সোমবার, ৩১ মার্চ, ২০২৫

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তে কাজ শুরু

সেলিম আহমেদ

প্রকাশিত: মার্চ ২৮, ২০২৫, ০৬:৩১ এএম

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তে কাজ শুরু

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

 স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হলেও এখনো পূর্ণতা পায়নি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। বিগত সব সরকারের আমলেই একের পর এক লম্বা হয়েছে এই তালিকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো অবদান না রেখেই অনেকে নানা কৌশলে হয়েছেন তালিকাভুক্ত। 

তালিকাভুক্ত হয়েই থেমে যাননি, সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সন্তান-সন্তানাদিকে চাকরি, নানা সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি আধিপত্য বিস্তার করে হয়রানি করেছেন সাধারণ মানুষকে। এ নিয়ে অতীতের কোনো সরকার কথা না বললেও বেঁকে বসেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। 

দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় শুদ্ধি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিপ্রাপ্তদের সত্যতা যাচাইসহ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায়ও পরিবর্তন আনার কাজ করছে সরকার। 

এই সংজ্ঞা পরিবর্তন হলে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন এবং যাঁরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন শুধু তাঁরাই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার’ স্বীকৃতি পাবেন। এর বাইরে যাঁরা দেশে-বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, বিশ্বজনমত তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁরা হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ১০ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ও ১০ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টি বোর্ড ও নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠন করে। 

এই কমিটি পুনর্গঠনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাচাইয়ে কাজ শুরু করা হয়। এদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, মূলত যারা রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, কেবল তারাই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন। বাকি যারা নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন তারা হবেন মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট প্রথম মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়ন করে ১৯৮৮ সালে। তখন তালিকায় স্থান পান ৭০ হাজার ৮৯২ জন মুক্তিযোদ্ধা। তবে এর আগে ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় কমিটির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় ১ লাখ ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম। 

মূলত এরশাদ সরকারের সময়ে ১৯৮৪ সালে প্রথম মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। এ লক্ষ্যে একটি জাতীয় কমিটি গঠিত হয়। এর আওতায় শেখ মুজিব সরকারের সময় গঠিত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট সংগৃহীত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা, চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের (ইবিআরসি) তালিকা এবং ভারত থেকে প্রাপ্ত তালিকা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা তালিকা তৈরির কাজ হাতে নেওয়া হয়। তবে এই তালিকা গেজেটে স্থান পায়নি। 

২০০১-০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাদত হুসাইনকে আহ্বায়ক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মমতাজউদ্দিনকে সদস্যসচিব করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি ২ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করে। চতুর্থ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৪৫২ জন মুক্তিযোদ্ধা। 

১৯৯৮-২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মুখপত্র ‘মুক্তিবার্তা’য় এ তালিকা স্থান পায়। ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের সময় প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯৮ হাজার। 

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০২৩ সালে সর্বশেষ তালিকা, যেটি সমন্বিত তালিকা হিসেবে পরিচিত তাতে স্থান পায় ২ লাখ ৮ হাজার ৮৫১ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম। এর মধ্যে খেতাবপ্রাপ্ত, শহিদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১২ হাজার ৫৭৯। 

বর্তমানে এই ২ লাখ ৮ হাজার ৮৫১ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা হারে সম্মানি ভাতা পাচ্ছেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ৯৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। 

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়: অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ৯৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই করছে খবর পেয়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকেই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতে শুরু করে। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যূনতম কোনো অবদান না রেখেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে নানা সুযোগ-সুবিধা নেওয়াসহ আধিপত্য বিস্তার করে হয়রানি করেন এমন অমুক্তিযোদ্ধাদের প্রমাণসহ তাদের তালিকা থেকে বাদ দিতে আবেদন করেন অনেকেই। সেই তালিকা ধরে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

মুক্তিযুদ্ধবিয়ষক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) সূত্র জানায়, বিগত তিন মাসে প্রায় ২২ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে আবেদন জমা পড়েছে। এখন প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্ত থেকে একের পর এক আসছে আবেদন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে এই সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জামুকা সূত্র বলছে, যেসব মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে অভিযোগ আসছে তাদের তথ্য যাচাই করতে প্রাথমিকভাবে সরেজমিন শুনানি হবে। অভিযোগ আসা অব্যাহত থাকলে বাতিলের লক্ষাধিক আবেদন জমা পড়তে পারে। এদিকে সরকারের ডাকে সারা দিয়ে স্বেচ্ছায় ১২ অমুক্তিযোদ্ধা তাদের সনদ বাতিলের আবেদন করেছেন। 

জামুকার মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন বলেন, যাদের বিষয়ে অভিযোগ আসছে তাদের তথ্যগুলো সঠিকভাবে যাচাই করা হবে। যাচাই-বাচাইয়ে ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যাচাই করা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিপ্রাপ্তদের তালিকা: দায়িত্ব গ্রহণের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম গত ১৪ আগস্ট সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কর্মরতদের তালিকা প্রণয়নের নির্দেশ দেন। পরদিন সরকারের ৬২ মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে তালিকা পাঠাতে চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়। 

চিঠিতে সরকারি চাকরিতে প্রথম (ক্যাডার ও নন-ক্যাডার) দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন তাদের জীবনবৃত্তান্তসহ পূর্ণাঙ্গ তথ্য চাওয়া হয়। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের পিতা/মাতা/পিতামহ/মাতামহের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট নম্বর এবং চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার তথ্যও উল্লেখ করতে বলা হয়। 

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এই চিঠির আলোকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিরত ৮৯ হাজার ২৩৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর তথ্য পাঠায়। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৯ হাজার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর তথ্য যাচাই সম্পন্ন করেছে মন্ত্রণালয়টির যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) এসএম রফিকুন্নবীর নেতৃত্বে ১৮ জন কর্মকর্তা। 

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই তালিকা যাচাই করতে গিয়ে অনেকের খোঁজ পাওয়া গেছে যারা ভুয়া সনদ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন। তালিকা যাচাই চূড়ান্ত হলে এসব ভুয়া সনদে বা সনদ জালিয়াতি করে চাকরি নেওয়াদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। সেই তালিকার আলোকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এসএম রফিকুন্নবী বলেন, যে গতিতে কাজ করা হচ্ছে তাতে আগামী দুই মাসের মধ্যে যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায়ও আসছে পরিবর্তন, শিগগিরই অধ্যাদেশ: মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। 

ইতোমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে নতুন সংজ্ঞার খসড়াও। এতে যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন এবং যাঁরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, শুধু তাঁরাই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার’ স্বীকৃতি পাবেন। এর বাইরে যাঁরা দেশে-বিদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, বিশ্বজনমত তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁরা হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। 

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন সংশোধন করে নতুন অধ্যাদেশ মাধ্যমে এই সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যে এই অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। 
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!