ঢাকা শুক্রবার, ২১ মার্চ, ২০২৫

ধনকুবের ইকবাল আহমেদকে নিয়ে ব্রিটেনে তোলপাড়

জুবায়ের আহমেদ, লন্ডন
প্রকাশিত: মার্চ ২১, ২০২৫, ০১:১৫ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ব্রিটেনের অন্যতম শীর্ষ ধনী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সিলেটের ইকবাল আহমেদকে নিয়ে গতকাল দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রচারিত সংবাদে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বখ্যাত সি মার্ক গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ইকবাল আহমেদ ব্রিটেনের প্রভাবশালী ও ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছেন দীর্ঘদিন যাবত। 

তার বিরুদ্ধে এমন সংবাদে অবাক হয়েছেন বাংলাদেশি কমিউনিটির একাধিক মানুষ। তারা বলেন, মানুষ যত বড় হয় তাদের দুর্নীতির পরিমাণ বেশি হয়। এত সম্পদের পরেও দেশের সম্পদ লুট করার কি প্রয়োজন। এ ব্যাপারে কথা বলতে এই প্রতিবেদক তার মুঠোফোনে বারবার চেষ্টা করলে তিনি তা ধরেননি।

জানা যায়, গত ১৯ মার্চ দৈনিক রূপালী বাংলাদেশে ‘বিতর্কিত ইকবালের নিয়ন্ত্রণে এনআরবি ব্যাংক’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় ব্রিটেনের কমিউনিটিতে। আইনজীবী শাহজাহান আলি বলেন, আমরা এর পূর্বেও বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিলাম। 

আমাদের জানামতে, ইকবাল আহমেদ দুর্নীতির দায়ে ২০১৫ সালে ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি থেকে আজীবন বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। কিন্তু বিষয়টি অবাক করার মতো ছিল যে, তারা সেটা সেভাবে প্রকাশ করতে দেয়নি। 

ম্যানচেস্টারের বাসিন্দা আহমেদ আফিক বলেন, ইকবাল আহমেদ আমাদের এলাকার বাসিন্দা। সংবাদটি আমাদের কিছুটা হলেও বিচলিত করেছে। আমরা ইকবাল আহমেদকে নিয়ে গর্ব করি। ব্রিটেনের মাটিতে ব্যবসাসফল একজন মানুষ দেশের এবং এলাকার নানা সামাজিক কাজে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এলাকায় তার নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তিনিও দুর্নীতির বাইরে নন এ কথা আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। 

উল্লেখ্য,  ১৭ মার্চ, ২০২৫ শেষে তারা যথাক্রমে ৩.৮০ শতাংশ, ১.৫১ শতাংশ ও ২.১৩ শতাংশ শেয়ারের অংশীদার। এ ছাড়া সিমার্ক (বিডি) লিমিটেড, আইবিসিও লিমিটেড, আইবিসিও এন্টারপ্রাইজ, আইবিসিও ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ম্যানরু ইন্টারন্যাশনাল ও ম্যানরু শপিং সিটিতেও তাঁদের যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে। 

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, যুক্তরাজ্যে একাধিক কোম্পানি রয়েছে তাদের। এর মধ্যে রয়েছে সিমার্ক পিএলসি, আইবিসিও হোল্ডিংস, এমএআই ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিংস, ভার্মিলিয়ন গ্রুপ লিমিটেড, ফ্লাইং ইউনিকর্ন, ওপেনশ হোল্ডিংস লিমিটেড, আইবিসিও লিমিটেড, ইউকেবিসিসিআই, ইউকে বাংলাদেশ ক্যাটালিস্টস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং নিউ ইস্ট ম্যানচেস্টার লিমিটেড। এই কোম্পানিগুলো মূলত রিয়েল এস্টেট, বিনিয়োগ ও আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত।

শেখ রেহানাসহ শেখ পরিবারের অন্য সদস্যদের নামেও এই কোম্পানিগুলোতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এ ছাড়া লন্ডন-ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সম্পদের মালিকানা গড়ে তুলেছেন। শুধু লন্ডনেই তার প্রায় দুই ডজন বাড়ি ও অত্যাধুনিক প্রপার্টি রয়েছে। 

সূত্র জানায়, বিগত এক দশক ধরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে নিজের অবস্থান গড়ে তোলেন ইকবাল। তার ফেসবুক প্রফাইলজুড়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে অসংখ্য ছবি শেয়ার করা হতো, যা তাকে ‘হাসিনা বিশ্বস্ত’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। যদিও ৫ আগস্টে হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ফেসবুক থেকে ছবিগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। 

সূত্র আরও জানায়, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার শীর্ষ ২০ জন অর্থদাতার মধ্যে ওবিইও একজন। পতিত সরকারের আমলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সিমার্ক গ্রুপের আড়ালে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের অর্থপাচারের ক্যারিয়ার (বাহক) হিসেবেও কাজ করতেন ওবিই। ইকবাল সিমার্ক গ্রুপের প্রধান ব্যবসা হলো মাছ রপ্তানি। মাছের আড়ালে তিনি বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস ও সোনা চোরাচালান করতেন।

উল্লেখ্য, ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে সিলেটের ওসমানীনগরে জন্ম ইকবাল আহমেদের। ১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি আসেন ব্রিটেনে। ওয়েস্টমিনিস্টারের সিটি কলেজে পড়ালেখা করা ইকবাল আহমেদ কয়েক বছর পর ওল্ডহামে অবস্থিত তার পরিবারের ব্যবসায় যোগদান করেন। পরিধি বাড়াতে তার ভাই কামাল ও বিলাল ব্যবসায়ে যোগ দেন। 

উত্থানের কাহিনি: স্বল্প সময়েই সিমার্ক পিএলসি হিমায়িত মৎস্য ও চিংড়ি আমদানির ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে এসব পণ্য সরবরাহের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। এভাবেই বাংলাদেশের হিমায়িত মৎস্য ও সামুদ্রিক মাছ বিদেশের বাজার দখলের সুযোগ পায় এবং বাংলাদেশও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সন্ধান লাভ করে। 

বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ সামুদ্রিক আর বাগদা চিংড়ি আমদানি করতে করতে চিংড়ি-সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান, কারখানা ও রেস্টুরেন্ট দাঁড় করিয়ে ফেলেন। সেই সঙ্গে শুরু করেন মোড়কজাত চিংড়ি রপ্তানি। তারই চেষ্টায় সেই ২০ পাউন্ড পুঁজির ব্যবসা ২০০৮ সালে ঠেকে ১২ কোটি ইউরোতে।

শীর্ষ ধনীর তালিকায়: ব্রিটেনভিত্তিক প্রভাবশালী সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইকবাল আহমেদ ব্রিটেনের এক হাজার ধনীর তালিকায় ৪৬৬তম স্থান পেয়েছেন। গত এক বছরে তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২০ মিলিয়ন পাউন্ড বেড়ে হয়েছে ২০৫ মিলিয়ন পাউন্ড। 

ইকবাল আহমেদ ওবিই ২০০৬ সালে সর্বপ্রথম বিখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী সানডে টাইমসের তালিকায় ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধনী ব্যক্তি হিসেবে উঠে আসেন। ব্রিটেনের শীর্ষ ধনীর তালিকায় সে বছর ৫১১ নম্বর স্থান দখল করেন ইকবাল আহমেদ। তার সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করা হয় ১১০ মিলিয়ন পাউন্ড। এরপর ২০০৯ সালে এশিয়ার ২০ ধনীর তালিকায় উঠে আসেন সফল ব্যবসায়ী ইকবাল আহমেদ।