রাজধানী ঢাকা ছেড়ে সিলেটে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন সাবেক উপদেষ্টা ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম। তাও বিতর্কিত ব্যবসায়ী, মানি লন্ডারিং ও হুন্ডি ব্যবসায় অভিযুক্ত দুবাইর আল হারামাইন পারফিউমের মালিক মাহতাবুর রহমান নাসিরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আল হারামাইন হাসপাতালে। একটি ছবিতে সস্ত্রীক তাকে হাসপাতালে বসে থাকতে দেখা গেছে। তাদের হাতে ছিল ফুলের তোড়া। এ সময় তারা হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।
এ খবর জানাজানি হলে সিলেটে তোলপাড় শুরু হয়। গতকাল শনিবার বিষয়টি ছিল সিলেটের টক অব দ্য টাউন। ঢাকায় চিকিৎসার জন্য বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও নাহিদ গেল বৃহস্পতিবার বিকেলে কেন মফস্বল শহর সিলেটে বিমান থেকে নেমেই আল হারামাইনে গিয়ে চিকিৎসা নিলেন এবং হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন- এ প্রশ্ন এখন সবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বিষয়টি আগে থেকে মিডিয়া বা কাউকে জানানো হয়নি। এমনকি হাসপাতাল থেকেও কাউকে কিছু বলা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব প্রীতম দাশ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ঈদের ছুটিতে সিলেট আসার জন্য বিমানে উঠার সময় পা মচকে যায় নাহিদ ইসলামের। তাৎক্ষণিক তিনি কোনো সমস্যা অনুভব না করলেও সিলেট বিমানবন্দরে নেমে শ্রীমঙ্গল আসার পথে ব্যথা অনুভব করেন। পরে তাৎক্ষণিক খোঁজখবর নিয়ে তাকে আল হারামাইন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালটির অর্থোপেডিক ডাক্তার জোবায়ের আহমদের কাছে চিকিৎসা নেন তিনি। তবে হাসপাতাল পরিদর্শনের বিষয়টি সঠিক নয় বলেও জানিয়েছেন তিনি।
আল হারামাইন হাসপাতালের জিএম পারভেজ আহমদ গণমাধ্যমকে জানান, বৃহস্পতিবার পায়ে আঘাত পেয়ে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে এসেছিলেন নাহিদ। অর্থোপেডিক্স ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তিনি হাসপাতাল ত্যাগ করেন।
এদিকে নাহিদ ইসলাম এমন সময় সিলেটে গিয়ে বাংলাদেশে থাকা বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত ব্যবসায়ী মাহতাবুর রহমান নাসিরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আল হারামাইন পরিদর্শন করেন, যখন নাসিরের বিরুদ্ধে মামলা ঝুলছে। তার মাথার ওপর অভিযোগের পাহাড়। দুদক মাঠে ব্যস্ত রয়েছে হুন্ডিসহ নানা অভিযোগের তদন্তে।
সিলেটে নাসিরের বাসা কাজী ক্যাসলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের আশ্রয় দেওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে! এমনকি যখন নাসিরের ব্যাংক হিসাব পরিচালনা ও তাকে অবৈধ সুযোগ দেওয়ার অভিযোগে ব্যাংকের সিলেট লালদীঘির পাড় শাখার ব্যবস্থাপক পিযুষ কুমার সরকারকে শাস্তিমূলক বদলি করেছে, তখন আল হারামাইনে নাহিদের এই সফর আলোচনার খোরাক জোগাচ্ছে।
এনসিপির নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ২টার দিকে ইউএস-বাংলার ফ্লাইটে (বিএস-৫৩৫) স্ত্রীসহ ঢাকা থেকে সিলেট আসেন নাহিদ ইসলাম। পরে বিকেল ৩টার দিকে সিলেট নগরীর সোবহানীঘাট এলাকায় অবস্থিত আল হারামাইন হাসপাতালে যান।
সেখানে ঘণ্টাখানেক অবস্থানের পর সড়কপথে মৌলভীবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। শুক্রবার রাতে তিনি শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে বনবিভাগের একটি বাংলোতে অবস্থান করেন। গতকাল শনিবার শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকায় ফিরেন তিনি।
মাহতাবুর রহমান নাসির বর্তমানে দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশে তার ব্যবসা ও আল হারামাইন হাসপাতাল দেখাশোনা করেন তার বড় ভাই ওয়ালিউর রহমান। বৃহস্পতিবার তিনি হাসপাতালে ছিলেন।
কিছুদিন আগে দেশে পারফিউম ব্যবসার আড়ালে সবচেয়ে বড় হুন্ডি তৎপরতার প্রমাণ পায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থাটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) অনুসন্ধান চালিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের জন্য অভিযুক্ত করে আল হারামাইন পারফিউমসকে।
কোম্পানির মালিক সিলেটের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান নাসির। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এ ব্যবসায়ী এখন গোল্ডেন ভিসার আওতায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) বসবাস করছেন।
