অপরাধ দমনে সারা দেশে ‘ডেভিল হান্ট’ ও কম্বাইন্ড প্রেট্রোলিং নামক আইনশৃঙ্খলা বিশেষ অভিযান চলমান থাকলেও থেমে নেই চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, নীরবে চাঁদাবাজি ও মব ভায়োলেন্সসহ নানা অপকর্ম। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উল্লেখ্যযোগ্য উন্নতি হচ্ছে না। ঢাকা মহানগরীতে প্রায়ই ঘটছে ছোট-বড় ছিনতাইয়ের ঘটনা।
অন্যদিকে জেলা-উপজেলায় রাতে ডাকাত আতঙ্ক বিরাজ করছে। এসব ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ ও আতঙ্ক কাটছে না। আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে পেশাদার অপরাধী ছাড়াও কুচক্রী মহল বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রগুলো দাবি করছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে জনগণের আস্থা ফেরাতে সরকারকে প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে দেশের স্থিতিশীলতা দীর্ঘমেয়াদে হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে ও অপরাধীদের ধরতে চেকপোস্ট এবং অভিযানের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা তৎপরতা।
তবে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে যেমন প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা বেড়েছে, তেমনই অন্যদিকে একধরনের উচ্ছৃঙ্খল জনতার উত্থান ঘটেছে। বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছেন, ২০২৪ সালে এক ধরনের বিশৃঙ্খলতা থাকলেও শৃঙ্খলাও ছিল যথেষ্ট। এখন সেই শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে যথেষ্টভাবে প্রশাসনকে কঠিন হতে হবে।
অন্যথায় সাধারণ মানুষ নিরাপত্তার সংকটে পড়বে। একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে দেশ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসের মাথায়ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি লক্ষ করা যাচ্ছে।
সহিংসতা, চুরি-ডাকাতি, রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম বেড়ে গেছে, যা জনমনে চরম উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। যদিও সরকারি দায়িত্বশীল মহলের দাবি-বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির জন্য অনেকাংশে আওয়ামী লীগ দায়ী। তাদের নেতারা বিপুল পরিমাণ টাকা ছিটিয়ে পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু ছিনতাই ও ডাকাতির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে ঢাকার বনশ্রী এলাকায় এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে ২০০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করা হয়। বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায়, ছিনতাইকারীরা ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মালামাল লুট করছে।
বিষয়টি ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। যদিও কয়েক দিনের মধ্যে ঘটনার রহস্য উন্মোচন ও ডাকাতদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। এর আগে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় যৌথ বাহিনী সেখানে অভিযান চালায়। এতে গুলিতে দুইজন নিহত হয়।
পুলিশ জানায়, তারা চিহ্নিত সন্ত্রাসী ছিল। ওই এলাকার বাসিন্দা আসিফুল ইসলাম বলেন, ওই ঘটনার পর কিছুটা কমেছে, কিন্তু আতঙ্ক রয়েই গেছে। বিশেষ করে ঈদের আগে পরিস্থিতি কেমন হবে, সেটা নিয়েই সবাই চিন্তিত। অন্যদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। এসব ঘটনার অনেক খবর গণমাধ্যমে আসছে না।
এদিকে সারা দেশে ছিনতাই, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ব্যর্থতার অভিযোগ করে তার পদত্যাগের দাবিতে সম্প্রতি উত্তাল হয়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কিছুদিন আগে গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে ক্ষমা চেয়ে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগের দাবি করেন ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’এর ব্যানারে আন্দোলনকারীরা।
তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক দাবি করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দাবি করেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপারে স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আমার মনে হয় কোনো মিডিয়ায় এমন লেখে নাই, মাঝে কিছুটা অবনতি হলেও বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই ভালো।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক গ্রুপে রিদওয়ান খান নামে এক বাসিন্দা বলেন, আমাদের তো প্রতিদিনই রাত জাগা হয়। একটা বড় টিম হয়ে কাজ করলে এবং পাঁচটা বাইক নিয়ে অন্তত ১০ জন মানুষ একসঙ্গে বনশ্রীতে সারারাত ঘুরলে অনেকটুকু বিপদ কাটবে।
