এক মাহতাবে হতবাক সিলেট!

সালমান ফরিদ, সিলেট

প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২৫, ১২:৪৭ এএম

এক মাহতাবে হতবাক সিলেট!

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সিলেটের আলোচিত চরিত্র ব্যবসায়ী মাহতাবুর রহমান নাসির। বাড়ি সিলেটে হলেও তার ব্যবসা বিশ্বব্যাপী। গত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিটি টার্মেই তিনি নিয়েছেন বিশেষ সুবিধা। একাধিকবার ছিলেন সিআইপি। আওয়ামী সরকারের তহবিলের অন্যতম যোগানদাতা তিনি।

হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠার পর দেশে তিনি নতুন করে আলোচনায় নাম লেখান। তার কর্মকাণ্ডে হতবাক সিলেটও। ব্যবসা, চিকিৎসা ও মানবসেবার আড়ালে দেশবিরোধী ও অবৈধ কাজে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পর তোলপাড় চলছে খোদ সিলেটে।

মাহতাবুর রহমান নাসির প্রথম আলোচনায় আসেন সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার চারখাই ইউনিয়নের নোয়াগ্রাম নামক গ্রামে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণের মধ্য দিয়ে। প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে অজোপাড়াগাঁয়ে তিনি গড়ে তোলেন প্রাসাদসম অট্টালিকা। 

সেই বাড়ি ছিল সিলেটবাসীর জন্য এক বিস্ময়ের নাম। দূর-দূরান্ত থেকে দেখতে যেত লোকজন। এমনকি বিদেশিরাও আসতেন বাড়িটি দেখে যাওয়ার জন্য। বিশ্বের সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে গড়ে তোলা এই ভবনের পরে তিনি সিলেট শহরের টিলাগড় এলাকায় নির্মাণ করেন আরেক অত্যাধুনিক প্রাসাদসম ‘কাজী প্যালেস’। 

এই বাড়ি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৫০০ কোটি টাকা। দুটি প্রাসাদের সবকিছুই বিদেশি। এমনকি নির্মাণশ্রমিকও ছিল বিদেশি। বিষয়টি দ্বিতীয়বারের মতো তাকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসে। এরপরই তিনি সিলেট শহরে গড়ে তোলেন একটি হাসপাতাল। 

প্রথমে সবার জন্য কম খরচে অথচ আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কথা বললেও পরবর্তিতে সেটি কেবলই বাণিজ্যিক হাসপাতালে পরিণত করেন। অভিযোগ ওঠে, বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণের পরে হাসপাতাল নির্মাণের অজুহাতে তিনি হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। 

মূলত অর্থ পাচারের জন্যই চিকিৎসাসেবা বেছে নেন। এর মাধ্যমে বিনা বাধায় তিনি বিদেশে অর্থ পাচার করতে পেরেছিলেন। এরপরে নিজের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে দুবাই-সিলেটে পৃথকভাবে রাজকীয় বিয়ে ও বিবাহ-উত্তর সংবর্ধনার আয়োজন করে ব্যাপক আলোচিত হন। এমন মহাজমকালো বিয়ের আয়োজন আগে কখনো দেখেনি সিলেট। 

২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি দুবাই শহরের পাঁচ তারকা আটলান্টিস দ্য পাম হোটেলে আয়োজন করেন মেয়ে সামিয়া রহমানের বিয়ে। বর বাংলাদেশের অন্যতম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা কামালের ছেলে তানভীর আহমেদ। 

বিয়েতে বাংলাদেশ থেকে দুবাই উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রায় ১০০ বরযাত্রীর বহর। সেখানে তিন দিন ধরে সেই বিয়ের আয়োজনে অতিথি ছিলেন অন্তত ৭০টি দেশের ৯ হাজার মানুষ। আমিরি-বাদশাহি আয়োজনের এই বিয়ের খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তখন ব্যাপক আলোচিত হয়।

দুবাইয়ে বিয়ের মূল অনুষ্ঠানের পর চায়ের দেশ সিলেটে জমকালো আয়োজন করেন বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের। ২১ জানুয়ারি সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসংলগ্ন পাঁচ তারকা হোটেল গ্র্যান্ড সিলেটে বিবাহত্তোর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন সেই সময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ, দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরসহ রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে তিনি আলোচনায় এসেছেন অবৈধ হুন্ডি ব্যবসার শীর্ষ কারবারির তালিকায় নিজের নাম উঠে আসার পর।
বলা হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশে পারফিউম ব্যবসার আড়ালে সবচেয়ে বড় হুন্ডি তৎপরতায় জড়িত। এমনটা প্রমাণও পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থাটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) অনুসন্ধান চালিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের তথ্য পায়।

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ব্যবসায়ী মাহতাবুর রহমান নাসির গোল্ডেন ভিসার আওতায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) বসবাস করেন। তার পরিচিতি গত আওয়ামী সরকারের আমলে হলেও উত্থান সেই এরশাদের সামরিক শাসনামলে। এরশাদের সঙ্গে ছিল তার বেশ ঘনিষ্ঠতা। 

