বাস্তবসম্মত বাজেটে প্রাধান্য পাবে জ্বালানি ও রাজস্ব বৃদ্ধি

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: মার্চ ১৯, ২০২৫, ১২:৫১ এএম

বাস্তবসম্মত বাজেটে প্রাধান্য  পাবে  জ্বালানি ও রাজস্ব বৃদ্ধি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

শিল্পনির্ভর অর্থনীতির দেশ গড়তে জ্বালানি খাত উন্নয়নের সিঁড়ি। সেখানে আওয়ামী সরকার আমলে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে প্রচুর অর্থ নয়ছয় হয়েছে। তবে সব ছাপিয়ে বিদেশি আয় বৃদ্ধি, জ্বালানিনিনির্ভরতা বাড়ানো ও রাজস্ব বৃদ্ধি নিয়েই ২০২৫-২৬ সালে বাস্তবসম্মত বাজেট ডিজাইন করছে অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে জুলাই আন্দোলনে আহত ও নিহতদের নিয়ে বাজেটে থাকছে বিশেষ বরাদ্দ। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) উন্নয়নমুখী নতুন অর্থবছরের বাজেট তৈরিতে এই সুপারিশ করে।

বিগত দিনে দেশে বাস্তবসম্মত বাজেট ছিল না। প্রবাসী আয়ের সৈনিকদের যথার্থ সম্মানে ব্যর্থতা এবং টানা রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে বিগত দিনের বাজেট করা হয়। একই সঙ্গে ভুল তথ্যে ২০২৬ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যদিও এলডিসি উত্তরণের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে আহ্বান জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। 

সিপিডি জানায়, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করবে। তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এলডিসির চ্যালেঞ্জ গ্রহণে দেশ প্রস্তুত নয়। গ্র্যাজুয়েশনের পরে বাংলাদেশকে কমার্শিয়াল রেটে ঋণ নিতে হবে। যা পরিশোধ করা ও ঋণের শর্ত পূরণ কঠিন। ফলে গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী শুল্ক সুবিধা না থাকায় রপ্তানি খাতে বছরে ৮ বিলিয়ন ক্ষতি হতে পারে।

সিপিডির সুপারিশ, উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ক্যাপাসিটি চার্জ বাতিল থাকছে। ‘নো ইলেকট্রিসিটি-নো পেমেন্ট’ শর্তে বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। বার্ষিক করমুক্ত আয়ের সীমা আরও ৫০ হাজার টাকা বৃদ্ধি করে চার লাখ নির্ধারণ, দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে থাকা দ্রব্যমূল্য কমাতে মূল্যস্ফীতির হার ৭-৮ শতাংশে এ নামিয়ে আনার পরিকল্পনাও রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রায় (ডলার) স্থিতিশীলতা, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি (বেড়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশ), রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) প্রবৃদ্ধিতে (প্রায় ২২ দশমিক ২৬ শতাংশ) বাস্তবসম্মত বাজেট তৈরিতে সহযোগিতা করছে সিপিডি।

আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তি পর্যায়ে করমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ পর্যন্ত করার সুপারিশ করেছে। বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা আছে। যা আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরে থেকে ৫০ হাজার টাকা বাড়ানোর কথা বলেছে সিপিডি।

এ বিষয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী ছিল। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির তুলনায় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেশি। এছাড়া, শহরের চেয়ে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি। সাধারণ মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো যৌক্তিক বলে আমরা মনে করি। আগামী অর্থবছর এটি বাড়িয়ে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করা উচিত।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুন শেষে মূল্যস্ফীতির হার ৭-৮ শতাংশে নামিয়ে আনার যে পরিকল্পনার কথা বলেছে, সেটি অর্জন করা অসম্ভব হবে। কারণ এটি বাস্তব সম্মত নয়। মূলত বোরো চাষ, সংকোচনমূলক মুদ্রানিতি ও অনান্য বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে। আর বাস্তবায়ন গত কয়েক বছর ধরে সম্ভব হয়নি।’

সিপিডির সুপারিশ, বর্তমানে দেশে রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষ করে সহজ করনীতি দরকার। পাশাপাশি নেট বাড়াতে হবে। বর্তমানে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি মাত্র ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২ দশমিক ২০ শতাংশ। তাহলে লক্ষণীয় যে, বাস্তবতার সঙ্গে অর্জনের বিস্তর ব্যবধান। 

