কক্সবাজারের শুধু উখিয়া উপজেলাই সড়ক-উপসড়কে প্রায় ৯০০টি অবৈধ ডাম্পার (ছোট ট্রাক) ও পিকআপ চলাচল করে। এসব যানবাহনে সরবরাহ হয় পাহাড় কাটার মাটি, ঝিরি-খাল ও নদী থেকে উত্তোলন করা বালু এবং বনাঞ্চলের গাছ। এতে নদী-খাল, প্রাকৃতিক ঝিরি সংরক্ষিত পাহাড় ও বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে।
বন বিভাগ ও পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা বলছেন, কক্সবাজারের উখিয়ায় অন্তত ১০-১৫টি পাহাড় ও ১২টির বেশি প্রাকৃতিক উৎস (নদী, খাল ও ঝিরি) থেকে ডাম্পার ও পিকআপে দৈনিক কয়েক লাখ ঘনফুট মাটি ও বালু পাচার হচ্ছে।
বন বিভাগ অভিযান চালিয়ে একের পর এক ডাম্পার আটকে জরিমানা করলেও পাহাড়নিধন বন্ধ করা যাচ্ছে না। পাহাড় নিধনকারী ও ডাম্পার মালিকদের সঙ্গে আতাত করে নিহত বন বিট কর্মকর্তা সাজ্জাদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করছে বন বিভাগ। বন বিভাগের তথ্য মতে, গত তিন বছরে উখিয়ায় পাহাড় কাটার ঘটনায় ১৩৮ জনের বিরুদ্ধে বন বিভাগ মামলা করে ১০৪টি।
শুধু বন আইনের দোহাই দিয়ে লাখ লাখ টাকা জরিমানার নামে টাকা আদায় করা হলেও সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে নামমাত্র রাজস্ব। সিংহভাগ টাকা ভাগবাটোয়ারার অভিযোগ উঠেছে। এসব এলাকায় পাহাড় কাটা, বালু পাচার ও কাঠ পাচার থেমে নেই। পোস্টিং বাণিজ্য, বনায়ন রক্ষণাবেক্ষণের নামে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনাও ঘটছে। বনভূমি জবরদখলের ঘটনাও অহরহ ঘটছে।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম ও সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মনিরুল ইসলাম সিন্ডিকেট করেই বন ও বনভূমি ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে। এতে করে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। ভেঙে পড়ছে বন বিভাগের শৃঙ্খলা ও চেইন অব কমান্ড।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মনিরুল ইসলাম। দায়িত্ব টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায়। টেকনাফে তার নামে সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার বরাদ্দ থাকলেও তিনি অবস্থান করেন কক্সবাজার শহরে। ৩০-৩৫ হাজার টাকায় ফ্ল্যাট নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন কক্সবাজার শহরের বাহারছড়ায়। কর্মস্থলে মাসের পর মাস অনুপস্থিত থাকেন বলে একাধিক বন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
এ ছাড়া কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের হাতি সুরক্ষা টিমের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধান বন সংরক্ষক আমির হোসেন এই কমিটি গঠন করে দেন। কিন্তু হাতি সুরক্ষায় তার কোন তৎপরতা নেই। দায়িত্ব পালনে চরম গাফেলতির কারণে একের পর এক হাতি মারা যাচ্ছে। ২০২৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত শুধু উখিয়া ও টেকনাফে হাতি মারা গেছে অন্তত ৮টি। এ ব্যাপারে এই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোনো পদক্ষেপ নেই।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. নুরুল ইসলাম ও সহকারী বন সংরক্ষক (উখিয়া-টেকনাফ)-এর দুর্নীতি খুঁজতে গিয়ে কয়েকজন রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বনবিট কর্মকর্তার সন্ধান পাই আমরা। নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তারা আমাদের এমন কিছু তথ্য দিলেন, যা চমকে ওঠার মতো। তারা জানান, এসিএফ মনিরুল ইসলাম শহরের বাহারছড়ার বাসাভাড়াসহ বিভিন্ন খাত দেখিয়ে টেকনাফ, শীলখালী, হোয়াইক্যং, ইনানী, উখিয়া রেঞ্জ এবং এসব রেঞ্জের অধীনে সব বিট কর্মকর্তা, চেক স্টেশন থেকে মাসিক নির্দিষ্ট হারে চাঁদা নেন।
রেঞ্জ ও বনবিট কর্মকর্তারা আরও জানান, বিভিন্ন সময় মাটি, বালি ও অবৈধ বনজদ্রব্য বোঝাই আটক মিনি ট্রাক, ডাম্পার, পিক-আপ, জিপ ও ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনের বিপরীতে পিওআর মামলা দায়ের না করেই সিওআর মামলা দায়ের করার নামে যানবাহন মালিক কিংবা অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে নামমাত্র ফি সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে সিওআর মামলা নিষ্পত্তি করেন। গত এক বছরে সিওআর মামলার বিপরীতে সরকারি কোষাগারে জমা করা টাকার তথ্য যাচাই করলে মিলবে এর সত্যতা।
বন কর্মকর্তারা আরও জানান, বিভিন্ন সময়ে আটক করা বেশির ভাগ গাড়ীগুলো রেজিষ্ট্রেশনবিহীন হওয়ায় গাড়ী মালিকের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে পরবর্তীতে আদালতে সোপর্দ করেন না। এধরনের অহরহ ঘটনার নজির রয়েছে।অবশ্য সিওআর মামলা ডিএফও হাতে নিষ্পত্তির ক্ষমতা থাকলেও সিওআর মামলার সকল প্রক্রিয়া চুক্তিভিত্তিক সম্পাদন করেন এসিএফ মনিরুল ইসলাম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, ডিএফও নুরুল ইসলাম ব্যাপক হারে পোস্টিং বাণিজ্য করেছেন। লাখ লাখ টাকা নিয়ে বেশ কিছু স্টাফদের সুবিধা জনক জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ২/৩ বছর একই স্থানে চাকরি করলেও টাকা নিয়ে অসংখ্য বনকর্মীকে একই কর্মস্থলে রেখে দিয়েছে।
গত বছরের ২৮ অক্টোবর কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম যোগদান করেন। এফসিএফ মনিরুল ইসলাম ও রেঞ্জ কর্মকর্তা আলী নেওয়ারকে ক্যাশিয়ার হিসেবে রেখে তাদের দিয়েই অর্থনৈতিক অনিয়মগুলো করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। এর আগে ডিএফও নজরুল ইসলাম কাপ্তাই বাগান বিভাগ (পাল্প উড) ছিলেন। তারও আগে বন অধিদপ্তরে সুফল প্রকল্পের ডিপিডি ছিলেন তিনি। সুফল প্রকল্পের পিডি গোবিন্দের সাথে মিলে মিশে সারা বাংলাদেশে সুফল প্রকল্পের নামে হরিলুট করা অর্থ থেকে কমিশন ভিত্তিক অর্থ নিয়ে ভাগভাটোয়ারা করেছে।
কয়েকজন রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বনবিট কর্মকর্তার নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, নুরুল ইসলাম যোগদানের পর পরিচালন ব্যয়খাত (মেন্টনেন্স), সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প, সুফল প্রকল্পের, এফআরসিআরপি বাবদসহ ২ থেকে আড়াই কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকে একজন রেঞ্জ কর্মকর্তা বরাদ্দ পান ১ লাখ টাকার মধ্যে মাত্র ৬৯ হাজার ৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে ৩১% (লাখে) কেটে নেওয়া হলেও তাদের কাছ থেকে কয়েকজন রেঞ্জ কর্মকর্তা জানান।
এই ৩১% টাকা থেকে সিসিএফ অফিস, সিএফ অফিস ও ডিএফও অফিস পারসেন্ট হারে ভাগবাটোয়ারা করা হয়। এভাবেই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। দক্ষিণ বন বিভাগের এসিএফ মনিরুল ইসলাম ও এফসিসিও ফরেস্টার আলী নেওয়াজের হাতেই পার্সেন্টিসের অর্থসহ সিওআর মামলায় আদায় করা টাকাগুলো জমা থাকে। তারা দুজনই সব কিছু ম্যানেজ ও ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করে আসছে।
এদিকে, বনজদ্রব্য পাচার রোধ, পাহাড় কাটা ও মাটি, বালু পাচার রোধে গঠিত বন বিভাগের বিশেষ টহল দল অকেজো করে রেখেছে খোদ ডিএফও।
উখিয়ার সাবেক রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী শাফিউল আলমকে বিশেষ টহল দলের দায়িত্ব দেওয়া হলেও অনেকটা নিষ্ক্রিয় রাখা হয়েছে। ফলে সড়কপথে অবৈধ বনজ দ্রব্য, মাটি ও বালি পাচার অব্যাহত রয়েছে।
কয়েকজন রেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, শুধু সহকারী বন সংরক্ষক মনিরুলকে আয়ের পথ সুগম করতেই এই উদ্যোগ। তারা আরও বলেন, কাঠ চোরাকারবারি, অবৈধ স’মিল, ইটভাটা, বালি পাচারকারী ও অবৈধ কাঠ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে বিশাল অঙ্কের অর্থ আসে এসিএফ মনিরুলের কাছে।
এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে আমদানি করা কাঠের আড়ালে চোরাইভাবে দেশীয় কাঠ পাচারের সময় একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা এসিএফএর কাছে পৌঁছে যান। তিনি প্রায় আড়াই থেকে তিন বছর এই দুই উপজেলায় দায়িত্ব পালন করছেন। বনায়নসহ পরিচালন ও বিভিন্ন খাতে রেঞ্জ অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া টাকা থেকে ৫% টাকা কেটে নেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, উখিয়া ও টেকনাফে শতাধিক লাইসেন্সবিহীন স-মিলে দিবারাত্রি কোটি কোটি টাকার চোরাই কাঠ চিরাই হচ্ছে।
এসব স-মিল থেকে মাসিক ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা বন বিভাগকে মাসোয়ারা দিয়ে আসছে। এসিএফ, রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বনবিট কর্মকর্তার মাসোহারায় চলছে বলে সূত্রে প্রকাশ।
অবশ্য, বন নীতিমালা অনুযায়ী বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটার সীমানার মধ্যে করাতকল (স-মিল) করার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। স-মিলে নেই পরিবেশের ছাড়পত্র। বন বিভাগের কোনো অনুমোদনও নেই। তারপরেও থেমে নেই দিবারাত্রি চোরাই কাঠ চিরাই প্রক্রিয়া। কিন্তু বন বিভাগ রহস্যজনক নীরবতা। দুই উপজেলায় শতাধিক স-মিল, ইটভাটা, ডাম্পার মালিক, চোরাই কাঠ পাচারকারীদের কাছ থেকে প্রতি মাসেই দেড় কোটি টাকার ওপরে ঘুষ আদায় করা হয়। যা সংশ্লিষ্ট বিটের ফরেস্ট গার্ড থেকে শুরু করে ডিএফও পর্যন্ত পৌঁছায় বলে সুত্রে প্রকাশ।
এ ছাড়া উখিয়ায় আশঙ্কাজনক হারে পাহাড় কাটা, রক্ষিত ও সংরক্ষিত বনভূমি জবরদখলের হিড়িক পড়েছে। দখলকৃত বনভূমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে পাকা দালান কৌটা। কিন্তু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোনো উদ্যোগ নেই। দিনদিন কমে আসছে বনভূমি, দীর্ঘ হচ্ছে জবরদখলকারীর তালিকা।
এ ব্যাপারে উখিয়া উপজেলা বিএনপি সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সরওয়ার জাহান চৌধুরী বলেন, বন বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সিন্ডিকেট করে বন এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করেছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানান। এ ব্যাপারে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ডিএফও নুরুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, পাহাড় কাটা, বালু পাচার ও জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে।
আপনার মতামত লিখুন :