ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল-২ আওতাধীন ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের একটি সড়কে অবৈধভাবে রাস্তার কাজ করছে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অবৈধভাবে কাজ করা ‘স্যামকো ইঞ্জিনিয়ার্স’ নামের প্রতিষ্ঠানটি আবার হয়রানি করছে বৈধ স্থাপনার মালিকদের।
অত্র এলাকার বাসিন্দা এবং ওই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, অবৈধ স্থাপনার প্রভাবশালী দখলদারদের যোগসাজশে বৈধ স্থাপনা ভাঙার পরিকল্পনা করছেন তিনি। ঠিকাদারের পক্ষ নিয়ে ভুক্তভোগীদের সহযোগিতা না করার অভিযোগও উঠেছে ডিএনসিসির বিরুদ্ধে। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের একাধিক চিঠির পরেও সাড়া দেয়নি সিটি করপোরেশন। এমন প্রেক্ষাপটেই, অবৈধ স্থাপনার প্রভাবশালীরা হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
সরেজমিনে পরিদর্শনে জানা যায়, মিরপুর ১০ নম্বরের ব্লক-এ জুটপট্টি এলাকার হোল্ডিং নম্বর ৫৬ থেকে লাইন নম্বর ১৮, হোল্ডিং নম্বর ১০ পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণ বরাবর সড়কটির প্রশস্ততা ৪০ ফুট। তবে সড়কটির পূর্ব পাশের প্রায় ২০ ফুট প্রশস্ত অংশ দীর্ঘদিন অবৈধ স্থাপনা করে ভোগদখল করছে স্থানীয়দের প্রভাবশালী একটি মহল।
পাশাপাশি সড়কটির দৈর্ঘ্যরে ৮০০ ফুট অংশ পার্শ্ববর্তী বিহারি ক্যাম্পের একাধিক নেতা দখল করে দোকানপাট, অফিস এবং বাড়ি করেছেন। অন্যদিকে সড়কের প্রশস্ততার ৪০ ফুট অংশের বাইরে ৯ ফুট প্রশস্ততার শূন্য দশমিক পাঁচ নয় (০.৫৯) কাঠা জমি জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ খণ্ড জমি হিসেবে বরাদ্দ দিয়েছে একাধিক ব্যক্তিকে।
বৈধভাবে বরাদ্দপ্রাপ্ত এসব ব্যক্তিরা বাস্তব দখল হস্তান্তরসহ লিজ দলিল সম্পাদন করে সেগুলো ভোগ দখল করছেন। কেউ কেউ সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। তবে সড়কটির উন্নয়নে আসা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘স্যামকো ইঞ্জিনিয়ার্স’ পূর্ব পাশের অবৈধ স্থাপনার বদলে পশ্চিম পাশের বৈধ স্থাপনা ভাঙার চেষ্টা করছেন।
সিটি করপোরেশন বা যথাযথ কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই বেআইনিভাবে পশ্চিম অংশের বেশি কছু স্থাপনা ইতিমধ্যে বুলডোজার দিয়ে ভেঙেও ফেলেছেন তিনি। আর যাদের স্থাপনা ভাঙতে পারেননি, বিহারি প্রভাবশালীদের সঙ্গে মিলে প্রতিনিয়ত হুমকি দিচ্ছেন তাদের । এমনকি বৈধ স্থাপনার মালিকদের নির্মাণ কাজেও বাধা দিচ্ছেন স্যামকো ইঞ্জিনিয়ার্সের স্বত্বাধিকারী ও অত্র এলাকার বাসিন্দা ফজলে আকবর মিঠু।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সিটি করপোরেশনের অনুমোদন ছাড়াই বেআইনিভাবে সড়কটির উন্নয়নে কাজ করছে মিঠুর স্যামকো ইঞ্জিনিয়ার্স। ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর ১ কোটি ২২ লাখ ৫২ হাজার ৪৫২ টাকা চুক্তিমূল্যে কাজটির কার্যাদেশ পায় ‘ইয়েস বিল্ডার্স’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০২৪ সালের ৫ মার্চের মধ্যে কাজটি শেষ করার কথা থাকলেও পারেনি ইয়েস বিল্ডার্স।
পরবর্তী সময়ে ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের পর ইয়েস বিল্ডার্সের থেকে কাজটি কিনে নেয় স্যামকো ইঞ্জিনিয়ার্স। তবে এ বিষয়ক যথাযথ প্রক্রিয়ায় ডিএনসিসির অনুমোদন নেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। উপরন্তু সড়কটির প্রায় ২০টি স্থাপনা নিজেই ভেঙে ফেলেছেন মিঠু। এ জন্য গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, রাজউক বা সিটি করপোরেশন; তথা সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থারই অনুমোদন নেননি তিনি।
পরিচয় গোপনের শর্তে, ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এভাবে কাজ হস্তান্তর হলে সিটি করপোরেশনকে জানাতে হয়। তারপর কিছু আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। কিন্তু স্যামকো সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি। স্যামকো সেখানে যে কাজই করবে, সেটা অবৈধ। স্থাপনা ভাঙার কাজটিও অবৈধ। সড়কটি গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের থেকে বুঝে নিয়েছে ডিএনসিসি। কোনো স্থাপনা ভাঙার হলে সিটি করপোরেশন অথবা গৃহায়ণ থেকে আপত্তি আসতে পারে। গৃহায়ণের জায়গায় অবৈধ স্থাপনা হলে তারা দেখবে, ডিএনসিসির জায়গায় হলে আমরা দেখব। কিন্তু মিঠু সাহেব, কোনো কথা শোনেন না। তাকে কয়েকবার বলেও লাভ হয়নি।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে স্যামকো ইঞ্জিনিয়ার্সের স্বত্বাধিকারী ফজলে আকবর মিঠুর সঙ্গে গত সোমবার যোগাযোগ করা হলে মুঠোফোনে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। অবৈধভাবে কাজ করা এবং স্থাপনা ভাঙার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজন দেখছি না।’
এদিকে, সৃষ্ট জটিলতায় ডিএনসিসির সঙ্গে যৌথভাবে সার্ভে করার উদ্যোগ নিয়েছে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মিরপুর গৃহসংস্থান বিভাগ-২। উক্ত বিভাগ থেকে সার্ভের আগ পর্যন্ত কাজ বন্ধ রাখতে বলা হলেও, আমলে নেননি ঠিকাদার মিঠু। পাশাপাশি সার্ভের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানে ডিএনসিসির সহযোগিতা পাচ্ছে না মিরপুর গৃহসংস্থান বিভাগ-২। বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় ডিএনসিসির অঞ্চল-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবর দফায় দফায় চিঠি দিয়েছে।
এমন অন্তত তিনটি চিঠির কপি রয়েছে রূপালী বাংলাদেশের কাছে। যৌথ জরিপের মাধ্যমে রাস্তার এলাইনমেন্ট নির্ধারণের জন্য অঞ্চল-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবর গত বছরের ৫ নভেম্বর এবং চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি চিঠি দেন গৃহায়ণের নির্বাহী প্রকৌশলী। উভয় চিঠিতেই গৃহায়ণের পক্ষ থেকে একজন করে উপসহকারী প্রকৌশলী এবং সার্ভেয়ার পদমর্যাদার প্রতিনিধির তালিকাও দেওয়া হয়।
এসব চিঠিতে সাড়া না পেয়ে গত ২০ ফেব্রুয়ারি ডিএনসিসির অঞ্চল-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবর আরও একটি চিঠি দেয় মিরপুর গৃহসংস্থান বিভাগ-২। সেই চিঠিতে উল্লেখ করা হয় যে, ‘(সড়কের) অবৈধ দোকানসমূহ অপসারণ ব্যতীত ঠিকাদার (স্যামকো) কর্তৃক বৈধ বরাদ্দ ও দখল প্রদানকৃত জমির উচ্ছেদের প্রচেষ্টাসহ রাস্তা নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছে।
ফোনালাপকালে ঠিকাদারি কর্তৃক কাজ বন্ধ করে যৌথভাবে সার্ভে করার জন্য বলা হলেও, অদ্যাবধি ঠিকাদার কর্তৃক কাজ চলমান রয়েছে। যৌথ সার্ভে ব্যতীত রাস্তার কাজ করা হলে পরবর্তী সময়ে নানারূপ জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে।’ ওই তিনটি চিঠিতেই স্বাক্ষর করেন গৃহায়ণের নির্বাহী প্রকৌশলী কাওসার মোর্শেদ।
নির্বাহী প্রকৌশলী কাওসার মোর্শেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, যতটুকু মনে পড়ে ওই ঠিকাদার দুষ্টু প্রকৃতির। সিটি করপোরেশনকে বারবার বলার পরেও উল্লেখযোগ্য কোনো সাড়া পাইনি। ওদের (ডিএনসিসি) বলা হলে ‘দেখব, দেখছি’ বলে। কথা হলো, জমি আমার (গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ), ব্যবহারের জন্য সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করেছি। ওরা যদি কোনো সমস্যায় পড়ে, আমাদের থেকে ডিমার্কেশন তো নেবে।
কাকে কতটুকু জমি দিয়েছি, তারা তো জানতে চাইবে। তা না করে তাদের খুশিমতো কাজ করছে। অন্যদিকে দেখা যায় যে, একদিকে বস্তি আছে কিন্তু বস্তিকে (ঠিকাদার) সাহায্য করছে, এদিক দিয়ে রাস্তা করতেছে। মূলত সমস্যা হয়েছে এটা নিয়েই। তবে ভুক্তভোগীরা উচ্চ আদালতে একটি রিট করেছেন বলে শুনেছি।
ডিএনসিসির অসহযোগিতার বিষয়ে জানতে চাইলে অঞ্চল ২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী (পুরো) আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্রায় তিন সপ্তাহ আগে দায়িত্ব নিয়েছি, কিন্তু এই ঘটনাগুলো আমি দায়িত্বে আসার আগেই হয়েছে। বিস্তারিত এখনো জানি না। গৃহায়ণের সঙ্গে সভা করব এবং বিস্তারিত জেনে সব পক্ষকে নিয়ে বিষয়টি সমাধানে কাজ করব।