ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল, ২০২৫

ঈদকে ঘিরে মাদকের চাহিদাও বেড়েছে

শহিদুল ইসলাম রাজী
প্রকাশিত: মার্চ ৩০, ২০২৫, ০৩:০০ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ঈদকে ঘিরে মাদকের চাহিদাও বেড়েছে কয়েকগুণ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নিত্যনতুন কৌশলে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ঢাকায় ঢুকছে মাদক। ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইনসহ প্রায় ২৫ প্রকারের মাদক ঢুকছে দেশে। 

বিভিন্ন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে জেলা হয়ে রাজধানীতে আসছে মাদকের বড় বড় চালান। উচ্চবিত্ত শ্রেণির তরুণ-তরুণীরা ছাড়া আরও অনেকে মাদক গ্রহণের মাধ্যমে ঈদ আনন্দ উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। মাদককারবারি ছাড়াও রাজধানীর বার ও অভিজাত হোটেলগুলোতে বৈধ-অবৈধ মাদক মজুদ করা হয়েছে। 

মাদক গ্রহণের ফলে সেবনকারীরা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে মাদকের আগ্রাসন রুখতে। আর এ মাদকের টাকা জোগাড়ে কিশোর-তরুণ শিক্ষার্থীরা ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানান, ঈদে মাদকের সরবরাহ বাড়ার আশঙ্কায় রমজানের শুরু থেকেই নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দেশে পট পরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শিথিলতার সুযোগে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে মাদককারবারিরা। 

ঈদকে ঘিরে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মাদক প্রতিরোধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। তাদের দাবি, যেভাবেই হোক মাদক আসা বন্ধ করতে হবে। 

না হলে অনেক তরুণ-তরুণী বিপথগামী হবে। ডিএনসি সূত্র জানিয়েছে, শতাধিক শীর্ষ কারবারি প্রায় দেড়শ সীমান্ত রুট দিয়ে মাদক নিয়ে আসছে। এর মধ্যে মিয়ানমার থেকে স্থল ও নৌপথে অর্ধশত পয়েন্ট দিয়ে আসছে ভয়ংকর মাদক আইস ও ইয়াবা।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের গত দুই মাসে দেশে বিভিন্ন স্থানে মাদকসংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৮ হাজার ১৮টি। এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৩৮৬টি ও ফেব্রুয়ারিতে ৩ হাজার ৬৩২টি। এর মধ্যে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ৫৭টি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঈদকে ঘিরে সম্প্রতি বেড়েছে বড় বড় মাদকের চালান। 

অভিযানে বেশ কিছু চালান ধরা পড়লেও অধিকাংশই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে ঢুকছে মাদকের চালান। গত ২৮ মার্চ রাতে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনের ‘ঝ’ বগি থেকে ৩৩ হাজার ৫০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে ঢাকা রেলওয়ে পুলিশ। 

ঢাকা রেলওয়ে পুলিশ জানায়, ঢাকা-কক্সবাজার রুটের কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনের ঝ বগি থেকে বিশেষ চেকিং করে মালিকবিহীন পরিত্যক্ত অবস্থায় স্কুল ব্যাগ ভর্তি ৩৩ হাজার ৫০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। যার বাজারমূল্য আনুমানিক ১ কোটি ৫০ হাজার টাকা। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।

গত ২৭ মার্চ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর রায়েরবাগে অভিযান চালিয়ে ৪৬ হাজার ৯০০ পিস ইয়াবাসহ তিন মাদককারবারিকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এসব ইয়াবার মূল্য প্রায় ৯২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ডিবি জানায়, রায়েরবাগ এলাকার ফুট ওভারব্রিজের দক্ষিণ পাশে চেকপোস্ট পরিচালনা করে মাদক পরিবহনে ব্যবহৃত বাসসহ তিন পেশাদার মাদককারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

পরবর্তী সময়ে তাদের দেখানো মতে বাসে বিশেষ কায়দায় রাখা অবস্থায়  ৪৬ হাজার ৯০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা দীর্ঘদিন ধরে মাদক কারবারে জড়িত। তারা কক্সবাজার থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে ঢাকায় এনে রাজধানীর বিভিন্ন মাদককারবারিসহ ঢাকার আশপাশের এলাকায় বিক্রয় করে আসছে। 