এটা প্রতিবছর করা হয়। এটি দূর করতে হলে সামনে আদায়ের প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৫৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ। যা আদায় করা অসম্ভব। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় কিছুটা গতি পেয়েছে। এদিকে জুলাই  থেকে ডিসেম্বর সময়ে রাজস্ব ঘাটতি ২৯ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা। আর গত বছর সেই ঘাটতি ছিল ৭ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। এই ঘাটতি পুরণে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বেশি অর্থ নেওয়া হয়েছে। 

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি সময়ে গড়ে মূল্যস্ফীতি কমেছে। যা ছিল প্রায় ৯ শতাংশের কাছাকাছি।  তবে গ্রামে এর চেয়ে বেশি ছিল। পক্ষান্তরে শহরে মূল্যস্ফীতি খানিকটা কম লক্ষ্য করা গেছে। আবার খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি ছিল। তবে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন পেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।

 তখন মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী ধারা থাকবে না। আর মূল্যস্ফীতির  চলতি অর্থবছরের ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য কোনোভাবে অর্জন করা যাবে না বলে না জানায় সিপিডি। 

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ইস্যুতে ফাহমিদা খাতুনের সুপারিশ, ‘আগের সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। সেখানে প্রচুর অর্থ নয়ছয় হওয়ায় এ খাতে সংকট ঘনীভূত হয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে জনগণের করের টাকা তছরুপ করা হয়েছে।’

‘বিশেষ করে পেট্রোবাংলা, আদানি, রূপপুর, স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের বকেয়া পরিশোধে মেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। বিদেশিদের পাওনা শোধ করতে হবে। এজন্য বাজাটে বরাদ্দ থাকতে হবে। এ খাতে ভর্তুকির চাপ কমাতে বাজার মূলের চেয়ে অধিক দুর পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে কমাতে হবে। দেশের ভেতরে গ্যাসের ৩৫টি কূপ খনন প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে’ বলেন তিনি। 

২০২৬ সালের মধ্যে এলডিসি গ্রাজুয়েশনের জন্য ২০২৫-২৬ সালের বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে। কেননা চলতি বছরে এই খাতে বাজেটে বরাদ্দ বাস্তবসম্মত ছিল না। এক্ষেত্রে আগের সরকারের ধারাবাহিকতা ছিল। এজন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য বেধে দেওয়া সূচকের অজর্ন সম্ভব হয়নি। যা নিয়ে সিপিডি আগাম সতর্ক করেছিল। 

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য সূত্র জানায়, দেশে বিদেশি বিনিযোগ কম হওয়ার সম্ভাবনা। সেজন্য ঘাটতি পুরণে অব্যন্তরীণ উৎসের দিকে নির্ভর করতে হয় সরকারকে। আবার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কম থাকায় বিক্রি কমে যেতে পারে। সবমিলে রাজস্ব বাজেরটের থাটতি পুরণে ব্যাংকের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি  হবে। মূলত এনিবিআরের সক্ষমতার ঘাটতির কারণে রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে। যার চাপ পড়ছে ব্যাংকের ওপর। 

২০২৫ সালের মধ্যে এসব করার কথা থাকলেও করা হয়েছে মাত্র একটি। পাশাপাশি নবায়নযাগ্য জ্বালানিতে ভ্যাট, অগ্রিম কর কমাতে হবে। সোল্যার প্যানেলে কর ছাড় দিতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য পৃথক তহবিল গঠন করতে হবে। জীবাষ্ম জ্বালানির ব্যবহারে কর সুবিধা দিতে হবে। 

জুলাই বিপ্লর নিয়ে সিপিডির সুপারিশ, যারা জুলাই এ আগাস্টের গণঅভ্যুত্থানে ১৪ হাজার আহত এবং প্রায় ১৪ নিহতদের ক্ষতিপূরণে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। আহতের কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং কর্মের ব্যবস্থা করতে হবে। নিহতের স্বজনদের জন্য কর্মমুখী বৃত্তিমূলক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।  

এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে সামগ্রিকভাবে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। প্রাথমিক স্কুলে ফিডিং সর্বজনীন করা যেতে পারে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার দিকে বাড়তি নজর দিতে হবে। সর্বোপরি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ২০২৫-২৬ সালের জন্য সমন্বিত ও দূরদর্শী বাজের প্রণয়ন করতে হবে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!