ পার্সেল। সুন্দরবন এবং এসএ পরিবহনের মতো গতানুগতিক কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান দিনে আরও প্রায় ৩ লাখ পার্সেল ডেলিভারি করে।
তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হলে এই সংখ্যা আরও বাড়ত। প্রতিদিনই ডেলিভারি নির্বাহীদের এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি। ডেলিভারিবয়দের থেকে নগদ টাকা, তাদের মোবাইল, এমনকি গ্রাহকদের পার্সেল নিয়ে নিচ্ছে। বিষয়টা নিয়ে ই-লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ উদ্বিগ্ন।
এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে ই-লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠানগুলো। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সফলতার সঙ্গে নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা জানিয়েছে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ‘পাঠাও’।
প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়, পাঠাও কুরিয়ারের সরবরাহব্যবস্থা খুবই সুচারুভাবে নিশ্চিত করা হয়। এই প্রসেস দিয়েই প্রতিটি পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে পাঠাও কুরিয়ার। এ ছাড়া প্রোডাক্ট কিংবা ডেলিভারি এজেন্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব ধরনের আইনি ব্যবস্থাপনাও নিশ্চিত করে পাঠাও কুরিয়ার।
আপনার মতামত লিখুন :