তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের অধীনে ৪৪২ কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে গৃহীত হয় ‘ইনোভেশন ডিজাইন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ একাডেমি’ বা ‘আইডিয়া’ প্রকল্প। অনুপ্রেরণার নামে প্রকল্প থেকে ২ হাজার ২৩২ জন নারী উদ্যোক্তাকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়।
অনুদানগ্রহীতাদের অনুদানপ্রাপ্তির তিন মাসের মধ্যে অনুদানের অর্থ খরচের হিসাব দেওয়ার বিধান থাকলেও ৮৭২ জন বা ৩৯ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা সেই ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন এখনো জমা দেননি। ফলে অনুদানের ৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা দিয়ে নারী উদ্যোক্তারা কী করেছেন, তার কোনো হিসাব নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের ৪২ জন সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী সুপারিশ করে ২৪৪ জন নারীকে অনুদানের অর্থ পাইয়ে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে মাত্র ১৪৯ জন প্রতিবেদন দাখিল করেন। অন্তত ২০টি সরকারি-বেসরকারি সংগঠন ও সংস্থার সুপারিশে বাছাই হন বাকি প্রায় ২ হাজার নারী।
স্টার্টআপ ও নারী উদ্যোক্তাদের অনুদানের নামে অর্থ হরিলুটের চিত্র তুলে ধরে গত ১২ ডিসেম্বর সংবাদ প্রকাশ করে দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ। এরপর নারী উদ্যোক্তাদের অনুদানের অনিয়মের আরও ভয়াবহ তথ্য আসতে থাকে রূপালী বাংলাদেশের কাছে। ২ হাজার ২৩২ নারী উদ্যোক্তাকে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়ায় এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ১১ কোটি ১৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অনুদান পাওয়ার পর ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন দাখিলের বাধ্যবাধকতা ছিল। অনুদানের অর্থ কীভাবে খরচ হয়েছে, সেটিই মূলত নারী উদ্যোক্তাদের জানাতে হয় এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে। প্রতিবেদনের নির্দিষ্ট ফরমে অনুদানপ্রাপ্তিতে ব্যবসায় কী প্রভাব পড়েছে; রেকর্ড খাতা, আয়-ব্যয়ের রসিদ ও ব্যাংক স্টেটমেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট প্ল্যাটফর্মের প্রধান বা দায়িত্বরত কর্মকর্তার মূল্যায়ন বা মন্তব্যের মতো তথ্য জানাতে হয়। তবে অনুদান প্রদানের দুই বছর পেরোলেও এখনো সেই প্রতিবেদন দেননি ৮৭২ নারী উদ্যোক্তা। ফলে ৫০ হাজার টাকা হিসাবে ৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা খরচের কোনো হিসাব নেই।
অনুসন্ধান বলছে, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নেতৃত্বে বিভাগের সাবেক কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা ভুয়া নারী উদ্যোক্তার নামে অর্থ প্রদান করেন। প্রকল্পের সাবেক একটি সূত্রের মতে, পলকের সুপারিশে ও নির্দেশনায় অন্তত ৭০০ নারী উদ্যোক্তাকে যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনুদান দেওয়া হয়। ফলে সাড়ে ৩ কোটি টাকার প্রায় পুরোটাই গেছে পলক সিন্ডিকেটের পকেটে। সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন প্রকল্পের তৎকালীন পরিচালক আলতাফ হোসেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। রাজনৈতিক বিবেচনা এবং ‘সুসম্পর্কের’ ভিত্তিতে অনুদান প্রদানের কারণে আইসিটি বিভাগের সাবেক প্রশাসন নারী উদ্যোক্তাদের থেকে প্রতিবেদন সংগ্রহ করতে পারেননি।
এই চিত্রের সত্যতা পাওয়া যায় অনুদানের সুপারিশ করা ব্যক্তি এবং প্ল্যাটফর্মের তালিকা দেখে। সর্বাধিক ২০টি করে সুপারিশ করেছেন সাবেক সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমু, নূরন্নবী চৌধুরী (ভোলা-৩), রাগেবুর আহসান রিপু (বগুড়া-৬), সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। ১০ জন করে নারীর জন্য সুপারিশ করেছেন সাবেক সংসদ সদস্য আমিরুল আলম মিলন (বাগেরহাট ৪), মাশরাফী বিন মর্তুজা (নড়াইল-২), শেখ হেলাল উদ্দিন (বাগেরহাট-১), হাবিবুন নাহার (বাগেরহাট-৩)।
বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সুপারিশ করেছেন ১১ জন নারীর জন্য। সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করীম এবং পলক নিজে সরাসরি সুপারিশ করেছেন পাঁচজন নারীর জন্য।
রাজনীতিকদের তুলনায় পিছিয়ে ছিল না বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্ল্যাটফর্ম। সর্বাধিক ৯৬৩ জন নারী উদ্যোক্তা অনুদান পেয়েছেন পলকের ঘনিষ্ঠ ও নারী উদ্যোক্তাদের অনুদান প্রদানের মাস্টারমাইন্ড নাসিমা আক্তার নিশার ‘উইমেন অ্যান্ড ইকমার্স ফোরাম (উই)’ থেকে।
ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন জমা না দেওয়া সর্বাধিক নারীও উইয়ের। উই থেকে অনুদান পাওয়া ৪৪৩ নারী ওই প্রতিবেদন এখনো জমা দেননি। ইকমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাবের মাধ্যমে অনুদান পান ৬০ নারী উদ্যোক্তা, যাদের ৩১ জনই এখনো প্রতিবেদন দেননি। ৪৫ জন নারী উদ্যোক্তা বাছাই হয় ‘পল্লীশ্রী উন্নয়ন সংস্থা’ থেকে। এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা পলকের সাবেক এপিএস রনজিত কুমার। ২৯ জন নারী উদ্যোক্তা বাছাই হয় ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ফ্যাশন ডিজাইনারস অব বাংলাদেশ’ থেকে। এই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মানতাশা আহমেদ সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের ছেলে শাহেদ মুহিতের সহধর্মিণী। ১৪৭ নারীকে অনুদান দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ উদ্যোক্তা সংস্থার মাধ্যমে। তাদের মধ্যে ১৩৬ জন নারীই প্রতিবেদন দেননি। প্রকল্প কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না এই সংস্থার প্রতিনিধি মানিক উজ্জামান।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিয়া প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক নজরুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নারী উদ্যোক্তারা অনুদানের জন্য কীভাবে নির্বাচিত হবেন, কোন প্ল্যাটফর্মের মনোনয়নে অথবা নিজস্ব আবেদনে, সে বিষয়ে প্রকল্পের ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। এটাই ডিপিপির দুর্বল দিক। আর এটিকেই কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। তবে আমরা এখন উদ্যোগ নিয়েছি বিষয়টিকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসার।
আপনার মতামত লিখুন :