ঢাকা সোমবার, ৩১ মার্চ, ২০২৫

ঈদে জাকাত-ফিতরা

দানের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকেরা

মেহেদী হাসান খাজা
প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০২৫, ০১:৫৪ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ফিতরা, জাকাত কিংবা দান-খয়রাতের টাকা নিয়ে চলছে প্রতারণা। কাছের মানুষ সেজে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এসব প্রতারণা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অর্থের পরিমাণ কম হওয়ায় এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে কেউ অবিযোগও করেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

তবে পুলিশের পক্ষ  থেকে সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, যাতে আপনার দানের টাকা কোনো প্রতারকের হাতে না যায়।

এমন একটি প্রতারণার শিকার হওয়া এক ব্যক্তি রায়হান। রায়হানের মোবাইল ফোনে একটি মেসেজ আসে। তার স্ত্রী মেসেজটি পড়ে খুব আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং তখনই বিকাশের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা পাঠাতে উদ্যত হন। তবে রায়হান সেই মুহূর্তে বাসায় ছিলেন। স্ত্রীর কাছে তিনি ঘটনাটি শোনেন এবং মোবাইল ফোনে আসা মেসেজটি পড়েন।

এ বিষয়ে রায়হান জানান, স্ত্রীর মোবাইল ফোনে একটা মেসেজ এলো তার খুব কাছের আত্মীয়ের লেখা। তারা নাকি বাজার করতে পারছে না এই রমজানে। বিভিন্ন আর্থিক অনটনে রয়েছে। যদি ফিতরা বা জাকাত কিছু দিতে পারে, তাহলে তাদের পরিবারের জন্য ভালো হয়। 

রমজানে বাকি কয়েকটি রোজাও তারা রাখতে পারবে। মেসেজের সঙ্গে সেই আত্মীয় নিজের বিকাশ ও নগদ নম্বরও দিয়েছে।

রায়হান জানান, ‘আমার স্ত্রী নরম মনের মানুষ। আর রমজান মাসে সাহায্য করতে বলা হয়েছে ধর্মে, বেচারিও ভাবল সাহায্য করা যায়। কিন্তু সেই নম্বর ট্রু কলারে সার্চ দিলে নাম আসে Cutee Frnz! এবং ট্রু কলারে অনেকে এই নম্বরটাকে স্প্যার্ম ও ফর্ড হিসেবে রেড মার্ক করে রেখেছে। 

ট্রু কলারে অনেকে কমেন্টও করেছে যে নম্বরটা থেকে প্রতারণা করা হচ্ছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যারা এই নম্বরকে রিপোর্ট করেছে, সবাই বলছে, এই নম্বর থেকে তাদের আসল নাম দিয়েই নাকি মেসেজ পাঠানো হয়েছে।
আরেকজন মাসুদ কামাল। তার মোবাইল ফোনে বিকাশের একটি ‘ক্যাশ ইনের’ মেসেজ আসে।  

সেখানে লেখা- Bkash Cash In Received TK 8200.00 from 01703515700 successful. Fee TK 8200 Balance TK 27700 TrxID BAI81Y5S6U at 25/01/2025  Download App: httpts://
মাসুদ কামালকে আরেকটি নম্বর থেকে ফোন দিয়ে বলা হয়, ভুলে তার বিকাশ অ্যাকাউন্টের নম্বরে ৮২০০ টাকা চলে গেছে। এই টাকা তার মায়ের অপারেশনের জন্য। 

অনুগ্রহ করে টাকাটি এই নম্বরে সেন্ড মানি করার কথা বলা হয়। এরপর মাসুদ কামাল সত্য ভেবে তার মোবাইল ফোনের বিকাশ অ্যাপসে আকাউন্ট চেক করে দেখেন কোনো টাকা আসেনি। তিনি বুঝতে পারেন তার সঙ্গে প্রতারণা হয়েছে।

এভাবেই আসন্ন ঈদুল ফিতর সামনে রেখে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে একাধিক প্রতারক চক্র। চলমান রমজান, রোগী হাসপাতালে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হ্যাক করে ও আর্থিক সংকটে খেতে না পারাসহ নানা সমস্যার কথা বলে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে একাধিক চক্র। 

দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করলেও ঈদ সামনে রেখে নতুন নতুন প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে তারা। ইসলাম ধর্মে রয়েছে- রমজান মাসে এক টাকা দান করলে সত্তর টাকা দানের সওয়াব পাওয়া যাবে। ধর্মকে পুঁজি করে এমন কথা বলেও টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

পুলিশ জানিয়েছে, একসময় বিকাশ, নগদ, রকেটসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ওটিপি নম্বর নিয়ে টাকা হাতিয়ে নিত প্রতারকেরা। তবে সম্প্রতি অধিকাংশ গ্রাহক ওটিপির বিষয়ে অধিক সচেতন হওয়ায় বর্তমানে ওটিপি দিয়ে প্রতারণা অনেকাংশেই কম। বর্তমানে ফাঁদে ফেলে এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রতারণা চলছে।

বিকাশের বোনাসের নামে প্রতারণা!: ‘অভিনন্দন প্রিয় বিকাশ গ্রাহক! আপনি দীর্ঘদিন বিকাশের সাথে থাকার জন্য ১২ হাজার টাকা বোনাস পেয়েছেন।’ শীর্ষক দাবিতে একটি লিঙ্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধান জানায়, বিকাশ ব্যবহারকারীদের ১২ হাজার টাকা দেওয়ার কোনো ঘোষণা বিকাশের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি, বরং ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে প্রতারণার উদ্দেশ্যে এই প্রলোভন দেখানো হয়েছে।

অনেকে যেভাবে হারিয়েছেন নগদ অর্থ : গত ১৪ মার্চ কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় বিকাশ প্রতারণার খপ্পরে পড়ে ২০ হাজার ৪০০ টাকা হারিয়েছেন হাসান শরীফ নামে এক শিক্ষক। তিনি মনোহরখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। 

ভুক্তভোগী শিক্ষক জানান, তার মোবাইল ফোনে নগদ অ্যাকাউন্ট নম্বর থেকে সেন্ড করা ২৫ হাজার টাকার একটি মেসেজ আসে। এর পরেই একটি নম্বর থেকে কল করে ২০ হাজার টাকা ট্রান্সফার করতে বলে। ওই শিক্ষক উপজেলা সদর থেকে বিকাশ রিটেইলারে গিয়ে কমিশনসহ ২০ হাজার ৪০০ টাকা পাঠিয়ে দেন।

মাদ্রাসার বিভিন্ন ভাতা নিয়ে প্রতারণা: অন্যদিকে আরেকটি প্রতারক চক্র মাদ্রাসার শিক্ষকদের এমপিওভুক্তীকরণ, এমপিওভুক্ত মাদ্রাসায় বিশেষ বরাদ্দ, উচ্চতর স্কেল প্রদান, পদোন্নতির নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। এসব প্রতারণা থেকে সবাইকে সাবধান থাকতে বলেছে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। 

মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কেউ কোনো ধরনের সুবিধা বা অর্থ দাবি করলেই বুঝতে হবে, এটা প্রতারক চক্রের কাজ। এ ক্ষেত্রে দ্রুত পুলিশকে জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে।

এছাড়া বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রধানের নামেও বিকাশ-নগদের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে যাচ্ছে একটি চক্র।  

স্বল্প সময়ে কোটিপতি হওয়ার লোভে এবং মাদক সেবনের অর্থ জোগাতে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে সাধারণ মানুষের বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রধানের নামে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে একটি চক্র। পরে অভিযান চালিয়ে চক্রের চার সদস্যকে গত বছরের ২ এপ্রিল গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। 

ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ-ইমো হ্যাক করে প্রতারণা: নাফিসা আনজুমের (ছদ্মনাম) মোবাইল ফোনটি ঢাকার গণপরিবহন থেকে ছিনতাই হয়ে যায়। এরপর ছিনতাইকারী দামি মোবাইল ফোনটি বিক্রি করে দেয় এক দোকানে। 

মোবাইল ফোনটি যে কিনেছিলেন, তিনি নাফিসা আনজুমের মোবাইলে থাকা ছবি ও ভিডিও নিয়ে প্রতারণা শুরু করেন। হুমকি দিয়ে টাকা হাতানোর চেষ্টা করেন। তবে এরই মধ্যে নাফিসা বিষয়টি সাইবার পুলিশকে জানিয়ে মামলা করেন। এরপর তার হারানো মোবাইল ফোনসহ গ্রেপ্তার করা হয় হুমকি প্রদানকারী ব্যক্তিকে।

জাকির হোসেন নামের এক ব্যবসায়ীর হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তার পরিচিত অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে ঋণ চাওয়া হয়। হ্যাকার মুহূর্তেই প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা কয়েকজনের কাছ থেকে জাকিরের কথা বলে হাতিয়ে নেয়। 

কল মার্জিং প্রতারণা: কল মার্জিং প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণত বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ওটিপি সংগ্রহ করে থাকে প্রতারকেরা। এরপর সেই ওটিপি কাজে লাগিয়ে অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অর্থ ও তথ্য চুরি করে তারা। 

ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বোকা বানাতে প্রথমে পরিচিত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহারে ফোনকল করে থাকে প্রতারকেরা। এসব ফোনকলে সাধারণত বিশেষ অফারসহ নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের আস্থা অর্জন করা হয়। 

এরপর ফোনকলটিতে গুরুত্বপূর্ণ বা পরিচিত কোনো ব্যক্তিকে যুক্ত করার জন্য কল মার্জ করতে বলা হয়। কল মার্জ করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি ওটিপি নম্বর শোনা যায়। প্রতারকেরা ফোনকলে যুক্ত থাকায় ওটিপি নম্বরটি তারাও শুনতে পায়। 

এর ফলে ওটিপি নম্বরটি কাজে লাগিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাশাপাশি অর্থ ও তথ্য চুরি করে থাকে প্রতারকেরা।

এ প্রসঙ্গে ডিএমপি ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার হাসান মোহাম্মদ নাছের রিকাবদার (ডিসি) বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই বিকাশসহ অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন এমন অভিযোগ পাচ্ছি। 

এসব অ্যাকাউন্ট যে হ্যাক হয়েছে শুধু তা নয়, সেই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। দেশের প্রতিটি প্রান্তেই এমন প্রতারণা হচ্ছে। তবে অভিযোগের শতকরা প্রায় ৯৯ শতাংশ আমরা ডিটেক্ট করতে পারি।

সিআইডি সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ইদানীং মোবাইল ব্যাংকিং বিশেষ করে বিকাশ প্রতারণা বেড়েছে। তবে বিকাশ প্রতারণার আগের একটি ধাপ হলো ‘ইনভেস্টমেন্ট অ্যাপস’। এই পদ্ধতিতে স্ক্যাম করছে প্রতারক চক্র। 

বিদেশ থেকে বাংলাদেশের সিম দিয়ে টেলিগ্রাম কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে এই স্ক্যাম করা হচ্ছে। এই অ্যাপসে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য দিয়ে কিছু ইনভেস্টমেন্ট করতে হয়, এর কিছুদিন পর লভ্যাংশ জমা হতে থাকে। গ্রাহক তখন বিকাশ বা অন্য কোনো অ্যাকাউন্ট দিয়ে টাকা তুলতে পারে। 

এরপর বেশি লাভের আশায় বেশি ইনভেস্টের পর লাখ টাকা বা এর বেশি জমা হলেই প্রতারক চক্র ওই ব্যক্তির অ্যাকাউন্টটি তখন ব্লক করে দেয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর জানান, ৯৯৯ থেকে কখনোই কোনো ব্যক্তির মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের (বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদি) পিন নম্বর অথবা ব্যাংকের ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের পিন নম্বর জানতে চাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ৯৯৯ নাগরিকদের চাহিদা অনুযায়ী জরুরি মুহূর্তে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদান করে থাকে।