তিনি এরশাদ সরকারকে সুবিধা দিয়ে নিজে সুবিধা নিয়েছেন। বিএনপি শাসনামলেও তিনি সুবিধা আদায় করতে পিছিয়ে থাকেননি। সবশেষ বিএনপি শাসনামলে তিনি দলটির এক নীতিনির্ধারকের ব্যাবসায়িক পার্টনার ছিলেন বলে তখন শোনা গিয়েছিল। 

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি নিজের খোলাস পাল্টাতে সময় নেননি। হয়ে যান পুরোদস্তুর আওয়ামী লীগার। দলীয় পরিচয়ে যিনিই তার কাছ থেকে সুবিধা নিতে চেয়েছেন, দিয়েছেন। বিনিময়ে তার ব্যবসাকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গেছেন। বাগিয়ে নিয়েছেন ব্যাংক। এখন এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান তিনি।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ৫ আগস্টের পর সেই মাসের শেষ দিকে পতিত সরকারের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে সিলেটে তার বিলাসবহুল বাড়ি কাজী প্যালেসে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেই বাড়িতে থাকার জন্য ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার জায়েদ ইকবাল ও জামিল ইকবাল তার সঙ্গে দূতিয়ালি করেছিলেন। 

অভিযোগ আছে, ওবায়দুল কাদেরকে সিলেটে তার প্রাসাদে তুলে দিতে জামিল ইকবাল ওমরাহ থেকে তিন দিনের জন্য সিলেটে এসেছিলেন এবং কাদেরকে প্যালেসে তুলে তিনি আবার দেশ ছেড়েছিলেন। 

মাহতাবুর রহমানের বিরুদ্ধে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠার পর দেশে থাকা তার সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান চালায় সিআইসি। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সিলেটে মাহতাবুর রহমানের প্রাসাদবাড়িতে দুই দফায় তল্লাশি চালানো হয়। ওই বাড়ি থেকে ১০৪টি সম্পত্তির দলিলসহ অন্যান্য নথিপত্র জব্দ করা হয়েছে।

নগরীর টিলাগড়ে অবস্থিত আট একর জায়গাজুড়ে নির্মিত তিনতলা এই বাড়ির বিল্ডিং জোন প্রায় ৮০ হাজার বর্গফুট। ২৯টি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আলোকে বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছে। 

এতে রয়েছে ২৯টি বিলাসবহুল মাস্টারবেড। বাড়িতে একসঙ্গে ৫ হাজার মানুষের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়। এর নিচতলায় রয়েছে ৯টি ডাইনিং। আসবাবের পাশাপাশি প্রায় সব নির্মাণ উপকরণও বিদেশ থেকে আনা। জার্মানি, দুবাই, ফ্রান্স ও লেবাননের প্রকৌশলীরা বাড়ি নির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন।

এর আগে গত ২২ জানুয়ারি সিআইসির পক্ষ থেকে মাহতাবুর রহমান নাসির ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ (অবরুদ্ধ) করা হয়। এ তালিকায় মাহতাবুর রহমানের ছেলে মোহাম্মদ এমাদুর রহমান, ভাই মোহাম্মদ ওলিউর রহমান, ভাতিজা মোহাম্মদ আশফাকুর রহমান ও মোহাম্মদ এহসানুর রহমান এবং আল হারামাইন গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সাব্বির আহমেদের নাম রয়েছে। ব্যাংক হিসাব ছাড়াও তাদের আয়কর নথি পর্যালোচনা করা এবং ভূমি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কাছে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়।

মাহতাবুর রহমান নাসির পতিত আওয়ামী সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিসহ সরকারি আমলারা দুবাই ভ্রমণে গেলে থাকতেন মাহতাবুর রহমানের অতিথি হয়ে। তাদের থাকা, খাওয়া, ঘোরাঘুরিসহ চিত্তবিনোদনের আয়োজন করতেন তিনি। 

সে কারণে বাংলাদেশে মাহতাবুর রহমান পেতেন অবৈধ সুবিধা। তার হুন্ডি ব্যবসার খবর জানলেও কোনো ব্যবস্থা নিত না সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষই। বরং তিনি কীভাবে নির্বিঘ্নে তার ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারেন, সেদিকে খেয়াল ছিল তাদের।

মাহতাবুর রহমানের অপরাধ তদন্তের দায়িত্বে থাকা একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যেসব রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী বাড়ি-গাড়ি, হোটেল, মার্কেটসহ বিভিন্ন সম্পদ কিনেছেন, তাদের প্রায় সবারই পথপ্রদর্শক ছিলেন মাহতাবুর রহমান। 

দেশ থেকে টাকা পাচারে সহায়তা করা, সে দেশে সম্পদ কিনতে সহযোগিতা করা, আমিরাতের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করে দেওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপেই এই ব্যবসায়ীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। এসব কাজের বিনিময়ে তিনি কমিশন পান, সেটিই তার আয়ের প্রধান উৎস। 

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ই তার বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির হস্তক্ষেপে সেসব তদন্ত শেষ করা যায়নি। এসব বিষয় সাম্প্রতিক সময়ে জানাজানি হলে সারা দেশসহ সিলেটে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে।
 

আরবি/এসএম

Link copied!