আর কদিন বাদেই ঈদ। তাই ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে ঢাকা ছাড়তে শুরু করবে ঘরমুখো মানুষ। ফলে সড়ক-মহাসড়কে বাড়বে যাত্রীর চাপ। আর যাত্রীর চাপ সামাল দিতে দৌরাত্ম্য বাড়ে ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় গাড়িরও।
গণপরিবহনের সংকট কাজে লাগিয়ে ঈদযাত্রার বহরে এবারও ফিটনেসবিহীন বাস রংচং করে রাস্তায় নামানো হচ্ছে। এসব যানবাহন মাঝপথে দুর্ঘটনায় পড়লে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটার শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
তাদের পরামর্শ, ঈদযাত্রায় নির্বিঘ্নে বাড়ি ফেরা নিশ্চিত করতে সচেতনতার পাশাপাশি কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। মহাসড়কে স্বস্তি ফেরাতে নিতে হবে সমন্বিত পদক্ষেপ। ঈদযাত্রা নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে উদযাপনের লক্ষ্যে এরই মধ্যে বেশ কিছু নিরাপত্তা পরামর্শ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন ও লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি বের করা যাবে না বলে জানিয়েছে পুলিশ। পাশাপাশি চালকদের ওভারস্পিডে গাড়ি চালানো এবং ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং নিষেধ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করতে যাত্রী হয়রানি বন্ধ ও মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস পরিবহন নেতাদের।
পরিবহনসংশ্লিষ্ট শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, ঈদযাত্রাকে কেন্দ্র করে পরিবহন খাতেও লেগেছে সাজসজ্জার ছোঁয়া। ওয়ার্কশপগুলোতে পুরোনো বাস মেরামতের কাজ চলছে পুরোদমে। নতুন বাস রাস্তায় নামানোর প্রস্তুতিও চলছে। কোথাও চলছে বাসের ইঞ্জিন ও বডি মেরামত। কোথাও চলছে পুরোনো বাসে নতুন করে রঙের প্রলেপ দেওয়ার কাজ। কোথাও আবার শুধু ফিটনেস টেস্ট করে গাড়ি সড়কে নামানোর প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে অনেক মার খাওয়া গাড়িও রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর ডেমরা-কাজলাসহ বেশ কয়েকটি ওয়ার্কশপ ঘুরে দেখা গেছে, নতুন রূপে রাস্তায় নামতে তৈরি হচ্ছে নতুন বাস। চলছে মেরামত।
রঙিন আবহে সাজছে মহাসড়কের যাত্রীবাহী গাড়ি। নতুন বাসের জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন সিট। শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, পুরোনো বাস রং ও মেরামত করে ফেরত দেওয়ার কাজই বেশি হয়। নাম প্রকাশে বাস মেরামত শ্রমিকদের একজন বলেন, ‘আমরা পুরাতন বাসগুলো রং ও মেরামত করে ডেলিভারি দিই। এছাড়া নতুন বাসও থাকে।’ অপর একজন বলেন, ‘নতুন কাজ একটু কম হয়। পুরাতন বাসের কাজই এখানে বেশি হয়।’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, এবার ঈদে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর থেকে গ্রামে ফেরা মানুষের প্রায় ৭৫ শতাংশই ফিরবেন সড়কপথে। এতে বেড়ে যাবে গণপরিবহনের চাহিদা। তবে নতুন গাড়ি তৈরি বা পুরোনো গাড়ি মেরামত হলেও ঈদে চাহিদার তুলনায় গণপরিবহনের সংকট যেন নতুন নয়।
আর এই সংকট পুঁজি করে বেশ কিছু সুযোগসন্ধানী ফিটনেসবিহীন গাড়ি মহাসড়কে যাত্রী পরিবহন করে। পথে পথে সৃষ্টি হয় দুর্ভোগ, যানজট। ঘটে দুর্ঘটনাও। সংস্থাটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিগত ঈদুল ফিতরে ৩৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত ১ হাজার ৩৯৮ জন আহত হয়েছিল।
১৮টি রেল দুর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত ২১ জন আহত হয়েছিল। দুটি নৌপথ দুর্ঘটনায় সাতজন নিহত পাঁচজন আহত হয়েছিল। এবারের ঈদে সব পথে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
তবে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজন কঠোর আইন প্রয়োগ করা। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, মহাসড়কে স্বস্তি ফেরাতে নিতে হবে সমন্বিত পদক্ষেপ।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, শুধু রঙের পরিবর্তন করলেই গাড়ি রাস্তায় নামানোর যোগ্য হয়ে যায় না। ফিটনেসবিহীন এসব যানবাহন দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কর্তৃপক্ষ কেন আছে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হলো গাড়িগুলো শুধু রংচং করে ফিট করে ফেলবে, কিন্তু কাঠামোগতভাবে আনফিট আছে, এটা তো তাদেরই দেখা দরকার। সুতরাং, আমার মনে হয় ভিজিলেন্সটা শুধু ঈদের কিছুদিনের মধ্যে দেখা উচিত না, এটা বিস্তৃত করা উচিত। কঠোর আইন করে সরা বছরই ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, দেশে বাসের সংখ্যা ৮৪ হাজার ২৯৬টির মতো। কিন্তু এর বাইরে অসংখ্য বাস চলছে, যেগুলো অনুমোদন নেই।
গত বছরের জুনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক জরিপে বলা হয়, বাসের কর্মী-শ্রমিকেরা মনে করেন, ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ বাসের নিবন্ধন, ২৪ শতাংশ বাসের ফিটনেস, ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ বাসের ট্যাক্স-টোকেন এবং ২২ শতাংশ বাসের রুট পারমিট নেই। এর আগে ২০১৯ সালে বিআরটিএ আদালতকে জানিয়েছিল, সারা দেশে ৩৩ শতাংশ গাড়ির ফিটনেস সনদ নেই। আর ৫৬ শতাংশ গাড়িতে নেই গতি নিয়ন্ত্রক সিল।
