সিলেটে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ইফতার মাহফিলে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে হট্টগোল ও হাতাহাতিতে জড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের একটি অংশ। এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে এই হট্টগোল হয়।
এ ঘটনায় আহত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মাহবুবুর রহমান শান্তের করা মামলায় পরদিনই গ্রেপ্তার করা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সিলেট জেলার আহ্বায়ক আক্তার হোসেনকে।
যদিও তিনি জামিন পেয়েছেন ইতোমধ্যে। একইভাবে দল মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হামলায় শিকার হন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম।
এছাড়াও গত ২০ মার্চ বরিশাল ক্লাবে জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে হেনস্তাসহ বৈষম্যবিরোধী এবং এনসিপির দুটি গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি সংঘটিত হয়। এভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুখোমুখি হচ্ছেন জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
এই তো মাত্র কয়েক মাস আগেই একসঙ্গে মৃত্যুঝুুঁকি উপেক্ষা করে বুলেটের মুখে দাঁড়ালেও এখন কথা বলতে কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম কখন করলেও ছাত্র আন্দোলনের অনেকেই সেই প্লাটফর্মে যোগ দেননি।
শুধু তাই নয়, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয়, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এবং সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের লক্ষ্যে গঠিত হয় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ঢাক-ডোল পিটিয়ে বিশাল আড়ম্বরের মধ্য দিয়ে জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া একঝাঁক সামনের সারির যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত হয় দলটি। তবে, দল গঠনের কিছু দিন পর থেকেই তাদের নানা ইস্যুতে অসন্তোষ প্রকাশ্যে আসতে থাকে। প্রশ্ন, নতুন দলের ভেতর আস্থা সংকট বা অন্তর্কোন্দলে কারা সুবিধা পাবে এবং লাভবান হবে!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মাদ মাহবুবুর রহমান বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের তরুণদের নেতৃত্বে রজনৈতিক দল নতুন আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে জনগণের কাছে এসেছে। নতুন যেকোনো রাজনৈতিক দল তাদের যাত্রা শুরু করলে এবং দেশজুড়ে তাদের কর্মী-সমর্থক বাড়তে থাকলে কিছু বিষয়ে বিভেদ-বিতর্ক সৃষ্টি হয়ে থাকে।
একইসাথে, রাজনৈতিক দলে পদ-পদবি নিয়ে কিছুটা অন্তর্কোন্দল থাকবে এটা দোষের কিছু নয়। তবে, তাদের ওপর অনেক আশা করে দেশের সাধারণ মানুষ। সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে আরও সচেতন হওয়া জরুরি। কি বলা উচিত এবং কি বলা উচিত নয়, সে বিষয়ে নজর দিতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠনের এক-সপ্তাহের মাথায় দল থেকে পদত্যাগ করেন তিন নেতা। এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবু হানিফ, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (উত্তর অঞ্চল) হানিফ খান সজিব ও যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুজ জাহের। সবাই ব্যক্তিগত কারণ দেখান।
এনসিপির সাবেক যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবু হানিফ বলেন, আমি ব্যক্তিগত কারণে দল থেকে পদত্যাগ করেছিলাম। তবে, তাদের ভেতর অন্তর্কোন্দল হওয়ার কারণ হিসেবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়, জেলা থেকে নানা এলাকায় কমিটি দেওয়ার সময় আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যথার্থ যোগাযোগের ঘাটতি থাকছে।
অনেক ক্ষেত্রে জুলাই আন্দোলনের নেতাদের সঠিক স্থানে স্থান না দিয়ে অন্যদের আনা হচ্ছে। ফলে, তাদের ভেতর কোন্দল সেটি প্রকট হচ্ছে। একটি রাজনৈতিক দলে পদ-পদবির সুষ্ঠু বণ্টন না থাকলে এ ধরনের প্রতিযোগিতা ও অসন্তোষ থাকবে সেটা স্বাভাবিক।
এদিকে, দলটি আত্মপ্রকাশের মাত্র ৫ দিন পরই ৫ মার্চ রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হামলায় শিকার হন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। একটি রাজনৈতিক দলকে অভিযুক্ত করা হলেও নানা মহলে বিভিন্ন গুঞ্জন ওঠে।
ঢাবি সিন্ডিকেট এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয় সামনে আনে অনেকে। গত ২০ মার্চ বরিশাল ক্লাবে জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে হেনস্তাসহ বৈষম্যবিরোধী এবং এনসিপির দুটি গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি সংঘটিত হয়। যেখানে দল থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থার হুমকি দিয়েও কোনোভাবে থামানো যায় না।
চারদিকে যখন আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তাতে ঘি ঢালে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে এনসিপির মুখ্য সংগঠক নাসির উদ্দীন পাটোয়ারীর ফেসবুক পোস্ট। তার এমন বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে নানা মহলে সরাসরি এনসিপির রাজনৈতিক পক্বতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একইসাথে প্রশ্ন উঠে দলে সমন্বয়হীনতা নিয়েও।
যদিও পরে তার ফেসবুক পোস্টটি রিমুভ করে আরও একটি পোস্টের মাধ্যমে তার অবস্থান পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন পাটোয়ারী। এ বিষয়ে এনসিপির শীর্ষ কয়েকজন নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, তার এই মতামত সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। এর সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত মতামত দলের সার্বিক অবস্থান নয়।
এনসিপির নেতাদের চলমান ইস্যুর ভেতর দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ ঘিরে ফেসবুক পোস্ট নিয়ে। আলোচনা-সমালোচনা যখন তুঙ্গে তখন আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের জন্য চাপ দেওয়ার অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম একটি পোস্টে।
একইসঙ্গে ১১ মার্চ সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহর দেওয়া ফেসবুক পোস্টের সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করেন তিনি। যেখানে হাসনাতের দেওয়া পোস্টের কিছু জায়গায় সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন এনেছেন সারজিস।
চলমান ইস্যুতে, সাবেক উপদেষ্টা ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানান, যে ঘটনাগুলো হচ্ছে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কিছুই নয়। এনসিপি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজের পক্ষে।
এ দেশের তরুণদের বিশেষ করে জেনজিদের নজিরবিহীন ত্যাগের মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। সম্প্রতি ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ষড়যন্ত্র চলছে। কোনোভাবেই যদি ফ্যাসিবাদকে আবার পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করা হয়- তাহলে এনসিপি তাদের রুখে দেবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যৌথ উদ্যোগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। দলটির একাধিক শীর্ষপদে আসেন জুলাই-আগস্টে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা। দলের আহ্বায়ক হন নাহিদ ইসলাম। নতুন দলের এক মাস পূর্তি এখনো হয়নি। তার আগেই নেতৃত্বের মধ্যে মতান্তরের দিকটি প্রকাশ্যে চলে এসেছে।
আপনার মতামত লিখুন :