আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবাদুল করিম বুলবুল। একই সঙ্গে তার পারিবারিক কোম্পানি বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের (পিএলসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন কেন্দ্রীয় যুব লীগের উপদেষ্টা তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই ২০১৭ সালে হংকংয়ে অর্থ পাচারের পর দ্বিতীয়বার শেয়ার কারসাজির অভিযোগ উঠেছে তিনিসহ তার পরিবারের বিরুদ্ধে।
সাবেক এই সংসদ সদস্যের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে ওরিয়ন গ্রুপ এবং কোহিনূর কেমিক্যালস কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড। এছাড়া বীকন ডেভেলপমেন্টস লিমিটেড এবং বীকন পয়েন্ট লিমিটেডেরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওরিয়ন গ্রুপ ও বিকন ফার্মার শেয়ার কারসাজিতে জড়িত তিনিসহ তার পরিবার।
জেমিনি সি-ফুডের শেয়ার কারসাজি করায় তার পরিবারের ৫ সদস্যকে ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তার আগে ওরিয়ন গ্রুপের শেয়ার কারসাজি করায় তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে গত ডিসেম্বর মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের মাকসুদ কমিশন ৬৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করে।
সেই অভিযোগ না কাটতেই নতুন করে ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে ২০১৭ সালে এইচএসবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে হংকংয়ে কোম্পানি খুলে অর্থ পাচার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: অর্থ পাচারসহ তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ খণ্ডন এবং আরও তথ্য জানাতে এবাদুল করিম বুলবুলের ফোন নম্বর ও হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে তার প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করা হলেও তথ্য দিতে কেউ আগ্রহ প্রকাশ করেনি।
তারপর ফোনে যোগাযোগ করা হয় কোহিনুর ক্যামিক্যালস লিমিটেডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট গোলাম কিবরিয়া সরকারের সঙ্গে। তিনি দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের প্রতিবেদককে বলেন, ‘তিনি কোথায় আছেন, আমি জানি না। দেশে বা বিদেশে সে সম্পর্কেও আমি অজ্ঞ।’ তবে কথার ফাঁকে তিনি নিজেকে ‘আইনজীবী’ দাবি করেন এবং বিভিন্ন শব্দের অপব্যাখ্যা করে প্রতিবেদককে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করেন।
হংকংয়ে ২৮৮ কোটি টাকা পাচার: বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ছাড়াই ২০১৬ সালের ২৩ আগস্ট হংকংয়ে বীকন এশিয়া প্যাসিফিক নামে একটি কোম্পানি খোলেন সাবেক এই সংসদ সদস্য। হংকংয়ের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির সনদে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও নাম আছে মোহাম্মদ এবাদুল করিমের। ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে হংকংয়ের নাথান রোডের বেল হাউস।
২০১৬ সালে বীকন এশিয়া প্যাসিফিকের নামে হংকংয়ের এইচএসবিসি ব্যাংকের একটি শাখায় অ্যাকাউন্ট খোলেন তিনি। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ২৮৮ কোটিরও বেশি টাকা এইচএসবিসি ব্যাংকের ওই শাখায় হস্তান্তর করেন বুলবুল।
মূলত হংকংয়ের প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগের জন্য এই টাকা পাঠানো হয়। এ ছাড়া আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বীকন গ্লোবাল অপারেশন এফজেডসি নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়, যার লেনদেন চলে দুবাইয়ের মাশরেক ব্যাংকে।
জেমিনি সি ফুডে কারসাজি: পুঁজিবাজারে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেমিনি সি ফুড লিমিটেড। কোম্পানিটির শেয়ার কারসাজির অভিযোগে পাঁচ ব্যক্তিকে মোট ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি। বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এম) মোহাম্মদ এবাদুল করিমসহ তার পারিবারিক সহযোগীরা কারসাজিতে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ।
২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ মে পর্যন্ত সময়ে জেমিনি সি ফুডের শেয়ারের দাম যোগসাজশ করে বাড়ানো হয় এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত সাপেক্ষে কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় এনেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। বিএসইসির খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন সম্প্রতি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ মে পর্যন্ত সময়ে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেমিনি সি ফুডের শেয়ারের দাম কারসাজি করে বাড়ানোর দায়ে পাঁচ ব্যক্তিকে জরিমানা করা হয়েছে।
এর মধ্যে মোহাম্মদ এবাদুল করিমকে ১১ লাখ টাকা, তার মেয়ে রিসানা করিমকে ২ দশমিক ১২ লাখ টাকা, তার ছেলে উফাত করিমকে ১ দশমিক ৪১ লাখ টাকা, তার শ্যালক সোহেল আলমকে ১০ লাখ টাকা ও ফাতেমা সোহেলকে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সে হিসাবে আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার কারসাজির জন্য মোট ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
কারসাজিতে জড়িতদের পরিচিতি: বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ এবাদুল করিম। তিনি ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ব্রাক্ষণবাড়িয়া-৫ আসনে নির্বাচিত হন। ওরিয়ন গ্রুপের কোম্পানিগুলোর পর্ষদে তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
এবাদুল করিমের ছেলে উলফাত করিম। তিনি কোম্পানিটির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর তার মেয়ে রিসানা করিম। তিনি কোম্পানিটির ম্যানেজমেন্টে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া মোহাম্মদ এবাদুল করিমের শ্যালক সোহেল আলম। তিনি আগে বিকন ফার্মারসিউটিক্যালসের পরিচালক ছিলেন। ফাতেমা সোহেল মোহাম্মদ এবাদুল করিমের আত্মীয়।
এর আগে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ ও ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেডের শেয়ার কারসাজি করার দায়ে মোহাম্মদ এবাদুল করিমকে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রী নুরুন নাহার, তার মেয়ে ও তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়।
ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার কারসাজি: ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে সাত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৬১ কোটি ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি। কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে সর্বোচ্চ ১৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে সোহেল আলম নামের এক ব্যক্তিকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে এখলাসুর রহমান নামে অপর এক ব্যক্তিকে।
তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে বীকন ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ এবাদুল করিমকে। এ ছাড়া রিসানা করিমকে ৬ কোটি টাকা, বীকন মেডিকেয়ারকে সাড়ে ৫ কোটি টাকা, বীকন ফার্মাকে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা ও নুরুন নাহার করিমকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
আপনার মতামত লিখুন :