৫ আগস্ট। একদফা দাবিতে উত্তাল সিলেটের রাজপথ। শাবিপ্রবি, মদিনা মার্কেট, সুবিধ বাজার, চৌহাট্টা-সব এলাকা রীতিমতো রণক্ষেত্র।
একদিকে ছাত্র-জনতা, অন্যদিকে পুলিশ-যুবলীগ-ছাত্রলীগ। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর চলছে নির্বিচারে গুলি। অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে মাঠে নেমেছে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুলি ছুঁড়ছে। এটি যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ‘ওয়ার্মআপ অপারেশন’। এতেই ম্যাসাকার রাজনৈতিক সম্প্রীতির শহর সিলেট মহানগরী। সেই সময় এই অপারেশনের নেতৃত্বে ছিলেন সিলেটে আওয়ামী লীগের চার রত্ন।
স্বেচ্ছাসেবক লীগের নগর সভাপতি আফতাব হোসেন খান, জেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম, দুর্ধর্ষ ক্যাডার পীযূষ কান্তি দে এবং সাবেক যুবলীগ নেতা আব্দুল হান্নান-সিলেট আওয়ামী লীগে এরা ‘চার খলিফা’ নামে পরিচিত। চিনি চোরাচালানে তারা পেয়েছিলেন ব্যাপক ‘খ্যাতি’। ছিলেন পৃথক এলাকার নিয়ন্ত্রক। ৫ আগস্টের পর থেকে তারা আছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাথে তাদের অস্ত্রও এখন অজানায়!
২ আগস্ট। সিলেটের মদিনা মার্কেট থেকে তেমুখী এলাকার দখল নিয়েছে শিক্ষার্থীরা। তাদের নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও সিআরটি টিম হিমশিম খাচ্ছিল।
ইতোমধ্যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলও ছেড়ে দিয়েছে সেখানকার ছাত্রলীগ। এ অবস্থায় পুলিশকে ‘ব্যাকআপ’ দিতে নামে নগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। ওই এলাকা হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নগর সভাপতি আফতাব হোসেন খানের পার্শ্ববর্তী এলাকা। সাবেক যুবলীগ নেতা আব্দুল হান্নানেরও অবস্থান ওই এলাকায়। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দুর্ধর্ষ ক্যাডারদের নিয়ে আফতাব ও হান্নান হাল ধরতে মাঠে নামেন সেদিন। হাতে হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাঠে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন ক্লান্ত, তখনই শিক্ষার্থীদের পিছু হটাতে তারা পুলিশের পাশে থেকে করে গুলিবর্ষণ। এতে ভয় পায় আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীরা। তারা তটস্থ হয়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা সশস্ত্র ক্যাডারদের গুলিবর্ষণের মুখে আখালিয়ার সুরমা আবাসিক এলাকার বিভিন্ন বাসাবাড়িতে আশ্রয় নেয়।
৩ আগস্ট। একইভাবে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। সড়কে আন্দোলনে টিকতে না পেরে সেদিনও শিক্ষার্থীরা বাসাবাড়িতে আশ্রয় নেয়। তবে ওইদিন বিকেল থেকে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। সশস্ত্র ক্যাডাররা সুরমা আবাসিক এলাকার বাসাবাড়িতেও হানা দিতে শুরু করে। একপর্যায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মেস ও বাসা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে ছুটে যায়।
সিলেট নগরের জিন্দাবাজার, বন্দরবাজারসহ কয়েকটি এলাকায় আগস্টের প্রথম থেকেই ছাত্র-জনতা তীব্র আন্দোলনে নামে। ধীরে ধীরে আন্দোলনের মাত্রা তীব্র হতে থাকে। রাজপথে বেশিসংখ্যক ছাত্র-জনতার উপস্থিতি থাকায় তাদের মোকাবিলায় থাকা পুলিশ দল হাঁপিয়ে ওঠে। দফায় দফায় সংঘর্ষ হলেও নগরের বন্দরবাজার এলাকা ছাত্র-জনতা দখলে রাখতে সক্ষম হয়। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেড়ে নগরের গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কগুলো মুক্ত করতে ৪ আগস্ট রাজপথে আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্বে নামে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা। ওইদিন নগরের কোর্ট পয়েন্টে ছাত্র-জনতা অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছিল। সকাল থেকে সেখানে ছাত্র-জনতার ব্যানারে অবস্থান নেন বিরোধী বলয়ের নেতাকর্মীরা। বেলা তখন ১১টা। অ্যাকশনে নেমেছে পুলিশ। তারা সক্ষম হয় ছাত্র-জনতাকে সরিয়ে দিতে। এর পরপরই কোর্ট পয়েন্ট দখলে নেয় যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ। তাদের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর হাতে এ দিন আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়। সেইদিন ফ্রন্টলাইনে ছিলেন সিলেটের দুর্ধর্ষ ক্যাডার পীযূষ কান্তি দে এবং জেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে এসে যোগ দেন সাবেক কাউন্সিলর আফতাব হোসেন খান ও আব্দুল হান্নানের নেতৃত্বে সশস্ত্র ক্যাডাররা। দুপুরের পরপরই তারা নগরের বন্দরবাজার, জিন্দাবাজারসহ আশপাশের এলাকায় অ্যাকশন শুরু করেন। তাদের কারো হাতে ছিল স্নাইপার, কারো হাতে একে ফোরটি সেভেনের মতো মরণাস্ত্র। ওইদিন মূলত ছিল সিলেটে টিকে থাকার লড়াই। পুলিশ মাঠে ছিল না। এ কারণে সশস্ত্র অস্ত্রবাজরা সিলেটে রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে। আন্দোলনে থাকা কয়েকশ’ ছাত্র-জনতা এ দিন আহত হন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগী ভর্তির জায়গা ছিল না।
৪ আগস্ট রাজপথে অস্ত্রবাজির কথা সিলেটের মানুষের মনে দাগ কাটে রয়েছে। এই অস্ত্রবাজির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির আলোচিত এই ৪ নেতাই।
৫ আগস্ট। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বিজয় আসে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের সাথে সাথে এই চার খলিফাও অদৃশ্য হয়ে যান। অদৃশ্য হয়ে যায় তাদের হাতে থাকা মারণাস্ত্রগুলোও। শান্ত হয়ে ওঠে নগর সিলেট। এরপর থেকে তাদের কাউকেই আর জনসমক্ষে দেখা যায়নি। তারা চলে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। বলা হচ্ছে, আলোচিত ৪ খলিফা আর দেশেও নেই। অন্য অনেক নেতার মতো তারাও আশ্রয় নিয়েছেন পার্শ্ববর্তী ভারতে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, তারা এখন অবস্থান করছেন সিলেটের পাশের শহর ভারতের শিলংয়ে। সেখানে থেকে সিলেটে থাকা তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন এবং পরিচিত বলয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন। এমনকি সীমান্তের কাছাকাছি এসে তারা পরিচিত জনের সাথে দরকারি মিটিংও করে যান মাঝেমধ্যে- এমন খবর ভেসে বেড়াচ্ছে সিলেটের বাতাসে। তবে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এদিকে ৪ খলিফার দেশের বাইরে যাওয়ার খবর ব্যাপক আলোচনায় আসলেও তাদের অস্ত্র উদ্ধার হয়নি এখনো। এ নিয়ে সিলেটজুড়ে চলছে তীব্র সমালোচনা।
পুলিশ জানিয়েছে, কিছুদিন আগে যৌথবাহিনীর একটি টিম নগরের পীরমহল্লা এলাকায় আফতাব হোসেন খানের বাসায় অভিযান চালিয়েছিল। সেখানে আগ্নেয়াস্ত্র না পেলেও বিপুল পরিমাণ ধারালো অস্ত্র পেয়েছে। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় আফতাব হোসেন খানকে একমাত্র আসামি করে এয়ারপোর্ট থানায় মামলা করা হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :