সিলেটের প্রাচীন জৈন্তা রাজ্য বা জৈন্তার পরগনাসমূহে মানুষের জীবনযাত্রার স্বকীয়তা আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। জৈন্তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি সিলেটের অন্যান্য এলাকা থেকে আলাদা। ১৭ পরগনা সালিশ সমন্বয় কমিটি এখানকার কমিউনিটির অলিখিত নিয়ন্ত্রক। মুরব্বিরাই জৈন্তাবাসীর দুঃখ, দরদ দেখবাল ও গ্রাম্য সালিশ সুচারুভাবে সম্পন্ন করে।
আর এটি হয়ে থাকে ধর্মীয় ভাবাবেগে। এখানকার মানুষ কওমি ঘরানার। কওমি আলেমরাই ১৭ পরগনার পঞ্চায়েতগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। ১৭ পরগনার নীতিনির্ধারণ হয় হরিপুর থেকে।
চারটি উপজেলার পরগনাগুলো হরিপুরে অবস্থিত কওমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাদরাসাতুল উলুম দারুল হাদিসকে আদর্শ মেনে পরিচালিত হয়। এই মাদ্রাসাই নির্ধারণ করে সেখানকার অনেক কিছু। এটি এখন পূর্ব সিলেটের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে এসে সেই ঐতিহ্যের মুখ পোড়াতে শুরু করেছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সাধারণ লোকজন। ৫ আগস্টের পর তারা প্রায় প্রত্যেকেই জড়িয়ে পড়েছেন চোরাচালানে। বিষয়টি এখন সেখানে ওপেন সিক্রেট। ১৭ পরগনার জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাটের অনেকে জড়িয়ে পড়েছেন চোরাচালানে।
বিশেষ করে হরিপুরকেন্দ্রিক চোরাকারবারিরা এখন নিয়ন্ত্রণ করছে পুরো সিলেট। বিষয়টি ১৭ পরগনার মুখে কালিমা লেপনের মতো হয়ে গেছে। নাকের ডগায় বসে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে এখানকার কওমি আলেমদের মুখ পোড়াচ্ছে তারা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চোরাকারবারিদের পাকড়াও বা রুখতে গেলে আর কোথাও প্রতিরোধের শিকার না হলেও হরিপুরে তারা পাল্টা হামলার শিকার হয়েছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে ১৭ পরগনার পঞ্চায়েত বা সালিশ সমন্বয় কমিটি নীরবতা পালন করছে। এটি নানান প্রশ্ন ও সন্দেহের সৃষ্টি করেছে।
গত তিন দিন ধরে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সিলেটের হরিপুর রয়েছে উত্তপ্ত। পুলিশ, বিজিবি এখানকার শক্তিশালী চোরাচালান রুট ভাঙত ব্যর্থ হওয়ার পর সেনাবাহিনী অভিযানে নামে। এখন চোরাচালান ঠেকাতে গেলে সেনাসদস্যরাও প্রতিরোধের শিকার হচ্ছেন।
চোরাকারবারিরা সেনাসদস্যদের ওপর আক্রমণ করেছে, সেনাবাহিনীর গাড়ি ভাঙচুর করেছে। মঙ্গলবার হরিপুর মাদ্রাসা এলাকায় রাত সাড়ে ১২টার পর সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালানো হয়। হরিপুরে অসংখ্য চোরাকারবারি রয়েছে। ভারত থেকে চোরাই পথে তারা বিভিন্ন পণ্য নিয়ে আসে।
মঙ্গলবার চোরাই পণ্য আসার খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর একটি টিম সেখানে যায়। তখন তাদের ওপর হামলা হয়। এতে সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য আহত হন। আহতদের মধ্যে একজন আর্মি অফিসারও রয়েছেন।
সূত্র জানায়, হরিপুর, চানপুর, হেমু, হাউদপাড়া, বালিপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামে ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়েছেন সেনাসদস্যরা। বুধবার সকালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গিয়ে চোরাচালানের গডফাদার আব্দুর রশিদ চেয়ারম্যানের বাড়ি হানা দেন।
এ সময় তারা ঘর তল্লাশি করলেও রশিদ চেয়ারম্যানের খোঁজ পাননি। অভিযানের সময় সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে বাজার থেকে ব্যবসায়ী আশফাক সিকদার, তার ভাই হানিফ শিকদার, ড্রাইভার কামরুলসহ আরও কয়েকজন ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়।
তাদের নিয়ে সেনাসদস্যরা বাজার ও বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালাচ্ছেন বলে এলাকার লোকজন জানিয়েছেন। জৈন্তাপুর থানার ওসি বদরুজ্জামান বাদল গণমাধ্যমকে বলেন, হরিপুরের চোরাকারবারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। টহলে থাকা সেনাবাহিনীর গাড়িকে চাপা দিয়ে এ ঘটনার সূত্রপাত ঘটানো হয়েছে। এরপর সেনাসদস্যদের ওপর হামলা করা হয়েছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্রের দাবি, হরিপুরের চোরাকারবারিরা নিজেদের দাপট জাহির করতে গিয়েই সমস্যা প্রকট করে তুলেছে। সেনাবাহিনীর ওপর হামলা করেছে। তাদের হামলায় এক কর্মকর্তাসহ কয়েকজন সেনাসদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ভাবছে সিলেটের প্রশাসনও।
ঘটনার পর থেকে সেনাসদস্যরা অভিযানে রয়েছেন হরিপুরে। বাজারের নিকটবর্তী গ্রামগুলোর ঘরে ঘরে চলছে তল্লাশি। এই অবস্থায় হরিপুর বাজারও নীরব হয়ে পড়েছে। পুরুষশূন্য বাজার ও আশপাশের কয়েকটি গ্রাম। বাজারে নিত্যপণ্যের ক্রেতা-বিক্রেতা ছাড়া আর কাউকে দেখা যায়নি। বাজারের বেশির ভাগ দোকানপাট ছিল বন্ধ।
জৈন্তাপু উপজেলার আলেম-উলামা শাসিত একটি অঞ্চল হচ্ছে হরিপুর। সেটি পূর্ব সিলেটের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্রও। গত দুই যুগ ধরে আলেম-উলামা শাসিত হরিপুর নতুন নামে পরিচিতি পেয়েছে। সেটি হচ্ছে চোরাই রাজ্য হরিপুর। প্রথমে হরিপুরে চোরাই গরু-মহিষের হাট বসত। এখন সেই কুখ্যাতি ছাপিয়ে চোরাই চিনির রাজ্যে পরিণত হয়েছে এই বাজার।
সীমান্ত দিয়ে সব ধরনের পণ্য আসে হরিপুরে। ওখান থেকেই গাড়িযোগে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এ কারণে হরিপুরকে বলা হয় চোরাই সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টার। এলাকার কয়েকটি গ্রামের লোকজন ঘরে ঘরে চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত।
স্থানীয় অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একসময় হরিপুরের ঐতিহ্য ছিল। পুরো ১৭ পরগনা এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হতো। সবশেষ শায়েখ আব্দুল্লাহর ইন্তেকালের পরেও হরিপুর তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছিল। ধর্মীয় অনুশাসন, পরগনার নিজস্ব নিয়ম, সবই এখানকার বাসিন্দারা পালন করছিলেন কঠোরভাবে।
কিন্তু ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা চিনি ও ভারতীয় পণ্য চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার পর অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এলাকাটি। বিষয়টি পরগনার মুরব্বিরা ভালোভাবে নেনওনি। এমননকি কওমি আলেমরাও এটি সমর্থন করছেন না। তবে চোরাচালান এখানে ভয়াবহ রূপ নিলেও এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেও তারা নীরব। কেউ কোনো কথ বলছেন না।
স্থানীয়রা বলেন, চোরাচালান নিয়ে যখন গুমোট পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন তা নিয়ন্ত্রণে নামে পুলিশ ও বিজিবি। কিন্তু প্রভাবশালী চক্রের কারণে তারা ব্যর্থ হয়। চোরাচালান আরও প্রকট হয়ে ওঠে। তখন সেনাবাহিনী বিশেষ অভিযানে নামলে তাদের প্রতিরোধে নামে হরিপুরের চোরাকারবারিরা। হামলা চালায় সেনা সদস্যের ওপর।