রিদওয়ান খানের আহ্বানে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ সাড়া দেন এবং পাহারার কাজে নিজেদের অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। সবার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপ খোলার উদ্যোগের কথাও জানান রিদওয়ান খান। এদিকে রাজধানীতে দিনে-রাতে ছিনতাইকারী আতঙ্ক ও জেলা-উপজেলায় রাতে ডাকাত আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
পুলিশের বরাতে ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের অপরাধের তুলনামূলক একটি পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ডাকাতি ঘটেছে ৩৯টি আর ২০২৫ সালে ৭১টি। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ছিনতাই হয়েছে ১১৪টি আর একই সময়ে ২০২৫ সালে হয়েছে ১৭১টি।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে খুনের ঘটনা ছিল ২৩১টি। ২০২৫ সালের যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯৪টি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরাধের মাত্রা মূলত পরিসংখ্যানের কয়েকগুণ বেশি। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা চালিয়ে ৫ হাজার ৭৫০টি অস্ত্র লুট করা হয়েছিল।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানে ৪ হাজারের মতো অস্ত্র উদ্ধার করে। এখনো ১ হাজারের বেশি অস্ত্র অপরাধীদের হাতে রয়েছে। এসব অস্ত্র দিয়ে চলছে নানা অপরাধ। এসব অস্ত্র উদ্ধারে গুরুত্ব দিচ্ছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, পেশাদার পুলিশিং হচ্ছে না বলেই এমনটি হচ্ছে। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীতে ঘাপটি মেরে থাকা গণঅভ্যুত্থানবিরোধী পুলিশ সদস্যদের গাফিলতির কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তাদের মতে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে এ বাহিনীতে নিয়োগের সময় একেবারে বেছে বেছে আওয়ামীপন্থিদের চাকরি দেওয়া হয়েছে।
এ কারণে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর সেসব দলীয় পুলিশ সদস্যের ভয়ঙ্কর রূপ দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। এ কারণে পুলিশ বাহিনীর বর্তমান আইজিসহ পুলিশের একটি অংশ শত চেষ্টা করেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না। মূলত তৃতীয় পক্ষের ষড়যন্ত্রের কারণে পুলিশের অনেক সদস্য কৌশলে নিষ্কিয় ভূমিকা পালন করছে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সহিংস পথ বেছে নিচ্ছে, যা দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করছে। রাজনৈতিক দলগুলোরও দায় কম নয়। চাঁদাবাজি, দখলবাজির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে মাঠে থাকা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে সাধারণ অপরাধীরা।
এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকেও আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি থানা পুলিশ ও র্যাবকে অপরাধ দমনে আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। নচেৎ চলতি রমজান মাসের সামনের দিনে পেশাদার অপরাধী ও রাজনৈতিক দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও আরও বেপরোয়া হয়ে হয়ে উঠতে পারে। এমনটা ঘটলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এএআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিনিয়ত অপরাধী গ্রেপ্তারের নতুন নতুন কৌশলে অভিযান অব্যাহত আছে। অপরাধের মাত্রা আগের চেয়ে কমেছে। ঈদকে সামনে রেখে অপরাধীরা সক্রিয় হতে না পারে, সে লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
অপরাধীরা এখন যতটা সক্রিয়, পুলিশ ততটা নিক্রিয়: সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অপরাধীরা এখন যতটা সক্রিয়, পুলিশ ততটা নিষ্ক্রিয়। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। তারা বলছেন, পুলিশ কেন সক্রিয় হতে পারছে না, তা পুলিশকেই পরিষ্কার করে বলতে হবে।
তাদের কোনো যৌক্তিক সমস্যা থাকলে তা সমাধান করে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে। সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা বলেন, ‘পুলিশের ওপর দিয়ে বড় একটা ধকল গেছে। যেটা এখনো তারা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। তবে বাহিনীতে নানা কারণে কিছু লোকজন নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :