ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল, ২০২৫

পর্যটকদের জন্য প্রস্তুত মৌলভীবাজার

মো. শাহজাহান মিয়া, মৌলভীবাজার
প্রকাশিত: মার্চ ৩০, ২০২৫, ০৪:০০ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে টানা ৯ দিনের সরকারি ছুটি গত শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে। প্রতিবছর ঈদেই বিপুলসংখ্যক ভ্রমণপিপাসুদের পর্যটকদের সমাগম হয় মৌলভীবাজারে। এবারও ঈদের টানা ছুটিতে পর্যটকদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত মৌলভীবাজারের পর্যটন স্পট ও আবাসন ব্যবসায়ীরা। 

পুরো জেলায় শতাধিক পর্যটন স্পট থাকলেও দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসুদের প্রথম পছন্দ হলো চায়ের রাজধানী এ জেলা। ফলে এই জেলার পর্যটন স্পটগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পাঁচ তারকা মানের রিসোর্টসহ দেড় শতাধিক রিসোর্ট, ইকো কটেজ, হোটেল, মোটেল। যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ আগাম বুকিং সম্পন্ন হয়েছে। ঈদের দিন ‘হাউসফুল’ পর্যটক থাকবেন বলে আশা করছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা।

মৌলভীবাজার জেলার পাঁচ তারকা মানের হোটেলসহ বিভিন্ন মানের শতাধিক হোটেল-রিসোর্ট ও কটেজে পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে ট্যুরিস্ট পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশ, র‌্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থার নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। পর্যটকবান্ধব মৌলভীবাজারের আইনশৃঙ্খলা বর্তমানে দেশের যেকোনো স্থানের তুলনায় বেশ ভালো রয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। 

মৌলভীবাজার জেলার সাত উপজেলায় শতাধিক ছোট-বড় পর্যটন স্পটের পাশাপাশি ২১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। চায়ের দেশে ভ্রমণের কথা ভাবলেই ভ্রমণপ্রেমীদের মনে ভেসে ওঠে চোখ জুড়ানো চা-বাগান আর সারি সারি রাবার, লেবু-আনারস বাগানের দৃশ্য। 

এখানকার উঁচু-নিচু পাহাড়ের বুকজুড়ে সবুজ চা-বাগানসহ নজরকাড়া প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মৌলভীবাজারের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে ছুটে আসেন পর্যটকরা। জেলায় উঁচু-নিচু পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সবুজের গালিচায় মোড়ানো ৯২টি চা-বাগান। 

এ ছাড়া এ জেলার মনোমুগ্ধকর পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- কমলগঞ্জ উপজেলায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, হামহাম জলপ্রপাত, সীতাপ জলপ্রপাত, মাধবপুর লেক, পদ্মছড়া লেক, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ, আদমপুর সংরক্ষিত বন, মনিপুরী পল্লী, শমসেরনগর বিমানবন্দর, ক্যামেলিয়া লেক, মনিপুরী ললিতকলা একাডেমি, শমসেরনগর গলফ মাঠ; শ্রীমঙ্গল উপজেলায় লাসুবন গিরিখাত, হাইল হাওর, বাইক্কা বিল, বিদ্যাবিল হাজং টিলা, মুর্দাকুল মিনি ঝরনা, অফিং হিল, ডিনস্টন সিমেট্রি, নির্মাই শীববাড়ি, কালাছড়া সংরক্ষিত বন, নিরালা পানপুঞ্জি, রাবার বাগান, চাউতলী বনাঞ্চল, ভাড়াউড়া লেক, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, চা-কন্যা ভাস্কর্য, চা জাদুঘর, লেবু-আনারস বাগান, লালমাটি কালীটিলা, বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন, পাহাড়-টিলা, বধ্যভূমি একাত্তর, গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফ, শংকর টিলা লেক, জাগছড়া লেক, ফুলছড়া গারো লাইনের লেক; কুলাউড়া উপজেলায় হাকালুকি হাওর, পৃথিমপাশা নবাববাড়ি, কালাপাহাড়।
এ ছাড়া আরও রয়েছেÑ রাজনগর উপজেলায় কমলা রানির দীঘি, পাখিবাড়ি, রাজা সুবিদ নারায়ণের রাজবাড়ি, জনার্দন কর্মকারের বাড়ি, জমিদার বাড়ি, লীলা নাগের পৈতৃক বাড়ি, পাঁচগাঁও লাল দুর্গা মন্দির; জুড়ী উপজেলায় কমলা বাগান, লাঠিটিলা বনাঞ্চল; মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক, হযরত শাহ মোস্তফা (রহ.) মাজার শরিফ, মনু ব্যারাজ, কাসিমপুর পাম্প হাউস, ঐতিহাসিক খোজার মসজিদ, শেরপুর মুক্তিযোদ্ধা গোল চত্বর, বড়লেখা উপজেলায় মাধককুণ্ড জলপ্রপাত, পরীকুণ্ড জলপ্রপাত, সুজানগর আগর কারখানা, মুরইছড়া বনাঞ্চল, আগর বাগান, পাথারিয়া বনাঞ্চলসহ শতাধিক মনোমুগ্ধকর পর্যটন স্পট।

