কিছুতেই থামছে না মহাসড়কে অবৈধ থ্রি-হুইলারের দৌরাত্ম্য। প্রশাসনের অভিযানের পরও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব যানবাহন। নিষিদ্ধ ঘোষিত তিন চাকার এসব যানবাহনের বেপরোয়া গতি আর নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। পাশাপাশি প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। বেড়ে চলেছে প্রাণহানি।
বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম, বরিশাল-পটুয়াখালী, মানিকগঞ্জ, রংপুর, গাজীপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মহাসড়কে থ্রি-হুইলারের যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে প্রাণহানি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের হবিগঞ্জ অংশে অটোরিকশার কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা।
লক্ষ্মীপুর, জয়পুরহাট, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, মাগুরার মহাসড়কেও একই চিত্র। এমতাবস্থায় ঈদে ঘরমুখো মানুষের নিরাপদ যাত্রায় শঙ্কা দেখছেন পরিবহনসংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, থ্রি-হুইলারচালকেরা রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় কোনো নিয়ম মানেন না।
যখন যেভাবে খুশি তারা গাড়ি চালান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচল বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মহাসড়কে নির্দিষ্ট গতির নিচে কোনো যান চলতে দেওয়া উচিত নয় এবং বিকল্প সড়ক ব্যবহারের নির্দেশনা কার্যকর করতে হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহনের কারণে ৭৫৮টি দুর্ঘটনা ঘটে। বিআরটিএর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছর থ্রি-হুইলার বা তিন চাকার যানবাহনের কারণে শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৯৮টি দুর্ঘটনায় ৮৯ জন নিহত ও ২৭৫ জন আহত হয়েছে।
ঢাকা-পাটুরিয়া মহাসড়কে ৭৮টি দুর্ঘটনায় ৩৬ জন নিহত ও ১০০ জনের বেশি আহত হয়েছে। এ ছাড়া গাজীপুর এলাকায় ৮৭টি দুর্ঘটনায় ৪৮ জন নিহত ও ১৩৫ জন আহত হয়েছে। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছর ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে ৬৮টি দুর্ঘটনায় ৩২ জন নিহত ও ৯০ জন আহত হয়। বরিশাল বিভাগে ৯৫টি দুর্ঘটনায় ৪৩ জন নিহত ও ১৪২ জন আহত হয়।
মহাসড়কে থ্রি-হুইলার যান চলাচলে সমস্যার কথা তুলে ধরে পরিবহন সংশ্লিষ্ট চালক-শ্রমিকরা বলেন, মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচল করায় বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে আমাদের। এসব যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে না পারলে সড়কে ভোগান্তি কমবে না, বরং দিন দিন বাড়তেই থাকবে।
তাদের অভিযোগ, মহাড়কে থ্রি-হুইলার উল্টো-সোজা সব পথেই চলছে। সড়কে কোনো সিগন্যাল না দিয়ে যেখানে-সেখানে যাত্রী নিয়ে পার্কিং করে দাঁড়িয়ে যায়। এতে মহাসড়কে বড় গাড়ি চালাতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় চালকদের।
হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, মহাসড়ক বা হাইওয়েতে ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলারের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। ফিডার রোডে চলতে পারবে থ্রি-হুইলার। ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে মহাসড়কগুলো হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি জেলা পুলিশের সমন্বয় করে নিরাপত্তাব্যবস্থা সাজানো হয়েছে।
অতিরিক্ত ৭০০ ফোর্স বাড়ানো হয়েছে। ৩ হাজার ৯০০ কিলোমিটার মহাসড়ক সাড়ে ৩০০-র বেশি টহলদল কাজ করছে। ঈদ যত সন্নিকটে আসবে, এই টহলসংখ্যা তত বাড়বে। তারা ১৫ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছবে। এদিকে মহাসড়কে ১৩৯টি হাটবাজার রয়েছে।
সেগুলোর অধিকাংশই ইতিমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অপসারণ করা হয়েছে। আর কিছু রয়েছে, যা অপসারণের কাজ চলছে বলে জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। এ ছাড়া মোটরসাইকেল পেট্রোলিং, ড্রোন মনিটরিং ও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে মহাসড়কে শৃঙ্খলা রক্ষা করা হচ্ছে।
খোলা ট্রাক ও ছাদে ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে যাত্রীসাধারণকে। ওভারটেকিং এবং অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি না চালাতেও বলা হয়েছে। চালকদের ক্লান্ত অবস্থায় গাড়ি চালাতে নিষেধ করা হয়েছে। লাইসেন্সবিহীন চালকদের দিয়ে গাড়ি না চালাতে পরিবহন মালিকদের বলা হয়েছে।
গত ২৫ মার্চ রাতে দৌলতদিয়া এলাকায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে মাহেন্দ্র ও প্রাইভেট কারের মুখোমুখি সংঘর্ষে আহত হন পাঁচজন। ওই এলাকার বাসচালক আব্দুর রহমান বলেন, থ্রি-হুইলারগুলো মহাসড়কে চলার কারণে বেশির ভাগ দুর্ঘটনাগুলো ঘটে।
এরা যেখানে-সেখানে ওভারটেকিং করে, যেখানে-সেখানে যাত্রী নামায় ও মোড় টার্নিং নেয়, এরা সড়কে কোনো সিগন্যাল মানে না, উল্টাপাল্টা রাস্তা ক্রসিং করে। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটলে দোষ হয় আমাদের বড় গাড়ির চালকদের।
আরেক বাসচালক মো. এনায়েত বলেন, মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলার কারণে আমাদের গাড়ি চালাতে খুব সমস্যা হয়। কারণ থ্রি-হুইলার চালকদের কোনো ড্রাইভিং দক্ষতা বা লাইসেন্স নেই। তারা সড়কে গাড়ি চালানোর নিয়ম-নীতি বোঝেন না।
এ ঈদের সময় তারা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। যে কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। আমার দাবি, মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধ করা হোক। গত ১৮ মার্চ মঙ্গলবার ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী মহাসড়কের লক্ষ্মীপুর ডেবাডাঙ্গী এলাকায় ট্রাক ও থ্রি-হুইলারের (পাগলু) মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই যুবক নিহত হন। এ ঘটনায় শিশুসহ আহত হয়েছেন আরো ৬ জন।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার ভোরে বরিশাল-পটুয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের দপদপিয়া ইউনিয়নের নলছিটি জিরো পয়েন্ট ও খেজুরতলার মাঝামাঝি স্থানে ট্রাক ও থ্রি-হুইলারের সংঘর্ষে এক ব্যক্তি নিহত হন।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার দুপুরে ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে মাঝকান্দি-বোয়ালমারী-ভাটিয়াপাড়া আঞ্চলিক সড়কের বাইখির-বনচাকি মাদরাসার সামনে ইটবোঝাই থ্রি-হুইলার (খেক্কর) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে এক চালক নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন থ্রি-হুইলারে থাকা আরো দুই শ্রমিক।
জানা গেছে, গত দুই মাসে ঢাকা-শেরপুর মহাসড়কে ১৫ এবং কুষ্টিয়ার মহাসড়কে ১৬ জন নিহত হয়েছেন। ব্যস্ততম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে ১০৫ কিলোমিটার এলাকায় অবাধে চলছে থ্রি-হুইলার।
গত এক বছরে ১৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয় ১৫২ জনের। হাইওয়ে কুমিল্লা রিজিয়নের পুলিশ সুপার মো. খাইরুল আলম বলেন, এ পর্যন্ত আমরা অবৈধ ১৩৯৯৩টি থ্রি-হুইলার আটক করা হয়েছে। এগুলো যেন মহাসড়কে না ওঠে সে বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
থ্রি-হুইলার বেপরোয়া ঢাকা-বরিশাল ও বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কে : বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের মহাসড়কে বাড়ছে যানবাহনের চাপ। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ নছিমন, টমটম আর ভটভটি।
কিন্তু সে তুলনায় সড়কের প্রশস্ততা না বাড়ানোর কারণে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। এ ছাড়া সর্বদক্ষিণের জেলা পটুয়াখালী-কুয়াকাটা আঞ্চলিক মহাসড়কেও চলছে ব্যাটারিচালিত মাহিন্দ্রা, সিএনজি, অটোরিকশা, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন ধরনের তিন চাকার যান।
জানা গেছে, চলতি মাসে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কে অন্তত ১৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত হয় সাতজন, আহত হয় অন্তত অর্ধশত।
সাকুরা পরিবহনের চালক জালাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা ঢাকা থেকে যাত্রী নিয়ে কুয়াকাটা যাই। পথে মহাসড়কে অটোরিকশা যেখানে-সেখানে ব্রেক করে, এতে আমাদের গাড়ি চালাতে খুব সমস্যা হয়। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। মশিউর রহমান নামে এক ট্রাকচালক বলেন, মহাসড়কে থ্রি-হুইলারের কারণে আমাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় পর্যটন নগরী কুয়াকাটার সঙ্গে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার সড়কপথে বাড়ছে পরিবহনের সংখ্যা। প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন বিলাসবহুল বাস। কিন্তু থ্রি-হুইলারের যানবাহনের কারণে প্রতিদিন ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা।
শ্যামলী পরিবহনের চালক মো. আসলাম বলেন, এসব থ্রি-হুইলার যানবাহন ট্রাফিক আইন মানে না, যার ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এগুলো ধীরগতির যান, আবার হঠাৎই দ্রুতগতির গাড়ির সামনে চলে আসে। অনেক সময় আমরা সতর্ক থাকলেও সব সময় ব্রেক কষে থামা সম্ভব হয় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচল বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মহাসড়কে নির্দিষ্ট গতির নিচে কোনো যান চলতে দেওয়া উচিত নয় এবং বিকল্প সড়ক ব্যবহারের নির্দেশনা কার্যকর করতে হবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, থ্রি-হুইলার হঠাৎ রাস্তার পাশে চলে এলে বাস বা দ্রুতগতির বড় গাড়ির চালকরা খেই হারিয়ে ফেলেন এবং দুর্ঘটনা ঘটে যায়। মহাসড়কে নির্দিষ্ট গতির নিচে কোনো যান চলতে দেওয়া উচিত নয়। এতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি দুটোই কমবে।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ পথে মোটরসাইকেলে করে যাওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে যারা বাড়তি আয়ের আশায় তেমন অভিজ্ঞতা ছাড়াই মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন, তারা মহাসড়কে বড় ধরনের বিপদের কারণ হতে পারেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব মো. সাইফুল আলম জানান, এ বছর মহাসড়কের অবস্থা ভালো। তবে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এখন বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে। আমরা আমাদের চালকদের সতর্ক হয়ে গাড়ি চালানোর নির্দেশনা দিয়েছি।
হাইওয়ে পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি দেলোয়ার হোসেন মিঞা বলেন, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে থ্রি-হুইলারগুলো যেন মহাসড়কে না ওঠে সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমাদের সদস্যরা কাজ করছেন। ফিডার রোডে থ্রি-হুইলার চলতে পারবে।
কিন্তু হাইওয়ে উঠলেই তা অবৈধ হয়ে যাবে। থ্রি-হুইলার মহাসড়কে চলার কোনো অবকাশ নেই। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী থ্রি-হুইলার মহাসড়কে চলার কথা না। থ্রি-হুইলার মহাসড়কে উঠলে তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
আপনার মতামত লিখুন :