ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দু’ভাগে বিভক্ত এখন রাজনীতির মাঠ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টা চলছে বলে সন্দেহ করছে বিএনপি। এরই মধ্যে গণপরিষদ নির্বাচন, নতুন সংবিধান, সেকেন্ড রিপাবলিক ও জুলাই ঘোষণাপত্র ঘিরে সময়ক্ষেপণের আয়োজন করা হচ্ছে বলেও মনে করে দলটি।
সরকারের ওপর আস্থা হারালে, সেটা হবে জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে আগামী ডিসেম্বরে ভোটের কথা বারবার বলা হলেও আস্থাহীনতায় ভুগছে বাংলাদেশ জাতীয়বাতাদী দল (বিএনপি)। দলটির নীতিনির্ধারণী নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, চলতি বছরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে ‘ষড়যন্ত্র’ থাকতে পারে। তাই মৌখিক ঘোষণা নয়, আগামী মাসের মধ্যে পরিষ্কার রোডম্যাপ চায় বিএনপি।
এদিকে সময় যত যাচ্ছে ততই অস্বস্তি বাড়ছে বিএনপির মধ্যে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দুর্নীতি, দখলদারি, চাঁদাবাজিমুক্ত সুশৃঙ্খল দেশ প্রত্যাশা করেছিল প্রায় সব শ্রেণির মানুষ। কিন্তু বিএনপি নেতাকর্মীদের একের পর এক নেতিবাচক কর্মকাণ্ড ভোলাতে পারেনি পতিত আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীদের অন্যায়-দুর্নীতি।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেই একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশ।
যদিও দলের নেতাকর্মীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে ৫ আগস্টের পর থেকেই শক্ত অবস্থানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। অভিযোগ উঠলেই নিয়েছেন সাংগঠনিক ব্যবস্থা। তবু থামাতে পারছেন না নেতাকর্মীদের। বিষয়টি নিয়ে গোটা দলের মধ্যেই এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে। দলটির দায়িত্বশীল নেতাদের ভাষ্য, অভিযোগ উঠলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিএনপি অপপ্রচারের শিকার হচ্ছে।
যারা অপকর্মে জড়িত তারা অধিকাংশই ‘সুবিধাবাদী’ রাজনীতিক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত টিম দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফরের মাধ্যমে স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছেন নেতাকর্মীদের। তাদের বক্তব্য, কোনো ব্যক্তির ভুলের দায়ভার সংগঠন নেবে না।
আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে এখনো সংশয়ে আছে বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারণী নেতারা মনে করেন, চলতি বছরে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে এখনো ‘ষড়যন্ত্র’ চলছে। খোদ সরকারের ভেতর থেকেই নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রচেষ্টা রয়েছে।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও ব্যক্তিত্বকে বলেছেন, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করছে তাঁর সরকার। নির্বাচন কমিশনও (সিইসি) সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছে। তবু ডিসেম্বরে নির্বাচন নিয়ে ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছেন বিএনপির নেতারা। তবে গত সোমবার পুলিশের অনুষ্ঠানে অন্তবর্তী সরকারপ্রধান বলেছেন, সরকারের হাতে খুব বেশি সময় নেই।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। কাজেই এর মধ্যেই সংস্কার করে ফেলতে হবে। বলেন, আমরা এরই মধ্যে সাত মাস পার করে এসছি। আমরা বলছি, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। কাজেই কি কি সংস্কার করতে চাই, তা করে ফেলতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফলে আমরা মস্ত বড় সুযোগ পেয়েছি। এটাকে যেন হারিয়ে না ফেলি। আমরাও সেটা চেষ্টা করব, ভবিষ্যতে যারা আসবে তারাও আশা করি চেষ্টা করবে। পথটা যেন আমরা সৃষ্টি করে দেই।
প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যে আস্থা রাখতে চায় বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, সরকারকে সহযোগিতা করছে বিএনপি। বিএনপির চাওয়া যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের আয়োজন করা। তাতে করে সবার জন্যই মঙ্গল। তবে সাবেক সমন্বয়ক কিংবা নতুন দলের নেতাদের নির্বাচন পেছানোর দুরভিসন্ধি দেখছে বিএনপি। দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতের হাত রয়েছে এর পেছনে, এমন সন্দেহ করছে বিএনপি।
এরই মধ্যে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে নারীর প্রতি সহিংসতা, উগ্রপন্থিদের উত্থান, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাইয়ের ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের দোসররাও যুক্ত আছে বলে কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে।
সবকিছু মিলিছে দ্বিধাদ্বন্দ্বে দেশের সবচে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অবশ্য বলেছেন, যত সহজ ভাবছেন তত সহজ হবে না এবারের নির্বাচন এরই মধ্যে মিডিয়া ট্রায়ালের সম্মুখীন হচ্ছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারেক রহমান।
নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপির সেকেন্ড রিপাবলিক ধারনা কিংবা গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন নিয়েও বিরোধিতা করছে বিএনপি। একসঙ্গে গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন ইস্যুতে কোনো ধরনের জাতীয় ঐক্য হবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।
রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, আমাদের রিপাবলিক কি অসুস্থ নাকি মারা গেছে, সেকেন্ড রিপাকলিক প্রয়োজন কেন আমি বুঝতে পারছি না। অযৌক্তিত দাবি তুলে নির্বাচন বিলম্বিত করার চক্রান্ত চলছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকারে ছাত্রদের প্রতিনিধি রয়েছে আবার তারাই গঠন করছে নতুন দল। বিষয়টি কেমন হয়ে গেল না। নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি গঠনকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু আমাদের সন্দেহ অন্যদিকে একটি অংশ সরকারে থেকে আরেকটি অংশ দল গঠন করে বাড়তি সুবিধা নেবে কী না। বন্ধুদের সহযোগিতা করতে সরকারে থাকা বন্ধুরা আবার কি করে বসে সেটা কিন্তু দেখার বিষয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা হারাতে না চাইলে, একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে মনে করি।
আমার মনে হয় না অন্তবর্তী সরকার আস্থা হারানোর মতো এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে। ফ্যাসিবাদ বিদায় নিয়েছে আন্দোলনের মাধ্যমে। আর কেউ সেই পথে হাঁটবে বলে মনে হয় না। আমার চাই দ্রুত একটি নির্বাচন। দেশের মানুষও তাই চায়।
অন্তর্বর্তী সরকার ‘অনির্দিষ্ট মেয়াদে’ ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করলে, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা হাফিজ উদ্দিন আহমেদের। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, প্রশাসনকে ব্যবহার করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ তারা কি পেরেছে? তাই এসব করে লাভ নেই।
দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে বসে আছে কবে হবে নির্বাচন। আমার আশা করি, দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করবে সরকার। এর কোনো বিকল্প নেই। যত সময় নষ্ট করবে তত সমস্যা বাড়বে। বিএনপির সন্দেহ সত্যি হলে, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব বাড়বে বলে মনে করেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তাতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ অস্থিরতার সুযোগ পাবে।