সোমবার, ০৭ এপ্রিল, ২০২৫

দেশ অশান্ত করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র

এফ এ শাহেদ

প্রকাশিত: এপ্রিল ৬, ২০২৫, ১০:২৫ এএম

দেশ অশান্ত করতে  নানামুখী ষড়যন্ত্র

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত বছরের ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণের পর ছোট-বড় বিভিন্ন ইস্যুতে প্রায় ২০০টি আন্দোলন করে বিক্ষুব্ধ পেশাজীবী ও জনতা। এসব আন্দোলনের মূলে ছিল নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। 

গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ভারতে আশ্রয়ের পর থেকে মাঠের আন্দোলন ফিরে আসে নতুন-নতুন রূপে। শেখ হাসিনাসহ দলের সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে নেতাকর্মীদের কথোপকথনের অডিও ঘিরে নানা সময় অশান্ত হতে থাকে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ। 

বিভিন্ন সময়ে শেখ হাসিনাসহ দলের বিভিন্ন শীর্ষ নেতার ফাঁস হওয়া ফোনালাপ থেকে শোনা যায়, বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের তারা দিকনির্দেশনা দেন। ঈদকে ঘিরে গার্মেন্ট সেক্টরে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রও করেন। টাকার বিনিময়ে অবরোধ, মিছিল, জ্বালাও-পোড়াওসহ সংঘবদ্ধ অপরাধে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার নানামুখী ষড়যন্ত্র চলে।

অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ আওয়ামী নেতাদের দেওয়া বক্তব্য ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, একই সঙ্গে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ফোনে দেওয়া হচ্ছে নির্দেশনা। দেশকে অস্থিশীল করতে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছেন তারা কতটুকু কাজ করছেন কর্মীরা। প্রবাসে থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের সংঘবদ্ধ হয়ে মাঠে নামার নির্দেশনা দিচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

একের পর এক ফাঁস হওয়া ফোনালাপে শোনা যাচ্ছে উস্কানিমূলক বক্তব্য। আবারও ফাঁস হওয়া ফোনকলে শোনা যায়, শেখ হাসিনা বলেন- ‘সংগঠিত হয়ে দুই গ্রুপে মাঠে নামতে হবে। যদি হামলা হয়, তাহলে পাল্টাহামলা চালাতে হবে।’ এতে নিজ দলের অনেক নেতাকর্মী তার এই বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, ‘যিনি সংকটের মুহূর্তে আমাদের ফেলে পালিয়ে গেছেন, তার কথায় আর কেউ মাঠে নামবে না। দলের বর্তমান দুরবস্থার জন্য তিনি ও তার আশপাশের কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাই দায়ী।’

দিল্লিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার শেষ ফাঁস হওয়া ফোনালাপে যুবলীগের এক শীর্ষ নেতাকে নির্দেশ দিতে শোনা যায়, যেখানে তিনি বলছেন- ‘যত দ্রুত সম্ভব আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় উদ্ধার করতে হবে। ৫০-১০০ জন গেলেও কি তারা মেরে ফেলবে? কেউ হামলা করলে কঠোর জবাব দিতে হবে। 

এমনকি বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার জন্যও নির্দেশ দেন তিনি। এদিকে, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ফেসবুক পেজে হরতাল, মশাল মিছিল, লিফলেট বিতরণের মতো নানা কর্মসূচিও দেওয়া হচ্ছে। যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করতে উসকে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ছাড়াও জড়িত আছেন সাবেক বেশ কয়েকজন প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও।

সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে রুটিন পদক্ষেপের পাশাপাশি ঈদকে ঘিরে গার্মেন্ট সেক্টরে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রও চালানো হয়। টাকার বিনিময়ে অবরোধ, মিছিল, জ্বালাও-পোড়াওসহ বিভিন্ন সংঘবদ্ধ অপরাধের প্রস্তুতিও  গ্রহণ করা হয়। যদিও সরকারের সংশ্লিষ্টরা প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রেণের মধ্যে ছিল। 

চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ জানান, দেশকে অশান্ত করতে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তির নানামুখী ষড়যন্ত্রের ঢেউ চলছে। এটি থামাতে হলে যৌক্তিক সংস্কার শেষে নির্বাচনের জন্য দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে হবে। দেরি হলে পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র আরও বাড়বে। নির্বাচনের বিষয়ে সরকার কী করবে জনগণের সামনে তা দৃশ্যমান করতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়া যত দীর্ঘায়িত হবে, চলমান সমস্যা আরও বাড়বে।

জাতির মধ্যে যে অস্থিরতা রয়েছে, তা কাটাতে হলে একটি নির্বাচন প্রয়োজন। যত দিন যাচ্ছে গণতন্ত্র উত্তরণের যাত্রাপথ বাধাগ্রস্ত করার কূটকৌশল লক্ষ করা যাচ্ছে। শুধু পুলিশ দিয়ে নয়, রাজনীতি দিয়ে ফ্যাসিবাদ মোকাবিলা করতে হবে। তাহলেই ফ্যাসিবাদের মূল উপড়ে ফেলা যাবে। সংস্কারের প্রথম প্রস্তাবক বিএনপি। দলটি সবার আগে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাবের সঙ্গে সরকারের কমিশনের খুব বেশি পার্থক্য নেই।

