ফলাফলের লক্ষ্যমাত্রার (ডিসবার্সমেন্ট লিংকন্ড ইন্ডিকেটর-ডিএলআর) ৭ শর্ত পূরণ করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বাস্তবায়নাধীন ‘লার্নিং এক্সিলারেশন ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন (লেইস)’। এতে এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণের প্রথম কিস্তির ৬৪ মিলিয়ন ডলার বা ৮০০ কোটি টাকা পাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পটি আগামী চার বছরে আরও ২৮টি শর্ত পূরণ করতে পারলে চার কিস্তিতে প্রকল্প বরাদ্দের মোট ৩০০ মিলিয়ন ডলার বা ৩ হাজার ২২৫ কোটি টাকা পাবে বাংলাদেশ সরকার।
ফলের লক্ষ্যমাত্রার শর্ত পূরণ যাচাইয়ের জন্য বিশ্বব্যাংকের ইম্পলিমেন্টেশন (বাস্তবায়ন) সাপোর্ট মিশন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে হবিগঞ্জে একটি কর্মশালার আয়োজন করে। কর্মশালায় লেইস প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রার শর্ত পূরণ বাস্তবায়নের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, জলবায়ু ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে ২ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সিনিয়র সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক মিশনের সমাপনি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় মিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন ৪২টি প্রকল্পের মধ্যে লেইস প্রকল্পের অগ্রগতি শীর্ষ অবস্থানে। ফলে বিশ্বব্যাংকের ঋণের প্রথম কিস্তির ৮০০ কোটি টাকা দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বড় অর্জন। পাশাপাশি এই প্রকল্প সফলভাবে শেষ হলে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় শিক্ষার্থী ধরে রাখার হার বাড়ার পাশাপাশি দ্রুত শিখন সহজ হবে। প্রকল্প সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ফলের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করায় প্রতিটি শর্তের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলার বরাদ্দ করা আছে।
সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র থেকে দেখা গেছে, প্রথম শর্ত, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল তৈরি ও অনুমোদনের জন্য ৮ মিলিয়ন ডলার।
দ্বিতীয় শর্ত, উপজেলাভিত্তিক শিখন ঘাটতি ও পুনরুদ্ধার সম্পর্কিত তথ্য ও সংস্কারের জন্য শিক্ষক নির্দেশিকা তৈরি এবং অনুমোদনের জন্য মোট ১০ মিলিয়ন।
তৃতীয় শর্ত, অংক, বাংলা ও জলবায়ু বিষয়ে ই-কন্টেন্ট তৈরি করে পাইলটিং করার জন্য ১০ মিলিয়ন।
চতুর্থ শর্ত, গরিব শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির মানদণ্ড সংশোধন ও জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার শিক্ষার্থীদের জানাতে প্রচার কৌশলের জন্য ৪ মিলিয়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ওপর নির্দেশিকা তৈরি ও গ্রহণের জন্য ৪ মিলিয়ন এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা নির্দেশিকা তৈরি ও গ্রহণ করার জন্য ৪ মিলিয়ন।
পঞ্চম শর্ত, পিবিজিএস ম্যানুয়েল অনুমোদনের জন্য সাড়ে ৪ মিলিয়ন ও জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা ব্যবস্থার ম্যানুয়াল অনুমোদনের জন্য সাড়ে ৪ মিলিয়ন।
ষষ্ঠ শর্ত, জলবায়ু সচেতনতার ওপর মাউশির প্রকাশনার জন্য ৫ মিলিয়ন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত দুটি গাছ লাগানোর জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রচারের জন্য ৫ মিলিয়ন।
সপ্তম শর্ত, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের জন্য ম্যানুয়াল তৈরি ও অনুমোদনের জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক শিপন কুমার দাস রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ঋণ হলেও বিশ্বব্যাংকের এটি অনেক সহজে পরিশোধযোগ্য। মাত্র ১ শতাংশ সুদে আগামী ২৭ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করা যাবে। দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রকল্প পরিকল্পনা সরকারের তরফে করা হলেও ঋণ পাওয়ার জন্য শর্তগুলো বিশ্বব্যাংক নির্ধারণ করে থাকে।
কোনো বছর যদি নির্ধারিত ৭টি ফলের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না করা যায় তাহলে ঋণের টাকা পাওয়া যাবে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রকল্প পরিচালক বলেন, বিষয়টি এমন নয়, যে বছর লক্ষ্যমাত্রা যতটা অর্জিত হবে সেই পরিমাণ বরাদ্দ সরকারি কোষাগারে জমা হবে।
যেমন- কোনো বছর যদি তিনটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হয়, তাহলে পরের বছরের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সেটা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। প্রকল্পের মেয়াদে অর্থাৎ পাঁচ বছরে মোট ৩৫টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে।
প্রকল্পের মেয়াদে সম্পূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা না গেলে সেক্ষেত্রে প্রকল্পের সময় বাড়তে পারে, ইতিপূর্বে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে এমন হয়েছে বলে মন্তব্য করেন প্রকল্প পরিচালক। তবে বছরভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তীতে এটি চাপ তৈরি করবে।