শ্রীমঙ্গলের ইকো রিসোর্টের কয়েকজন মালিক বলেন, প্রতিবছর নভেম্বর মাস থেকে পরবর্তী বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত মূলত পর্যটন মৌসুম। এ বছর মার্চ মাসে রোজা থাকায় রিসোর্ট, কটেজগুলো একেবারে ফাঁকা ছিল। পর্যটকদের আগমন ছিল না বললেই চলে। 

ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসা। তবে এবারের ঈদের ওই ক্ষতি, সে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমাদের রিসোর্টের পুরোটাই অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। আমরা প্রস্তুত পর্যটকদের বরণ করে নিতে।

নির্জন নেচার হাইড আউট রিসোর্টের ব্যবস্থাপক দুর্জয় দেববর্মা বলেন, এবারের ঈদে অনলাইনে আমাদের রিসোর্টের প্রায় ৮০ শতাংশ বুকিং কনফার্ম হয়েছে। বাকি ২০ শতাংশ হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। এবার অন্যান্যবারের চেয়ে ভালো সাড়া পাচ্ছি।

নভেম ইকো রিসোর্টের পরিচালক প্রকৌশলী শরীফ মাহমুদ বলেন, ঈদের ছুটিতে আমাদের রিসোর্টের কোনো কক্ষ খালি নেই। সব কক্ষই ইতিমধ্যে বুকিং সম্পন্ন হয়েছে। এখন আমাদের প্রস্তুতি চলছে ঈদে আগত পর্যটকদের মানসম্মত সেবা প্রদানের। 

কমলগঞ্জ উপজেলার টিলাগাঁও ইকো ভিলেজের ব্যবস্থাপক জারিদ আহমেদ বলেন, আমাদের এখানে ঈদের শতভাগ বুকিং সম্পন্ন হয়েছে। কোনো রুম খালি নেই। ঈদের আগে পুরো মাসই ব্যবসা হয়নি। 

ঈদের টানা ছুটিতে পর্যটক ভরপুর থাকায় আমাদের আগের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে। রাধানগর পর্যটন কল্যাণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী সামছুল হক বলেন, ঈদের টানা ছুটিতে এবার ভালো ব্যবসা হবে বলে আশাবাদী। আমি ঈদের ছুটিতে মৌলভীবাজার জেলায় পর্যটকদের আগমনের জন্য বিশেষ ট্রেনের দাবি করছি। বিশেষ ট্রেন হলে আরো বিপুলসংখ্যক পর্যটকের পদভারে মুখোরিত হতো এ অঞ্চল।

শ্রীমঙ্গল আবাসন সেবা সংস্থার যুগ্ম আহ্বায়ক ও গ্র্যান্ড সেলিম রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী সেলিম আহমদ বলেন, ‘কোনো উৎসব বা সরকারি লম্বা ছুটিতে মানুষ ঘুরতে বের হয়। এটার সঙ্গে পর্যটনশিল্পের বিকাশের সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ এটা অনেকটা মৌসুমি ব্যবসার মতো। তবে কিছুটা প্রভাব তো পড়বেই। এবারের ঈদের ছুটি বেশ লম্বা। আর এই লম্বা ছুটির কারণে মানুষ ঘুরে বেড়ানো সময় পাবেন। 

অন্যদিকে ভারতের ভিসা বন্ধ, সাজেক ভ্রমণে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা, ফলে দেশের সমৃদ্ধ পর্যটন স্থান শ্রীমঙ্গল তথা মৌলভীবাজারে পর্যটকদের সমাগম হবে। এখনো ঈদের কয়েক দিন বাকি আছে। এই সময়ে আমার রিসোর্টের শতভাগ কক্ষ বুক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

ট্যুরিস্ট পুলিশ শ্রীমঙ্গল জোনের পরিদর্শক মো. কামরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, এবার ঈদের ছুটি বেশ লম্বা থাকায় প্রচুর পর্যটক সমাগম হবে। ইতিমধ্যেই পর্যটন-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সভা করেছেন। পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি দর্শনীয় স্থানে নজরদারি রাখা হচ্ছে। 

ট্যুরিস্ট পুলিশের পাশাপাশি শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ থানার পুলিশ, র‌্যাব সাদা পোশাকেও ট্যুরিস্ট পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় থাকবে। পর্যটকরা যেন নির্বিঘ্নে ঘোরাফের করে সুন্দরভাবেই বাড়ি ফিরতে পারে, সেভাবেই নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখা হয়েছে। 

ঈদের বন্ধে পর্যটকদের ভ্রমণ নির্বিঘ্ন করতে আমাদের পক্ষ থেকে নিরাপত্তায় সার্বিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে, সে লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে আমরা ডিউটি তদারকি করব। ট্যুরিস্ট পুলিশ সতর্ক অবস্থানে থাকবে।  

পুলিশ সুপার এ কে এইচ জাহাঙ্গীর হোসেন পিপিএম সেবা বলেন, এবারও পর্যটননগরীতে পর্যটকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ স্থানীয় প্রশাসন পর্যটকদের নিরাপত্তায় কাজ করছে।

জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন বলেন, এবারও পর্যটননগরীতে পর্যটকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ স্থানীয় প্রশাসন পর্যটকদের নিরাপত্তায় কাজ করছে।