তিনি বলেন, গণহত্যার জন্য শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এখনো অনুশোচনা প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। বরং তাদের বক্তব্য শুনলে মনে হয়, অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়ারাই অপরাধী। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাল্টাতে হবে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার জানান, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে থেকে উসকানি দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করছে। তবে দেশ ও জাতির স্বার্থ রক্ষায় দল-মত-নির্বিশেষে সবাই যড়যন্ত্র রুখতে এক রয়েছে। তাদের এই যড়যন্ত্র সফল হবে না। 

তিনি জানান, নির্বাচন তো দিতেই হবে। তবে নির্বাচনের আগে নিরপেক্ষ প্রশাসন প্রয়োজন। প্রশাসনে যে জঞ্জাল জমে আছে। দলবাজ, দুর্নীতিবাজ- এসব ঝেঁটে প্রশাসনকে পরিচ্ছন্ন করতে হবে। এরা ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না। নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বার্থে সম্পৃক্ত পুলিশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, জুডিশিয়ারি, সাংবিধানিক কিছু বিধি-বিধান, রাষ্ট্রের কিছু অর্গান, যা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত এসব ন্যূনতম সংস্কার আগে করতে হবে। তাহলে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। অনেকের কথার মধ্য দিয়ে এখনো ফ্যাসিবাদের গন্ধ আসে। প্রশাসনের এই জায়গাগুলো পরিষ্কার করতে হবে। দুই মাস আগে কিংবা পরে নির্বাচন আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। 

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ষড়যন্ত্রের কথা আমরা অনেক শুনি, কিন্তু ষড়যন্ত্রের কথা বলে সব কিছু জায়েজ করা যাবে না। এখানে প্রশাসন আছে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আছে, যার লোকবল আছে, এর মধ্যে অনেক দোসররা- যারা বড় বড় পদে ছিল তারা এখনো বহাল তবিয়তে আছে। 

আর কেন আছে, তার জবাবও আপনাদের দিতে হবে। দেশে নারীর ওপর যখন নিপীড়ন হয়, কোনো মাজারে হামলা কিংবা কোনো ব্যক্তির ওপর মব আক্রমণ হয়, তখন মানুষ উত্তেজিত তো হবেই। এটা কি অভ্যুত্থানের চেতনা, অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা? অভ্যুত্থানের পর বলা হয়েছে, প্রত্যেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে, প্রত্যেক ধর্ম-গোষ্ঠীর ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে।

অন্তর্বর্তী সরকার যত দিন দায়িত্বে আছে, দেশটা ভালোভাবে চালানো তাদেরই দায়িত্ব।  প্রশাসন ঠিকভাবে কাজ করে না বিধায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। দ্রব্যমূল্যের অবস্থা খুব খারাপ ছিল, বারবার আমরা আওয়াজ তুলেছি, সরকার কিছুটা পদক্ষেপ নিয়েছে, ফলে আমরা দেখছি রমজান মাসে অনেকগুলো পণ্যমূল্য সহনশীল জায়গাতে ছিল। 

তাহলে সরকার যদি উদ্যোগ নেয় কিছু কাজ হয় সেটি স্পষ্ট হয়েছে। সময় কিছুটা লাগে, তবে আমরা কিন্তু ৭ মাস শেষে ৮ মাসে পা রেখেছি। এখন যদি বলেন, পুলিশ ঠিকভাবে কাজ করছে, তখন কিন্তু মানুষ শুনতে চাইবে না। জবাবদিহিতা মানুষ চায়।

 কোথায় পুলিশ শোনে না, কারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনি, কী ব্যবস্থা নিয়েছেন আপনি, এ বিষয়গুলো মানুষ জানতে চায়। কোথায় কোন প্রশাসন অবহেলা করছে, দীর্ঘসূত্রতা করছে, মানুষকে ঘোরাচ্ছে আর এসবের বিষয়ে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে মানুষ তা জানতে চায়।

জোনায়েদ সাকি বলেন, সংস্কারের বিষয়ে দুটো দিক আমরা বারবার বলছি, সংস্কারের অনেকগুলো জায়গা আছে। যেগুলো নির্বাচনের আগেই নির্বাহী আদেশে সংস্কার করা সম্ভব। আবার অনেকগুলো সংস্কারের প্রশ্নÑ যেগুলো কাঠামোগত, এগুলো আসলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের করতে হবে। সেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া সংবিধান পরিবর্তন করা আসলে কঠিন।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ জানান, যেকোনো ধরনের ষড়যন্ত্র রুখতে অন্তর্বর্তী সরকার তার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের সঙ্গে দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে নতুন বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে। নতুন বাংলাদেশের লড়াইটা সব দেশপ্রেমিক নাগরিকের।  

বর্তমান সরকার যদি সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে কিছুটা সময় ক্ষমতায় থাকতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের প্রকৃত উন্নয়নের যে যাত্রা, তার দ্বার উন্মুক্ত হবে। একই সঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনের শর্ত হচ্ছে- ১৪০০ শহিদের খুনির বিচার করতে হবে। 

সংস্কার, বিচার, নির্বাচন-এর কোনোটাকে একটার সঙ্গে আরেকটা সাংঘর্ষিক মনে করি না। এর পুরোটা মিলেই হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর পুরোটা মিলেই হচ্ছে আমার ৭১-এর মুক্তির লড়াই। এর পুরোটা মিলেই হচ্ছে আমার ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান। কিন্তু এই প্রত্যেকটা কাজ করতে হবে ঐকমত্যের ওপর ভিত্তি করে।

 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!