ঢাকা শুক্রবার, ২১ মার্চ, ২০২৫

ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক চায় অপারেটরগুলো

শাওন সোলায়মান
প্রকাশিত: মার্চ ২১, ২০২৫, ১২:৫৫ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ইন্টারনেট সঞ্চালনে ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপনের দায়িত্ব ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) অপারেটরদের। তবে এই ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক এখন নিজেরাই বসাতে চাচ্ছে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরগুলো (এমএনও)। এ জন্য ডার্ক কোর অপটিক্যাল ফাইবার, ডেন্স ওয়েভলেন্থ ডিভিশন মাল্টিপ্লেক্সিং (ডিডব্লিউডিএম) যন্ত্রাংশ বসানোর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র অনুমতি চাইছে তারা। 

সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) নিজেদের এসব দাবি জানায় এমএনও’গুলো। তবে এমএনও’র আবদারে আপত্তি এনটিটিএন’দের। এনটিটিএন’গুলোর দাবি, লাইসেন্স নিয়ে বিনিয়োগ করে যে বাজার এবং ইন্টারনেট সঞ্চালন অবকাঠামো তারা তৈরি করেছে, সেগুলো নষ্ট হবে এমএনও’র প্রস্তাব মেনে নিলে। এমন প্রেক্ষাপটে সবদিক বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্তের পথে হাঁটছে বিটিআরসি।

২০০৮ সালে এনটিটিএন লাইসেন্সিং অ্যান্ড গাইডলাইনের আলোকে এনটিটিএন লাইসেন্স দিতে শুরু করে বিটিআরসি। এখন পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি খাতের তিনটি করে প্রতিষ্ঠান এই লাইসেন্স পেয়েছে। এগুলো হলো- সরকারি খাতের বাংলাদেশ রেলওয়ে (বিআর), পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ কোম্পানি (পিজিসিবি), বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) এবং বেসরকারি খাতের ফাইবার অ্যাট হোম, সামিট কমিউনিকেশন্স এবং বাহন লিমিটেড। বেসরকারি খাতের আরও একটি প্রতিষ্ঠানকে এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। 

এনটিটিএন অপারেটররা দেশজুড়ে ইন্টারনেট সঞ্চালন নেটওয়ার্ক তৈরি করে যার মধ্যে অপটিক্যাল ফাইবার এবং ডিডব্লিউডিএম মেশিন বসানো অন্তর্ভুক্ত। গাইডলাইন অনুযায়ী, ডিডব্লিউডিএম যন্ত্র দেশে আমদানি করার অনুমতিও আছে শুধু এনটিটিএন’দের। 

তবে প্রায় বছরখানেক আগে বিটিআরসি ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার শেয়ারিং গাইডলাইন’ এ পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিলে অপটিক্যাল ফাইবার বসানোর অনুমতি পেতে তোড়জোড় শুরু করে মোবাইল অপারেটরগুলো। পাশাপাশি বর্তমানে তারা ডিডব্লিউডিএম মেশিন আমদানি এবং স্থাপনে আগ্রহের কথা জানিয়েছে বিটিআরসি’কে। 

এই যন্ত্রের মাধ্যমে ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে আলো ব্যবহার করে একটি ফাইবারেই একাধিক ডাটা স্ট্রিম একসঙ্গে পাঠিয়ে নেটওয়ার্কের ব্যান্ডউইথ বৃদ্ধি করা যায়। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একজন নেটওয়ার্ক বিশেষজ্ঞ বলেন, রাউটার দিয়ে এক জোড়া কেব্লের মধ্যে ১০০ গিগাবিট (জিবি) ব্যান্ডউইথ ট্রান্সমিট করা গেলে, ডিডব্লিউডিএম দিয়ে একটি কেব্লেই টেরাবিট পরিমাণ ব্যান্ডউইথ ট্রান্সমিট করা যায়। 

একটা রাউটারের দাম শুরু হয় ৩ লাখ টাকা থেকে, আর ডিডব্লিউডিএম এর দাম কমপক্ষে ২ কোটি টাকা। মোবাইল অপারেটরগুলো নিজেদের কেব্লে এসব ডিভাইস যুক্ত করে নিজেদের মতো ব্যান্ডউইথ ট্রান্সমিট করতে পারবে। এমনটা হলে এনটিটিএন’দের আসলে আর ব্যবসা থাকে না। 

গত বুধবার এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলোর উপস্থিতিতে বিটিআরসি’তে আয়োজিত এক সভায় ফাইবার এবং ডিডব্লিউডিএম যন্ত্রাংশ স্থাপনের আগ্রহের কথা জানায় এমএনও’গুলো। কমিশনের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন্স (ইঅ্যান্ডও) বিভাগের কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইকবাল আহমেদ সভায় সভাপতিত্ব করেন। 

সভায় সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র রূপালী বাংলাদেশকে মোবাইল অপারেটরগুলোর প্রস্তাবনাগুলো নিশ্চিত করেন। সূত্রের মতে, ‘লাস্ট মাইল কানেক্টিভিটি’র কারণ দেখিয়ে ডার্ক কোর ফাইবার বসানোর অনুমতি চেয়েছে অপারেটরগুলো। এনটিটিএন অপারেটরদের ফাইবার নেটওয়ার্ক থেকে নিজেদের টাওয়ার পর্যন্ত এবং একটি টাওয়ারের পার্শ্ববর্তী আরেকটি টাওয়ারের মধ্যেকার অংশকে ‘লাস্ট মাইল’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে মোবাইল অপারেটররা। 

এ ছাড়াও এনটিটিএন’দের থেকে আরও বেশি ডার্ক কোর ফাইবার চাচ্ছে তারা। দেশীয় টেলিকম খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এরইমধ্যে এনটিটিএন অপারেটর সামিট কমিউনিকেশন্সের থেকে ২০০ কিলোমিটারের (কিমি.) বেশি ডার্ক কোর ফাইবার নিয়েছে বাংলালিংক। 

বিটিসিএল এবং বাহনের থেকে যথাক্রমে প্রায় ৬ হাজার এবং ৩ হাজার কিমি. করে কেব্ল নেওয়া আছে গ্রামীণফোনের। পাশাপাশি পিজিসিবি এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এনটিটিএন অপারেটর হিসেবে ফাইবার স্থাপন করলেও, ডিডব্লিউডিএম যন্ত্র বসানোর মতো কারিগরি সক্ষমতা নেই তাদের। এদের ফাইবার লিজ নেওয়া আছে বিভিন্ন এমএনও’র। এই কারণে ডিডব্লিউডিএম বসাতে চাচ্ছে এমএনও’রা। 

পাশাপাশি এমএনও’দের নিজস্ব ফাইবার নেটওয়ার্কে ডিডব্লিউডিম যন্ত্র বসাতে চাচ্ছে। যেমন গ্রামীণফোনের ৩ হাজার কিলোমিটারের (কিমি) বেশি নিজস্ব ফাইবার নেটওয়ার্ক আছে, রবি’র আছে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কিমি.। নিজেদের এসব নেটওয়ার্কে ডিডব্লিউডিএম বসাতে চাচ্ছে মোবাইল অপারটেরগুলো। সবমিলিয়ে নিজেদের ডার্ক কোর ফাইবারে ডিডব্লিউডিএম যন্ত্রের মাধ্যমে নিজেদের মতো ব্যান্ডউইথ ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চাইছে মোবাইল অপারেটরগুলো। 

তবে এমএনও’দের এসব সেবা দেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তাদের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে বেসরকারি খাতের এনটিটিএন অপারেটররা। এনটিটিএন অপারেটর বাহন লিমিটেডের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির চিফ অপারেটিং অফিসার রাশেদ আমিন বিদ্যুত সভায় নিজ উপস্থাপনায় জানান যে, মোবাইল অপারেটরদের তিনটি সুনির্দিষ্ট সেবা প্রদানের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক সঞ্চালন ব্যবস্থার পূর্ণ সেবা দিচ্ছে বাহন। 

এর মধ্যে আছে ডিডব্লিউডিএমসহ ডার্ক কোর ফাইবার দেওয়া, ‘অ্যাকটিভ রিং’এর মাধ্যমে শক্তিশালী কিন্তু সহজ কানেক্টিভিটি এবং ‘এগ্রিগেশন মডেল’ এ স্বচ্ছ ও সাশ্রয়ী মূল্যের সেবা। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিটিআরসি’তে অনুষ্ঠিত সভার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি রাশেদ আমিন বিদ্যুত। 

তবে বাহনের সেবাগুলো ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এমএনও’দের বাহন ডার্ক কোর ফাইবার দিচ্ছে। পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্নভাবে উচ্চক্ষমতার ব্যান্ডউইথ সরবরাহে তাদের ‘অ্যাকটিভ রিং’ মডেলে ফাইবার নেটওয়ার্ক করে দেয় বাহন। এনটিটিএন ‘ব্যাকহল’ (মোবাইল টাওয়ার থেকে মূল ট্রান্সমিশন কেব্লে যুক্ত হওয়া) দিচ্ছি, তাই তাদের নিজস্ব ‘ব্যাকহল’ লাগছে না। 

