ঈদ খুশির বার্তা নিয়ে এলেও সেই ঈদ গত সাড়ে ১৫ বছরে খুশি নিয়ে আসতে পারেনি বিএনপি নেতাদের পরিবারে। বরং ঈদ এলে তাদের ওপর নেমে আসত আরও বেশি গ্রেপ্তার ও হয়রানির খড়্গ। পরিবারের সঙ্গে যাতে ঈদ করতে না পারে, তার জন্য বাড়ি বাড়ি খুঁজতে যেত পুলিশ।
এছাড়া এলাকাছাড়া করার হুমকি দিতেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। ফলে মামলার জালে আটকে পড়া বিএনপি নেতাদের কারও ঈদ কেটেছে জেলখানায়, আবার কারও ঈদ কেটেছে লুকিয়ে-পালিয়ে। ঈদের সেমাইও খেতে পারেননি অনেক বিএনপি নেতা।
ফ্যাসিবাদ পতনের পর এবার মুক্ত পরিবেশে স্বস্তির ঈদ বিএনপি নেতাদের। নির্বাচনি এলাকায় থাকবেন অধিকাংশ নেতা। সেখানে কর্মীদের সঙ্গে এবার ঈদ করতে চান বিএনপি নেতারা। সামনে নির্বাচন, সেই প্রস্তুতি নিতেই মূলত বিএনপি নেতারা নিজ নিজ এলাকায় ঈদ করবেন।
সাড়ে ১৫ বছর পর মুক্ত পরিবেশে ঈদ উদ্্যাপন রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। দীর্ঘ সময় পর এবার দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বাঁধাহীন ঈদ উদ্্যাপনে বেশ উৎফুল্ল। এরই মধ্যে তারা নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
ঈদসামগ্রীম জাকাত বিতরণ এবং ইফতার ও দোয়া মাহফিলে অংশগ্রহণ করছেন। ঈদকে কেন্দ্র করে তাদের আনাগোনায় এলাকায় ভিন্নরকম আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে দীর্ঘদিন পর দলবল, আত্মীয়স্বজন নিয়ে এবার ঈদ উদ্্যাপন করতে জেলার সব কটি নির্বাচনি এলাকায় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে।
তাছাড়া মনোনয়নপ্রত্যাশীদের পক্ষে তাদের হাইপ্রোফাইল আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, নেতাকর্মীরাও মাঠে নেমেছেন। প্রত্যেকেই নিজ নিজ এলাকায় নিজস্ব বলয় নিয়ে ঈদ উদ্্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিএনপি নেতারা বলছেন, ৫ আগস্টের পর এবারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা।
নেতাকর্মীরা মনে করছেন, এবার নির্বিঘ্নে রোজা ও ঈদ উদ্্যাপন করতে পারবেন তারা। আসন্ন সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা এলাকায় অবস্থান নিয়ে গণসংযোগ করছেন। ইফতার ও ঈদের মধ্য দিয়ে কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে নেতাদের বন্ধন আরও দৃঢ় হবে বলে মনে করেন দিলটির নেতারা।
স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘২০১৩ সালে ঈদের আগে আগে বাবা মারা যান। কোনো মতে পুলিশকে ম্যানেজ করে বাড়ি গিয়েছিলাম, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে। ঈদের খুশি ম্লান হয়ে গিয়েছিল বাবা হারানোর শোকে।
এরপর এক যুগ আওয়ামী লীগের কারণে বাড়ি যেতে পারিনি। ফ্যাসিবাদ বিদায়ে অবসান হয়েছে ফেরারি-জীবনের। প্রথমবার আতঙ্কমুক্ত পরিবেশে পরিবার-পরিজন ও নেতাকর্মীর সঙ্গে এলাকায় ঈদ করব। অন্যরকম ভালো লাগা ও প্রশান্তি কাজ করছে মনে।’
কুমিল্লা-১ দাউদকান্দি তিতাস সংসদীয় আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার এলাকায় গেলেও তার ছেলে ড. খন্দকার মারুফ হোসেন নেতাকর্মীদের নিয়ে নানা কর্মসূচি পালন করছেন।
তিনি সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের নিয়ে এলাকায় ঈদ উদ্্যাপন করবেন। খন্দকার মারুফ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এবার আর আমাদের কেউ ধাওয়া করে না, পুলিশ খোঁজে না। অনেক ভালো লাগছে।’
চাঁদপুর-১ (কচুয়া) আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ইঞ্জিনিয়ার হাবিবুর রহমান কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ইফতার ও দোয়া মাহফিলে নিয়মিত অংশগ্রহণ করছেন। তারা নির্বাচনি এলাকাতেই ঈদ উদ্্যাপন করবেন বলে জানা গেছে।
রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, দেশেই তো থাকতে পারিনি। হামলা-মামলা থেকে বাঁচতে বিদেশে চলে গিয়েছিলাম। দেশে থাকলে শুধু আমার ওপর নয়, পরিবারের ওপরও খড়্গ নেমে আসত। মূলত পরিবারকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাতেই চলে গিয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়া। স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর চলে এসেছি দেশে। এবার কর্মীদের নিয়ে ঈদ করতে পারব। আনন্দের যেন শেষ নেই।
কিশোরগঞ্জ-২ (ভৈরব-কুলিয়াচর) আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল আলম নির্বাচনি এলাকা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যোগ দিয়েছেন ইফতার পার্টিতে। ঈদসামগ্রী বিতরণ করছেন এলাকাবাসীর মধ্যেও।
বলেন, ‘গত ১৫-১৬ বছর আমি কেন, আমার কোনো নেতাকর্মী বাড়িতে ঈদের আনন্দ করতে পারেনি।’ রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘আমার এলাকা ফ্যাসিবাদী সরকারের রাষ্ট্রপতিগণের বাড়ি। তাদের কর্মী-সমর্থকদের দাপটে কারো বাড়ি থাকার উপায় ছিল না। এবার তারা নাই, পুলিশ তাদের অবৈধ আদেশ শোনে না। দেশজুড়ে একটা উৎসবের আমেজ।
বিএনপির একটি সূত্র বলছে, তৃণমূলে সহস্রাধিক ইফতার মাহফিল করেছেন বিএনপির তৃনমূলের নেতারা। অতীতে বিএনপির ইফতার মাহফিলের বেশির ভাগ কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীনেরা হামলা ও বাধা দিলেও এবার ঘটেনি তেমন কোনো ঘটনা। তবে বিএনপির সম্ভাব্য সুদিনের মসৃণ পথে কাটা দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতও চষে বেড়িয়েছে দেশের এ-প্রাপ্ত থেকে ও-প্রান্ত।
বিএনপিতে সবচেয়ে বেশি খুশি জিয়ার পরিবার। প্রায় সাত বছর পর পরিবারের সঙ্গে লন্ডনে এবার ঈদ করবেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দুই পুত্রবধূ ও নাতনিদের সঙ্গে ঈদ করবেন তিনি।
বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, ঈদের দিন বিএনপির চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র নেতারা ভার্চুয়ালি শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন। এছাড়া ঈদের দিন সকালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে ফাতিহা পাঠ ও দোয়া করবেন দলের সিনিয়র নেতারা। জানা গেছে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঈদ করবেন ঢাকায়।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সেলিমা রহমান ও সালাউদ্দিন আহমেদও ঢাকায় ঈদ করবেন। এর মধ্যে সালাউদ্দিন আহমেদের নিজ এলাকা কক্সবাজারে যাওয়ার কথা রয়েছে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান ও অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন লন্ডনে ঈদ করবেন। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকায় ঈদ করবেন।
এছাড়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান ও আবদুল আউয়াল মিন্টু ঢাকায়, বরকত উল্লাহ বুলু নোয়াখালীতে, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ঢাকায় এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু নাটোরে নিজ এলাকায় ঈদ করবেন। যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন নরসিংদীতে, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি লক্ষ্মীপুরে ঈদ করবেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি তো দেশে ছিলাম না অনেক বছর। প্রায় এক দশক পর নিজ বাড়িতে ঈদ। ভাবতেই ভালো লাগছে। স্বৈরচার আওয়ামী লীগের পুলিশ আমাকে উত্তরা থেকে তুলে নিয়ে আয়নাঘরে বন্দি করে রাখে।
তারপর পাঠিয়ে দেয় ভারতে। সেখানেই কাটে ৯ বছর। ঈদের খুশি আমার পরিবারে ছিল না। ৯ বছর পর পরিবারের সঙ্গে ঈদ করব, সে এক অন্যরকম আনন্দ। এবার কর্মীদের সঙ্গে কক্সবাজারে ঈদ করার ইচ্ছে আছে আমার।’
ঈদের খুশি আরও বাড়িয়ে তুলতে সাধারণ মানুষকে ঈদ উপহার দেওয়ার পাশাপাশি বিগত দিনে হত্যা-গুম, নির্যাতিত দলের নেতাকর্মীদের পরিবারের খোঁজ নেওয়ার পাশাপাশি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে পৌঁছে দিয়েছেন ঈদ উপহার। জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত পরিবারের কাছে ঈদ উপহার পৌঁছে দিয়েছে জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন।