নির্বাচনে অংশ নিতে পারে আওয়ামী লীগ!

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২৫, ১২:২৭ এএম

নির্বাচনে অংশ নিতে পারে আওয়ামী লীগ!

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সংস্কারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পুনরায় প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর নানা মন্তব্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সংস্কার ও সংশোধন হয়ে রাজনৈতিক মাঠে ফিরে আসতে তদবির রয়েছে বিভিন্ন মহলের। তবে নেতৃত্বে রদবদলের জন্য রাজনৈতিক চাপও রয়েছে দলটির ওপর। 

এদিকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) প্রেসিডেন্ট ও সিইও কমফোর্ট ইরোর সঙ্গে আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন। তবে দলটির যেসব নেতার বিরুদ্ধে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বাংলাদেশের আদালতে বিচারের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

অন্যদিকে হত্যা-লুটপাটে জড়িত নয় এমন কারও নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বাধা নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর উত্তরার দক্ষিণখানে ফায়দাবাদ মধ্যপাড়া হাজি শুকুর আলী মাদ্রাসাসংলগ্ন মাঠে দুস্থদের মধ্যে ঈদসামগ্রী বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি এই মন্তব্য করেন।

রিজভী বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে কথা হচ্ছে, কিন্তু বিচার নিয়ে কথা হচ্ছে না। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচারের পর আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। আর জনগণ ক্ষমা করলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এর আগে সরকারের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে চায় না। তাছাড়া বিএনপির নেতারাও বলে আসছেন, তারা কোনো দল নিষিদ্ধের পক্ষে নন। জনগণ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।

এ বিষয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদও বলেছিলেন, যারা আওয়ামী লীগ করেছেন, কিন্তু কোনো প্রকার অন্যায় এবং গণহত্যা কিংবা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নন, তারা ক্ষমা চেয়ে আবার মূলধারায় (মেইনস্ট্রিম) স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেন এবং সেই জায়গা থেকে যদি কেউ স্থানীয় সরকার নির্বাচন করেন, তাতে কোনো বাধা নেই।

সরকারপ্রধান ও দেশের অন্যতম প্রধান দলের নেতার এমন মন্তব্যের সঙ্গে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ রয়েছে। তবে সার্বিক পরিস্থিতিতে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের পুনরায় প্রত্যাবর্তন এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সম্ভাবনার পালে হাওয়া লেগেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।   

এদিকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার বিগত আট মাসে অনেকবার আন্দোলন-কর্মসূচির ঘোষণা দিলেও রাজপথে খুঁজে পাওয়া যায়নি আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মীকে। দলের পক্ষ থেকে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের নতুন কর্মসূচি সফল হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে জনমনে।

সরকার, রাজনৈতিক দল ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে নানা প্রশ্ন সামনে রেখে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে আওয়ামী লীগ; যদিও এমন আশা কল্পনাতীত বলেই ভাবছে কিছু রাজনৈতিক দল। তাদের দাবি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি চক্র আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফেরাতে চক্রান্ত করছে। 

এদিকে দেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বদলে বিভিন্ন পক্ষের রাজনৈতিক চাপ বা পরামর্শ উপেক্ষা করেই এগোতে চাইছে দলটি। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে শেখ হাসিনার জায়গা পরিবর্তনের কোনো চিন্তা নেই দলটির ভেতরে। 

দেশে-বিদেশে পালিয়ে বা আত্মগোপনে থাকা দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। তাদের দাবি, এবার আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে ক্ষমা চাইবে এবং সংশোধন হয়ে ফিরে আসবে।  

এ বিষয়ে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা এনায়েত হোসেন লিটন বলেন, ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীরা যেভাবে নির্যাতিত হয়েছে, স্বাধীনতার পর এত অত্যাচারিত কখনো হয়নি। তবে এবার যদি আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ায়, তাহলে তৃণমূলের কারণেই সেটি হবে।

তবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দলের ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে দলটির ভেতরেও রয়েছে অনিশ্চয়তা। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনকে বড় ধাক্কা হিসেবে দেখছেন দলটির নেতাদের অনেকেই। জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যা ও নির্বিচারে গুলির একাধিক বড় অভিযান হয়েছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ও তদারকিতে।

তবে এত কিছুর পরও দলটির সংগঠিত হওয়ার চেষ্টার বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে সত্যি, তবে তারা আর রাজনীতিতে ফিরতে পারবে না, বাংলাদেশের বাস্তবতায় সেটা বলা যায় না।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আজকের বাস্তবতা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর একধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলেছে; তাদের মধ্যে মানসিক দুর্বলতা কাজ করছে। এমন পটভূমিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শিগ্গিরই দলে দলে রাস্তায় নেমে আসবেন, এখনো সেই মনোবল ও সাহস তাদের হয়নি। তবে বিষয়টি এখানেই থেমে থাকবে বলে মনে করেন না বিশ্লেষকেরা।
দলটির পালিয়ে থাকা নেতাদের অনেকে জানিয়েছেন, দলের নেতৃত্ব বদলের বিষয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে তাদের ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়ছে।

দেশের দক্ষিণবঙ্গের বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখনো সক্রিয়ভাবে সব রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রয়েছে। সেজন্য তারা প্রকাশ্যে এলেই বিভিন্ন দলের কর্মীদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এর সঙ্গে রয়েছে গ্রেপ্তার আতঙ্ক। এই প্রতিকূল পরিবেশে তাদের প্রকাশ্যে আসার সুযোগ নেই।

দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পর এটি নেতাকর্মীদের কাছে ভিন্ন এক নতুন বাস্তবতা। তবে নেতাকর্মীদের ধারণা, পাঁচ বছর পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব শিথিল হবে। ১০ বছর পরে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াবে, কিন্তু সেই আওয়ামী লীগে শেখ পরিবার মাইনাস হতে পারে। 

খুলনা আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত পক্ষগুলো থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বদলের চাপ রয়েছে। তিনি বলেন, রাজনীতিতে শেখ হাসিনা ও তার পরিবার অনেক ভুল করেছে, যার রেশ টানছেন তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

রংপুর অঞ্চলের আওয়ামী লীগের এক নেতা জানিয়েছেন, জীবন বাঁচাতে দেশের ভেতরে পালিয়ে আছি। রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া ভুল ছিল আওয়ামী লীগের মন্তব্য করে তিনি বলেন, তাদের দলে ছিল সুবিধাবাদীদের ভিড়। ত্যাগী নেতাকর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলেন।

আওয়ামী লীগের আরেক নেতা বলেন, ক্ষমতায় থাকার সময়ই বিরাজনীতিকীকরণের কারণে শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতৃত্ব রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। দলও দুর্বল হয়েছে। এসব কারণে ভয়াবহ পরিণতি দেখতে হয়েছে তাদের এবং এখন দল অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। পতনের পর দলের নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে তৃণমূলের পালিয়ে থাকা নেতাকর্মীদের অনেকের।

আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব বদলের চিন্তা যেমন নেই। একইভাবে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা মনে করেন, গণহত্যাসহ যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সে জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করলে বা ক্ষমা চাইলে তাদের দলের ক্ষতি বেশি হবে। নিজেদের আলোচনায় দলের অনেকের মধ্যে অনুশোচনা উঠে এলেও তা প্রকাশ করতে চান না তারা। তবে সে সময় পরিস্থিতি সামলাতে আওয়ামী লীগ সরকারের পদক্ষেপ বা ভূমিকার পক্ষেই যুক্তি তুলে ধরছেন দলটির নেতাদের বড় অংশ। তারা তাদের সরকারের পতনের পেছনে ‘ষড়যন্ত্র’তত্ত্বকেই হাজির করছেন।

একজন রাজনীতিবিদ জানান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ৫৪ বছরে কোনো রাজনৈতিক দলের তাদের নেতিবাচক কোনো কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমা চাওয়ার নজির নেই। তাই রাজনীতির মাঠে ফিরতে আওয়ামী লীগ ক্ষমা স্বীকার করবে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। 

দেশে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে ভয় কাজ করছে। তারা মনে করেন, দল নিষিদ্ধ হলে আইনগত দিক থেকে তাদের তৎপরতায় বাধা দেওয়া সহজ হবে সরকারের জন্য। কিন্তু বিদেশে থাকা দলটির নেতারা মনে করেন, এতে তাদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি বাড়বে। আন্তর্জাতিক মহলেও তাদের জন্য সুবিধা হবে।

তবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করলে তার প্রতিক্রিয়া নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে। দেশে থাকা নেতারা মনে করেন, দল নিষিদ্ধ হলে আইনগত দিক থেকে তাদের তৎপরতায় বাধা দেওয়া সহজ হবে সরকারের জন্য। কিন্তু বিদেশে থাকা নেতারা মনে করেন, এতে তাদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি বাড়বে। 

আন্তর্জাতিক মহলেও তাদের জন্য সুবিধা হবে।
তবে নিষিদ্ধ করা না-করা নিয়ে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও রাজনীতি ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো মনে করছে, নিষিদ্ধ না হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণও অসম্ভব নয়।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!