ফলে সেবাগুলো স্বচ্ছ ও সাশ্রয়ী হচ্ছে, যেটাকে ‘এগ্রিগেশন মডেল’ বলছি। এনটিটিএন অপারেটররা এই সেবাগুলো দিচ্ছে এবং দিতে সক্ষম তখন এমএনও’দের আর নিজস্ব ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার অবকাশ নেই। এই কাজটা করার জন্যই এনটিটিএন’দের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে আর এনটিটিএন’রা বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে।

এ বিষয়ে সামিটে কমিউনিকেশন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আরিফ ইসলাম বলেন, ডার্ক ফাইবার যেহেতু মোবাইল অপারেটরদের অনেক দিনের চাহিদা, সেহেতু মন্ত্রণালয় এবং বিটিআরসি একটা গাইডলাইন করে আমরা এটা দিতে পারি। 

তবে  ফাইবার এবং ডিডব্লিউডিএম বসাতে এমএনও’দের যে খরচ হবে, এনটিটিএন’রা এর থেকে কমে ব্যান্ডউইথ দিতে সক্ষম কারণ আমরা পুরো ইন্ডাস্ট্রির জন্য নেটওয়ার্ক তৈরি করছি। নিজেরা বসানোর বদলে এমএনও’দের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এনটিটিএন’দের থেকে কমে ব্যান্ডউইথ নেওয়ার সম্ভাবনাকে বিবেচনার অনুরোধ থাকবে আমাদের। 

এ বিষয়ে গ্রামীণফোনের হেড অব কমিউনিকেশন্স শারফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, এমএনওগুলো ইতোমধ্যে এনটিটিএন অপারেটরদের থেকে অনেক পরিমাণ ডার্ক ফাইবার ভাড়া নিয়েছে, যা মূলত পাবলিক এমটিটিএন প্রদানকারীদের কাছ থেকে। তবে ট্রাফিক চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিডব্লিউডিএম সমাধান ব্যবহার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। 

বর্তমানে বিটিআরসি নিষেধাজ্ঞার কারণে এমএনও এই ভাড়া নেওয়া ফাইবারে ডিডব্লিউডিএম ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে তাদের প্রাইভেট এনটিটিএন প্রদানকারীদের কাছ থেকে ব্যান্ডউইথ কিনতে হচ্ছে। পাশাপাশি সড়ক নির্মাণকাজের কারণে বার্ষিকভাবে ফাইবার কাটা বাড়ছে। 

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে নতুন নেটওয়ার্ক রুট তৈরি এবং নির্দিষ্ট সেকশনে ট্রাফিক পুনঃনির্দেশনের ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। শারফুদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, এমএনও’রা ডিডব্লিউডিএম নিষেধাজ্ঞাকে একটি প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছে, যা দেশের ডিজিটাল রূপান্তর ত্বরান্বিত করতে বাধা সৃষ্টি করছে। 

এ ছাড়া এনটিটিএন সেবা খরচ লিজড ক্যাপাসিটির তুলনায় অত্যন্ত বেশি। আবার পাবলিক এনটিটিএনগুলো যেমন বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং পিজিসিবি কেবল তাদের নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে কাজ করে এবং এমএনও সাইটে ‘লাস্ট মাইল’ সংযোগ প্রদান করতে পারে না। 

ফলে অতিরিক্ত ডার্ক ফাইবার অন্যান্য এনটিটিএন থেকে প্রয়োজন হয়, যা সেবা গ্রহণে বড় বাধা সৃষ্টি করে। এমন প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রত্যাশা যে, ডার্ক ফাইবারে প্রযুক্তিগত নিরপেক্ষতা অনুমোদন করে লাস্ট মাইল ফাইবার স্থাপনের সুযোগ দেওয়া হবে এবং ডিডব্লিউডিএম নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে।

তবে এমএনও এবং এনটিটিএন’দের মুখোমুখি প্রস্তাবনা নিয়ে জানতে চাইলে বিটিআরসি’র কমিশনার (ইঅ্যান্ডও) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইকবাল আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে গত বুধবার বলেন, আজ (বুধবার) যে সভা হয়েছে সেটা সিদ্ধান্তের সভা হয়নি বরং আলোচনা ও পরামর্শমূলক ছিল। 

মাসখানেক যাবত এমএনও এবং এনটিটিএন’দের এ বিষয়ক কথাগুলো কমিশন শুনছে। টেলিযোগাযোগ খাতের সংস্কারে একটি কমিটি (নেটওয়ার্ক বিন্যাস এবং লাইসেন্সিং ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিটি) কাজ করছে। কমিটির সুপারিশের আলোকেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।