গত ২৩ মার্চ ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে ৬ হাজার ইয়াবাসহ এক কারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়, এর আগের দিন গত ২২ মার্চ ১৫ হাজার ৭০০টি ইয়াবাসহ চট্টগ্রাম থেকে এক কারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

একই দিন রাজধানীর সবুজবাগ থেকে ৫ হাজার ইয়াবাসহ একজনকে ও চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থেকে দুই কারবারিকে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। ওই দিনেই রাজধানী থেকে উদ্ধার হওয়া সবচেয়ে বড় ইয়াবার চালান ৫ কোটি টাকার ১ লাখ ৬০ হাজার ইয়াবাসহ চার কারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো কার্যালয়ের (উত্তর) উপপরিচালক শামীম আহমেদ জানান, এই চক্রের বিরুদ্ধে গত মাসে একটি অভিযান পরিচালনা করলেও তা ব্যর্থ হয়। 

সর্বশেষ সপ্তাহ খানেক আগে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, এই চক্রটি আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাচারের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা টেকনাফের একটি রির্সোটে দীর্ঘ সময় ধরে হুন্দাই কোম্পানির বিলাসবহুল গাড়ির পাদানির নিচের প্যানেলে বিশেষ কৌশলে ১ লাখ ৬০ হাজার পিস ইয়াবা ঢুকিয়ে প্যানেলটি সুনিপুণভাবে ঝালাই করে রাখেন। 

এমন খবরের ভিত্তিতে গভীর রাতে অভিযান চালায়। এই অভিযানে ঢাকা মেট্রো এলাকায় আসামিদের গাড়িটি ৭ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা ধাওয়া করে আটক করা হয়।

জানা গেছে, ২১ মার্চ উখিয়া ও রামুতে পৃথক অভিযানে ১৫ হাজার ইয়াবাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই দিন গাজীপুরের টঙ্গী থেকে ৬ হাজার ইয়াবাসহ একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ২০ মার্চ যাত্রাবাড়ী থেকে ৪ হাজার ৬০০, ১৯ মার্চ খিলগাঁও ও তেজগাঁও থেকে ১০ হাজার ৬১০, কক্সবাজার সদর থেকে ১০ হাজার, যাত্রাবাড়ীর গোলাপবাগ থেকে ২০ হাজার এবং গত ১৭ মার্চ উখিয়ার বালুখালী থেকে ৪০ হাজার ইয়াবা জব্দ করা হয়। 

গত ১২ মার্চ রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকা থেকে এক হাজার ৬৬৮ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার শফিকুল ইসলাম পুলিশকে জানান, সীমান্তপথে বিভিন্ন পরিবহনে মাদক এনে তাঁরা ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় বিক্রি করতেন।

 একই দিন গ্রেপ্তার রাজন নামের একজনকে পিস্তলের গুলি ও ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ জানতে পারে, জামিনে থেকে রাজন কারওয়ান বাজারসহ আশপাশের এলাকায় মাদক বিক্রি করছিলেন।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, ইয়াবার পর কোকেন ও হেরোইন এখন দেশের তরুণ ও যুবসমাজের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদক নির্মূলে গতানুগতিক কাজ পরিচালিত হলেও একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে না। ফলে মাদক ব্যবসায়ীরা বা মাফিয়া চক্র এখন সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, মাদক প্রতিরোধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। যেভাবেই হোক, বিদেশ থেকে মাদক আসা বন্ধ করতে হবে। না হলে অনেক তরুণ বিপথগামী হবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ঢাকা মহানগর এলাকায় মাদকের বিস্তার রোধে ডিএমপি জিরো টলারেন্সনীতি অবলম্বন করেছে। মাদককারবারিদের আইনের আওতায় আনতে চিহ্নিত মাদক স্পটগুলোয় নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি মাদকদ্রব্য উদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মহানগরীতে চেকপোস্ট ও টহল কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়েছে। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের ৫০টি থানা এলাকায় প্রতিদিন জননিরাপত্তা বিধানে দুই পালায় ডিএমপির ৬৬৭টি টহল টিম দায়িত্ব পালন করছে। এ ছাড়া মহানগর এলাকার নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত স্থানে ডিএমপি কর্তৃক ৭১টি পুলিশি চেকপোস্ট পরিচালনা করা হচ্ছে।