রিখটার স্কেলে সাত মাত্রা বা তার বেশি ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। শহরের অধিকাংশ ভবনই ধসে পড়বে।
বিশেষ করে গিঞ্জি পরিবেশ থাকায় উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটবে। এমনটাই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
শুক্রবার মিয়ানমারের ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প পাশ্ববর্তী থাইল্যান্ডসহ বেশকিছু দেশে অনুভূত হয়েছে।
ওই ভূমিকম্পে মিয়ানমারে যেমন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তেমনি থাইল্যান্ডেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
দেশ দুটিতে বহু ভবন ধসে পড়েছে। বহু রাস্তাঘাট, ব্রিজ লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত হাজারের অধিক হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।
মিয়ানমারের ওই ভূমিকম্প বাংলাদেশেও অনুভূত হয়েছে। সেদিন দুপুর ১২ টা ২১ মিনিটে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান কেঁপে উঠেছিল। ফলে ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বিশেষজ্ঞদেরও ধারণা, ভূগৌলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে ৮ বা তার থেকে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প সংগঠিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কারণ তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশ। একাধিক ফল্টও রয়েছে। এসব কারণে বাংলাদেশকে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
আর বাংলাদেশের মাটির নীচে যে পরিমান শক্তি জমায়িত আছে তাতে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূকম্পন সংগঠিত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। ফলে অনেকেই বুঝতে চাচ্ছেন বড় ধরণের ভূমিকম্প হলে ঢাকার পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াবে।
খোদ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার অদূরে টাঙ্গাইলের মধুপুরে মাটির নিচে যে ফল্টলাইন রয়েছে সেখানে রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ‘ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়বে’।
অন্যদিকে সিলেটের ডাউকি চ্যুতিরেখায় ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫টি ভবন ধসে পড়বে বলেও ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে।
বুয়েটের এক তথ্যানুযায়ী, রাজধানীতে মোট ভবন আছে ২১ লাখ। এর মধ্যে ৬ লাখ ভবন ছয়তলা বা তার চেয়ে উঁচু। তবে সবশেষ কত ভবন তৈরি হয়েছে তা জানা যায়নি।
যদিও রাজউক সূত্র জানায়, নগরীর ২২ লাখ ভবন রয়েছে। তবে এগুলো অধিকাংশই একতলা।
এছাড়া রাজউকের একাধিক জরিপ বলছে, রাজধানীর দুই-তৃতীয়াংশ ভবন বা প্রায় ৭৫ শতাংশ ভবনই নিয়ম মেনে তৈরি হয়নি। অর্থাৎ ওই ভবনগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে।
শুধু ভবন ধসে পড়াই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় মাটির নিচ দিয়ে সেবা সংস্থাগুলোর (গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ) বিভিন্ন লাইন গেছে।
ভূমিকম্পের ফলে কোনও ভবন ধসে পড়লে সেসব সেবা লাইন উপড়ে যাবে। আর সেগুলো তখন জনজীবনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
এদিকে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকির কথা জানিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স।
শনিবার (২৯ মার্চ) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ এবং ঢাকা অঞ্চল ভুমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
এ অবস্থায় ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য সব পর্যায়ে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ ও সচেতনতা তৈরির নিমিত্ত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড–২০২০ অনুযায়ী ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ করা, ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরোনো ভবনগুলোর সংস্কার ও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, সকল বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা, ইউটিলিটি সার্ভিস যেমন—গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের লাইনের সঠিকতা নিশ্চিত করাসহ বেশ কিছু সতর্কতা দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন ভূঁঞা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকার ভূত্বক ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। ভূগর্ভস্থ পানি আস্তে আস্তে নিচে চলে যাচ্ছে। ফলে ভূমিকম্প ছাড়াই এক সময় ভবন ধসে পড়বে।’
‘আর মাধারি ধরণের ভূমিকম্প আঘাত আনলেই ঢাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। অপরিকল্পিত নগরায়নে যে গিঞ্জি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। উদ্ধার প্রক্রিয়াও জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ আটকে পড়েই মারা যাবেন। তাই ভূমিকম্পের আগাম প্রস্তুতি নেওয়া খুবই জরুরি’, যোগ করেন ভূতত্ত্ববিদ।
অনেকটা একই রকম কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ভূমিকম্প গবেষক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার।
তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘যেভাবে ঢাকা শহরের মাটির ভূগঠন পরিবর্তন হচ্ছে তাতে ভূমিকম্প ছাড়াই বিল্ডিং হেলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই এলাকায় (বাংলাদেশে) বড় ভূমিকম্প হয়েছে বহুবছর আগে। অন্তত ৮০০ থেকে হাজার বছর আগে। এরপর থেকেই আবার শক্তি জমা হচ্ছে। এই দীর্ঘ সময়ে যে পরিমাণ শক্তি জমা হয়েছে তা বেরিয়ে এলে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। আর সেটি ঘটলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঢাকা।’
আপনার মতামত লিখুন :