বছরের পর বছর ফিটনেসবিহীন বাস সড়কে চলায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ফিটনেসবিহীন এসব লক্কড়ঝক্কড় বাস বন্ধে ২০১২ সাল থেকে বিআরটিএ থেকে বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় পরও সড়ক থেকে সরানো যায়নি এসব বাস।
এদিকে মানুষের ভোগান্তি কমাতে ঈদযাত্রায় সড়ক, রেল ও নৌপথে মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়ঝক্কড় ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
সংস্থাটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রতি বছর ঈদে ফিটনেসবিহীন, লক্কড়ঝক্কড় বাস, ট্রাক, লেগুনা, টেম্পো, মাইক্রোবাস, কার, নছিমন-করিমন ও সিটি সার্ভিসের বাস-মিনিবাস দূরপাল্লার বহরে যাত্রী পরিবহনে নেমে পড়ে। এতে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি যানজট ও ভোগান্তি তৈরি করে।
তিনি বলেন, সারা দেশে ৫ লাখের বেশি যানবাহনের ফিটনেস নেই। ৫ লাখ ইজিবাইক, ৬০ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ৭ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা, ১ লাখ নছিমন-করিমন, ২০ লাখ মোটরসাইকেল প্রতিদিন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে চলাচল করছে।
এসব যানবাহন দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসের গতি কমানোর পাশাপাশি যানজটের সৃষ্টি করছে। এসব যানবাহন জাতীয় মহাসড়ক থেকে জরুরি ভিত্তিতে উচ্ছেদ করতে হবে। সড়ক-মহাসড়কের প্রতি ইঞ্চি বেদখলমুক্ত করে বাধাহীন যানবাহন চলাচলে উদ্যোগ নিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
স্বস্তিদায়ক যাত্রায় মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সমন্বিত উদ্যোগে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস এই খাতের মানুষদের।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি এম এ বাতেন বলেন, সিটি সার্ভিসের প্রতিটা গাড়ির কোম্পানিকে নিয়ে মিটিং করেছি, যেন এই সব গাড়ি লং রুটে না চলে। সাধারণত এসব গাড়ির চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকে হালকা যানবাহন চালানোর। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করব যাতে কোনো অবস্থাতেই সিটি সার্ভিসের গাড়ি লং রুটে না চলতে পারে।
বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এবার আমরা যাত্রীদের নিরাপদ ও সুন্দর ঈদযাত্রা উপহার দিতে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের প্রতিটি টার্মিনালে যাত্রীদের জন্য হেল্প ডেস্ক রাখা হবে। কাউন্টারগুলোর সামনে নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা টানানো থাকবে।
যাত্রীদের হয়রানি করলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা থাকবেন। এছাড়া সকাল ও রাতে যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে টার্মিনাল এলাকায় পুলিশের টহল বাড়ানোর কথা জানিয়েছি। সড়কে যাতে কোনো প্রকার ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল না করে, সে বিষয়টিও তদারক করা হবে।
বরিশালের বাসিন্দা রুস্তুম আলী বলেন, ‘অনেক সময় দেখি পুরোনো, জরাজীর্ণ বাস ঈদের সময় রাস্তায় নেমে আসে। এই বাসগুলোর অনেকগুলোর ব্রেক ঠিকঠাক কাজ করে না, রাস্তার মাঝপথে নষ্ট হয়ে যায়। এসব ঝুঁকি কমানো দরকার।’ রংপুরে শ্বশুরবাড়ি স্কুল শিক্ষিকা সোনিয়ার।
তিনি জানান, প্রতিবার ঈদে মহাসড়কে তীব্র যানজট হয়। ছয়-সাত ঘণ্টার পথ পেরোতে ১৫-১৬ ঘণ্টা লেগে যায়। বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় এত সময় থাকা কষ্টের। পুলিশ আর কর্তৃপক্ষ যদি সঠিকভাবে কাজ করে, তাহলে এ সমস্যা কিছুটা হলেও কমবে।’
হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, ফিটনেসবিহীন যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, যানজট নিরসনে সারা দেশে ৬৪টি ‘ব্ল্যাক স্পট’ চিহ্নিত করেছে হাইওয়ে পুলিশ। সারা দেশের চেকপোস্টগুলো লাইভ ভিডিওর মাধ্যমে কেন্দ্র থেকে পর্যবেক্ষণ করা হবে। পুলিশের আটটি রেঞ্জের ডিআইজিগণ এসব চেকপোস্ট তদারক করবেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নাজমুল হাসান বলেছেন, ঢাকা থেকে যেন বাস সহজে বের হতে পারে, সে জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকায় প্রবেশ ও বহির্গমনে যেন কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয়, সে জন্য আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।
যাত্রী পরিবহনের সুবিধার্থে ঈদের তিন দিন আগে থেকে সড়কে ট্রাক-লরি চলাচল নিষিদ্ধ থাকবে। প্রয়োজনে এক টনের পিকআপ ট্রাকগুলোর চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ হাইওয়ে পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিচালক মো. দেলোয়ার মিঞা বলেছেন, এবারের ঈদে যাত্রীদের মধ্যে নিরাপত্তার কোনো শঙ্কা যেন না থাকে, সে জন্য আমরা সারা দেশের মহাসড়কে টহল, চেকপোস্টসহ নিরাপত্তা জোরদার করছি। এবার সুন্দর ঈদযাত্রা নিশ্চিত করার বিষয়ে আমরা আশাবাদী।
আপনার মতামত লিখুন :