দুদুকের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, মাহতাবুর রহমান নাসিরের পুরো ব্যাবসায়িক নেটওয়ার্কই হুন্ডি তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। পারফিউম বা আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার আড়ালে তার প্রধান ব্যবসা মূলত এক দেশের অর্থ অন্য দেশে পাচার করা। মাহতাবুর রহমান নাসির এনআরবি ব্যাংকের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান।
এই ব্যাংকের মাধ্যমেই তিনি টাকা পাচার করতেন। বিশ্বের অন্তত ৮৬টি দেশে হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে মাহতাবুর রহমান টাকা পাচার করেন বলেও জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিটি টার্মেই তিনি নিয়েছেন বিশেষ সুবিধা। সব মিলিয়ে সরকারি মন্ত্রী আমলাদের খুশি করে পরপর ১১ বার হয়েছিলেন সিআইপি। আওয়ামী সরকারের তহবিলের অন্যতম জোগানদাতাও তিনি। আলোচিত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজেরও পতন শুরু হয় এই মাহতাবুর রহমান ও তার সহযোগীদের হাত ধরেই।
মাহতাবুর রহমান ছিলেন এই বেসরকারি বিমান সংস্থাটির এমডি। পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটির ১২টি বিমান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড্ডয়ন অনুপযোগী হয়ে আছে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, বিদেশে টাকা পাচার, ব্যাংক থেকে নিয়মবহির্ভূত সুবিধা নেওয়ার জন্য তিনি এনআরবি ব্যাংক সিলেট শহরের লালদিঘী শাখার ম্যানেজার পিযুষ কুমার সরকারকে খাস লোক বানিয়ে সেই শাখায় বসিয়েছিলেন। এই শাখাতেই আল হারামাইনের সব হিসাবে লেনদেন করা হতো।
ব্যাংকিং ও আর্থিক লেনদেনের যাবতীয় কার্যক্রম দেখাশোনা করতেন পিযুষ কুমার সরকার। তার মাধ্যমেই সিলেট থেকে টাকা পাচার হতো। এ অভিযোগে শাখার ব্যবস্থাপককে গত ১৫ মার্চ শাস্তিমূলক বদলি করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
দুদকের জালে মাহতাবুর রহমান নাসির যখন ফেঁসে যান, সেখানে নাম ঝড়িয়ে পড়ে শাখা ব্যবস্থাপক পিযুষ কুমারের। তারপরই ব্যাংকের এমডি তারেক রিয়াজ খান তাকে বদলি করেন। তবে বদলি হলেও পদায়ন না হওয়ায় এখন তিনি সিলেটে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করছেন।
মাহতাবুর রহমান নাসির প্রথম আলোচনায় আসেন সিলেটের ইসলামপুর এলাকায় বিয়ানীবাজার উপজেলার চারখাই ইউনিয়নের নোয়াগ্রামে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণের মধ্য দিয়ে। প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে অজপাড়াগাঁয়ে তিনি গড়ে তোলেন প্রাসাদসম অট্টালিকা। পরে শহরের মেজরটিলার ইসলামপুরে নির্মাণ করেন আরেক অত্যাধুনিক প্রাসাদসম ‘কাজী প্যালেস’। এই বাড়ি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৫০০ কোটি টাকা। যা এযাবৎকালের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাড়ি হিসেবে আলোচিত।
অন্যদিকে গত ২২ জানুয়ারি মাহতাবুর রহমান নাসির ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ (অবরুদ্ধ) করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)।
ব্যাংক হিসাবে জব্দের তালিকায় আছেন মাহতাবুর রহমানের ছেলে মোহাম্মদ এমাদুর রহমান, ভাই মোহাম্মদ ওলিউর রহমান, ভাতিজা মোহাম্মদ আশফাকুর রহমান ও মোহাম্মদ এহসানুর রহমান এবং আল হারামাইন গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সাব্বির আহমেদ।
এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, ‘মাহতাবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যরা আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের সদস্য। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের হুন্ডির ব্যবসা রয়েছে। দেশ থেকে অর্থ পাচারেরও অন্যতম বড় রুট হলো এ পরিবার। এনবিআরসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে এ-সংক্রান্ত অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতেই মাহতাবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। ব্যাংক হিসাব ছাড়াও পরিবারটির বিভিন্ন সদস্যের নামে থাকা ১১৪টি দলিল জব্দ করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা তাদের সম্পদও শনাক্ত করার কাজ চলছে।’
আপনার মতামত লিখুন :