দেশের ক্রেডিট কার্ড বাজারে সিটি ব্যাংক এক নির্ভরযোগ্য নাম, বিশেষ করে একমাত্র আমেরিকান এক্সপ্রেস (অ্যামেক্স) ক্রেডিট কার্ড ইস্যু এবং অ্যাকুয়ারের ক্ষেত্রে। উদ্ভাবন এবং গ্রাহককেন্দ্রিক সেবা দিয়ে নেতৃত্বের আসন মজবুত করেছে। এ বিষয়ে ব্যাংকটির কার্ড বিভাগের প্রধান তৌহিদুল আলমের সঙ্গে কথা বলেছেন রূপালী বাংলাদেশের বিজনেস এডিটর রহিম শেখ।
রূপালী বাংলাদেশ: গ্রাহকদের জন্য সিটি ব্যাংক পিএলসির কত ধরনের ক্রেডিট কার্ড আছে? সিটি অ্যামেক্স কেন এত জনপ্রিয়?
তৌহিদুল আলম : সিটি ব্যাংক তার গ্রাহকদের ক্রয়ক্ষমতা, জীবনমান, চাহিদা, সামাজিক বিচরণক্ষেত্র, ভ্রমণ ইত্যাদির কথা মাথায় রেখেই বিভিন্ন ধরনের কার্ড ডিজাইন করে থাকে।
বর্তমানে আমরা সাধারণত অ্যামেক্স এবং ভিসা এই দুই ধরনের নেটওয়ার্কের ক্রেডিট কার্ড প্রদান করছি। তবে আমরা যেহেতু আমেরিকান এক্সপ্রেসের (অ্যামেক্স) একমাত্র লাইসেন্স প্রাপ্ত ব্যাংক, তাই আমাদের প্রডাক্ট অফারিং এর সবচেয়ে বড় অংশই হলো এই নেটওয়ার্কের। অ্যামেক্স সেঞ্চুরিয়ন লাইনে আমাদের HNW গ্রাহকদের জন্য রয়েছে অ্যামেক্স প্লাটিনাম কার্ড, এরপর Super Affluent গ্রুপের জন্য রয়েছে অ্যামেক্স গোল্ড কার্ড, আর Upper Mass সেগ্মেন্টের জন্য রয়েছে অ্যামেক্স ব্লু কার্ড।
অ্যামেক্স সেঞ্চুরিয়ন বাদে আমাদের অ্যামেক্স ব্লু বক্স লাইনে আছে নারীদের জন্য স্পেশালাইজড কার্ড সিটি আলো অ্যামেক্স কার্ড, গ্রোসারি শপারদের জন্য অ্যামেক্স আগোরা কোব্রান্ড কার্ড, ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লাইয়ারদের জন্য বিমান অ্যামেক্স কোব্রান্ড কার্ড এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলামনাই ও শিক্ষকদের জন্য ডিইউ অ্যামেক্স কোব্রান্ড কার্ড। আর ভিসা নেটওয়ার্কে আমাদের রয়েছে ভিসা ইনফিনিট ও ভিসা প্লাটিনাম ক্রেডিট কার্ড। ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ডটি আমরা গত বছর Super Affluent গ্রাহকদের জন্য সংযোজন করেছি।
আমেরিকান এক্সপ্রেস (অ্যামেক্স) ক্রেডিট কার্ডগুলি বিভিন্ন কারণে জনপ্রিয়: ১. আকর্ষণীয় মেম্বারশিপ রিউয়ার্ড প্রোগ্রাম ২. চমৎকার ট্র্যাভেল ও ডাইনিং অফার ৩. এক্সক্লুসিভ পার্টনারশিপ ৪. উন্নত গ্রাহক পরিষেবা
৫. প্রেস্টিজ এবং স্ট্যাটাস সিম্বল ৬. ইনোভেটিভ টেকনোলজির ব্যবহার ইত্যাদি।
রূপালী বাংলাদেশ: আপনাদের ক্রেডিট কার্ড কেন গ্রাহক পকেটে রাখবেন?
তৌহিদুল আলম : সার্বিকভাবে বিশ্বমানের গ্রাহক সেবা, প্রতযোগিতামূলক প্রোডাক্ট ফিচার, প্রিমিয়াম সার্ভিসেস, স্মার্ট টেকনোলজির মাধ্যমে গ্রাহক সেবা, এক্সক্লুসিভ ডিলস, স্টাটাস, গ্রাহকের চাহিদা ও প্রয়োজনের কথা চিন্তা করলে সিটি ব্যাংক কর্তৃক ইস্যুকৃত ক্রেডিট কার্ডের মধ্যে সব ধরনের সমাধান রয়েছে। আমাদের কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহকেরা তাদের সব প্রয়োজন মেটাতে পারেন, তা দেশেই হোক আর দেশের বাইরেই হোক। অর্থাৎ সিটি ব্যাংক গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করতে পারার কারণেই, আমরা তাদের আস্থা ধরে রাখতে পেরেছি এবং এ কারণে আমাদের ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি।
রূপালী বাংলাদেশ: রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গ্রাহকদের জন্য কী ধরনের অফার দিচ্ছেন?
তৌহিদুল আলম : রমজান ও ঈদ উপলক্ষে সিটি ব্যাংক গ্রাহকদের জন্য বিশেষ অফার নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে শীর্ষস্থানীয় লাইফস্টাইল ও গ্রোসারি আউটলেটে ১৫% পর্যন্ত ক্যাশব্যাক, ৪৫০টিরও বেশি রিটেইল স্টোরে ৫০% পর্যন্ত ডিসকাউন্ট, ১০০টিরও বেশি রেস্টুরেন্টে ৩০% পর্যন্ত ডিসকাউন্ট, বিভিন্ন অনলাইন মার্চেন্ট ও ফুড ডেলিভারিতে ২৫% পর্যন্ত ডিসকাউন্ট এবং ৪০টিরও বেশি রেস্টুরেন্টে ইঙএঙ ইফতার ও ডিনার অফার।
রূপালী বাংলাদেশ: দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা খুবই কম। কেন এ বাজার সম্প্রসারণ সম্ভব হচ্ছে না?
তৌহিদুল আলম : জনসংখ্যার অনুপাতে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা অবশ্যই খুবই কম। আমাদের দেশে মোট ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা ২৬ লাখের কিছু বেশি হলেও শুধু প্রাইমারি কার্ডের সংখ্যা হলো ১৫ লাখের কিছু বেশি। যেহেতু একই ব্যক্তির ওয়ালেটে সাধারণত একাধিক কার্ড থাকে, তাই প্রকৃত প্রাইমারি ক্রেডিট কার্ডহোল্ডারের সংখ্যা ৮-৯ লাখের বেশি হবে না। এশিয়ান দেশগুলোর মান অনুযায়ী প্রায় ১৭-১৮ কোটির জনসংখ্যার এবং ৭.৩৪ কোটি লেবার ফোর্সের দেশে ন্যূনতম ১ কোটি মানুষের হাতে ক্রেডিট কার্ড থাকা উচিত।
এ বাজার সম্প্রসারণ সম্ভব হচ্ছে না অনেক কারণে। প্রথমত, ২০২২ সালের জুলাই থেকে ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার জন্য আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার পপুলেশন সাইজ একবারে ৮৫ লাখ থেকে নেমে ৩০ লাখে চলে আসে। সত্যিকারের ক্যাশলেস সোসাইটি নির্মাণের পথে ক্রেডিট কার্ডের বাজার সম্প্রসারণের কোনো বিকল্প নেই। তাই এইক্ষেত্রে নীতি সহায়তা প্রয়োজন।
এ ছাড়াও অপ্রতুল গ্রাহক চাহিদা, ক্রেডিট কার্ডের প্রতি সাধারণ মানুষের ভীতি, অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োযিত পেশাজীবীদের প্রতি ক্রেডিট কার্ড প্রদানে ব্যাংকের অনীহা, অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা ইত্যাদিও ক্রেডিট কার্ডের বাজারে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া কঠোর ক্রেডিট পলিসির কারণে ছাত্র এবং নিম্ন-মধ্যম আয়ের জনগোষ্ঠীর কাছে ক্রেডিট কার্ড পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এটাও সম্প্রসারণের একটা বড় বাধা বলেই আমার কাছে মনে হয়।
রূপালী বাংলাদেশ: বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে মানুষ এখন ক্রেডিট কার্ডের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি অনুভব করছে। এটিকে কাজে লাগানো যায় কীভাবে?
তৌহিদুল আলম: বিদেশ ভ্রমণে মানুষ চেষ্টা করে ভ্রমণটাকে কীভাবে ঝামেলাবিহীন, নিরাপদ ও চিন্তামুক্ত রাখা যায়। আর সেকারণেই মানুষ চেষ্টা করে যতক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে তার খরচের প্রয়োজন মেটাতে।
২০২২ সালে বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকেরা বিদেশে খরচ করেন ৩,২২২ কোটি টাকা যা ২০২৪ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ৪,৭৮০ কোটি টাকায়! অর্থাৎ ২ বছরে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিদেশে খরচ ৪৮% বৃদ্ধি পায়। এই ডেটা থেকে সহজেই বুঝা যায় যে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে মানুষ এখন ক্রেডিট কার্ডের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি অনুভব করছেন।
কাউন্টার থেকে নগদ বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়ের চেয়ে কার্ড পেমেন্টে ভালো রেট পাওয়া, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের অনেক সুবিধা যেমন- রিউয়ার্ড পয়েন্ট, ক্যাশব্যাক, ৪৫ দিন পর্যন্ত ক্রেডিট সুবিধা পাওয়া ইত্যাদির কারণেও গ্রাহকেরা বিদেশে এখন বেশি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। আমরা গ্রাহকদের এই প্রয়োজনীয়তাগুলোকেই কাজে লাগাচ্ছি যার ফলে আমাদের ইন্টারন্যাশনাল ট্র্যানজ্যাকশনের প্রবৃদ্ধিও অনেক ভালো হয়েছে।
রূপালী বাংলাদেশ: ক্যাশলেস বাংলাদেশ বাস্তবায়নে কি ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা দেখছেন আপনি?
তৌহিদুল আলম : ক্যাশলেস বাংলাদেশ বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন- মানুষকে ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন পেনেট্রেশন রেট বাড়ানো, আনব্যাংকড পপুলেশন সাইজ কমানো, সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। তবে, এই উদ্যোগের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ক্যাশলেস লেনদেনকে উৎসাহিত করার জন্য নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ নীতি সহায়তা পেলে এবং পরিকল্পনা মাফিক কাজ করা গেলে ২০২৭ এর মধ্যে ৫০% এর অধিক লেনদেন ক্যাশলেস করা সম্ভব বলে মনে হয় আমার কাছে। এটি করা গেলে আর্থিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে, দুর্নীতি হ্রাস পাবে, সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে। সব পক্ষই এই উন্নয়নের সুফল পাবে।
রূপালী বাংলাদেশ: ডিজিটাল লেনদেনে আপনার কি ধরনের পরামর্শ রয়েছে?
তৌহিদুল আলম : ডিজিটাল লেনদেনের জন্য কিছু পরামর্শ হলো- সব ক্ষেত্রে ইধহমষধ ছজ স্থাপন করা, মার্চেন্টদের জন্য MDR বা service fee সহনীয় পর্যায়ে রাখা এবং একই সঙ্গে IRF (Interchange reimbursement fee) কমানো যাতে POS machine ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, মোবাইল অ্যাপ ও লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করার ক্ষেত্রে রিটার্ন জমাদানের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া, ডিজিটাল লেনদেনের জন্য ইনসেন্টিভ চালু করা, ডিজিটাল লেনদেনের অবকাঠামো উন্নয়নে এগিয়ে আসতে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা, POS machine আমদানি এর উপর VAT কমানোর মাধ্যমে acquiring Bank কে ডিজিটাল লেনদেন সম্প্রসারণে উৎসাহিত করা এবং ধীরে ধীরে অঞ্চলভিত্তিক ডিজিটাল লেনদেন বাধ্যতামূলক করা।