বিশ্বব্যাংক ঋণ দিয়েছে প্রকল্পকে- এতে সরকার কীভাবে লাভবান হতে পারে- প্রশ্নের উত্তরে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ঋণের অর্থ জমা হবে সরকারি কোষাগারে। প্রকল্পের জন্য ব্যয়িত অর্থ দিবে অর্থ মন্ত্রণালয়। বিশ্বব্যাংকের দেখার বিষয় হলো, প্রকল্প সঠিকভাবে চলছে কি নাÑ ফলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে কি না। তাদের ঋণের অর্থ কীভাবে ব্যয় হচ্ছে সেটা তাদের জন্য মুখ্য বিষয় নয়।
একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে বিপুলসংখ্যক শিক্ষককে যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়াকে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ মনে করেন প্রকল্প পরিচালক। তিনি বলেন, প্রকল্প মেয়াদে প্রায় ৪ লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর অর্জিত বিষয়গুলো মাউশির মনিটিরং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন শাখার মাধ্যমে নিয়মিত তত্ত্বাবধান করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক।
জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে লেইস প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মাউশি অধিদপ্তর। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বা ৩ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। মোট টাকার মধ্যে বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে ৯৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ১ দশমিক ৫০ শতাংশ।
২০২৩ সালের ১ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্প শেষ হবে ২০২৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। চলতি সময় পর্যন্ত প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক এবং ফলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কিত কার্যাদি শেষ করা হয়েছে। বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা।
প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো- মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী ধরে রাখার হার বৃদ্ধি এবং শিখন ত্বরান্বিত করা। মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০২৮ সালের মধ্যে বর্তমানে অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অঙ্ক ও বাংলা বিষয়ে মৌলিক দক্ষতা যথাক্রমে ৬৫ ও ৯০ শতাংশে উন্নীত করা। বর্তমানে এই দুই বিষয়ে মৌলিক দক্ষতার হার যথাক্রমে ২৮ দশমিক ৭০ শতাংশ ও ৬৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
এ ছাড়া এই স্তরের শিক্ষার্থীদের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ধরে রাখার হার ৭৪ শতাংশে উন্নীত করা। বর্তমানে এই হার রয়েছে ৭২ শতাংশ। মাধ্যমিক শিক্ষকদের দক্ষতা ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি, মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ও সহনক্ষমতা উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের জন্য গঠনকালীন মূল্যায়ন ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রকল্প মেয়াদে ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে ব্লেন্ডেড ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা এবং একই সময়ে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সচেতনা করা ও লাইব্রেরি উন্নয়ন করা প্রকল্পের উদ্দেশ্যে অন্তর্ভুক্ত।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- স্থানীয়ভাবে প্রায় চার লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ আর বৈদেশিকভাবে দেড় হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ। এসব প্রশিক্ষণের মধ্যে রয়েছে, শিক্ষকদের জন্য বিষয়ভিত্তিক প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রশিক্ষণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের জন্য লিডারশিপ প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণসহ আরও বেশকিছু প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।
অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুটি করে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ তৈরি, সাড়ে ২৯ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরির উন্নয়ন, এক হাজার ই-কন্টেন্ট তৈরিসহ বেশকিছু উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রকল্পের বাস্তবায়নে প্রায় ১৪টি অগ্রগতির তথ্য জানা গেছে। উল্লেখযোগ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনসহ প্রকল্প পরিচালনার ম্যানুয়াল বিশব্যাংকে প্রেরণ। প্রকল্পের আওতায় নির্ধারিত ১৪টি টিটিসি, ৫টি এইচএসটিটিআই ও ১টি বিএমটিটিআইয়ের প্রশিক্ষণ কক্ষ সংস্কারের জন্য অর্থ বরাদ্দ। মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ঠেকাতে কৌশলপত্র প্রণয়ন। মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ স্থাপনের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্বাচন নীতিমালা প্রণয়ন, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিষয়ক গাইডলাইন প্রণয়ন।
প্রকল্পটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে মূল উদ্দেশ্য পূরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে উন্নতি হবে। ফলে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন সূচিত হতে পারে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।
আপনার মতামত লিখুন :