সোমবার, ০৭ এপ্রিল, ২০২৫

বিশ্বব্যাংকের ২৫ কোটি টাকা লোপাটের পাঁয়তারা

শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার

প্রকাশিত: এপ্রিল ৬, ২০২৫, ১২:০৮ পিএম

বিশ্বব্যাংকের ২৫ কোটি টাকা লোপাটের পাঁয়তারা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের টেকনাফ রেঞ্জের মধ্য হ্নীলা বিটে নার্সারিতে প্রায় আড়াই লাখ গাছের চারা কেটে নষ্ট করা হয়েছে। রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তরা নার্সারিতে গাছের চারা কেটে নষ্ট করেছে বলে বন বিভাগের দাবি। গত ৩ এপ্রিল রাতে ওই নার্সারিতে গাছের চারাগুলো কেটে ফেলা হয়। গাছের চারা কেটে ফেলা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে।

একই দিন সকালে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম, সহকারী বন সংরক্ষক মনিরুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট বনকর্মীরা নার্সারি পরিদর্শনে যান। ওই দিন টেকনাফ বন বিভাগের রেস্টহাউজে সেই দিন রাতযাপন করেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম। এ রাতেই আড়াই লাখ গাছের চারা কেটে ফেলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনাকে স্থানীয় সচেতন মহল ভিন্ন চোখে দেখছে।

তথ্য বলছে, বিশ্বব্যাংকের বরাদ্দকৃত হেল্প প্রকল্পের বনায়নে অর্থ লোপাটের কৌশল হিসেবে বনায়ন সৃজন না করেই বরাদ্দের অর্থ আত্মসাতের পরিকল্পনায় খোদ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নুরুল ইসলামের পরামর্শেই বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারাগুলো কেটে নষ্ট করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছেন, উখিয়া, টেকনাফ ও রামুতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কর্তৃক জ্বালানির জন্য বনজ সম্পদ সংগ্রহের ফলে খালি হয়ে যাওয়া অবশিষ্ট বনভূমি দ্রুত ২ হাজার ২৮০ হেক্টর বনায়ন করার জন্য বিশ্বব্যাংক ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এই বরাদ্দের অংশ দিয়েই টেকনাফ, হোয়াইক্যং, শীলখালী, উখিয়া সদর, ইনানী, রাজারকুল, পানেরছড়া, কক্সবাজার সদরসহ ৯টি রেঞ্জের ৪০টি বনবিটের নার্সারিতে গাছের চারা উত্তোলনের কাজ চলমান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উখিয়া, টেকনাফ ও রামুতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কর্তৃক জ্বালানির জন্য বনজ সম্পদ সংগ্রহের কারণে খালি হয়ে যাওয়া অবশিষ্ট বনভূমিতে দ্রুত বনায়নের উদ্যোগ নেয় বন বিভাগ।

রোহিঙ্গা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হিসেবে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ ও উপকূলীয় বন বিভাগের অধীনে নোয়াখালীর ভাসানচরে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হেল্প প্রকল্পের আওতায় নতুন বনায়নের জন্য নার্সারি সৃজন করা হচ্ছে। 

সূত্রমতে, কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগে ২ হাজার ২৮০ হেক্টর নতুন বনায়নের জন্য হেল্প প্রকল্পের প্রায় ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় বিশ্বব্যাংক। 

এরই মধ্যে টেকনাফ, উখিয়া ও রামু উপজেলার কিছু অংশে বিভিন্ন রেঞ্জ ও বনবিটে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চলতি বছরের জুনে ২ হাজার ৮০ হেক্টর নতুন বনায়ন সৃজন কার্যক্রম শুরু করা হয়। বনভূমি খালি না থাকায় অবশিষ্ট ২০০ হেক্টর বনায়ন আগামী বছর সৃজনের কথা রয়েছে। এ লক্ষ্যে স্ব-স্ব রেঞ্জ ও বনবিটে নার্সারিতে চারা উত্তোলন করা হচ্ছে। 

দিনে দিনে বেড়ে উঠছে গাছের চারা। এর মাঝে টেকনাফ রেঞ্জের মধ্যম হ্নীলা বন বিটে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাগান সৃজনের জন্য নার্সারিতে বিভিন্ন প্রজাতির চারা সৃজন করা হয়। গত ৩ এপ্রিল মধ্য হ্নীলা বিটের নার্সারির প্রায় আড়াই লাখ চারাগাছ কেটে নষ্ট করা হয়েছে।

টেকনাফ রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুর রশিদ জানিয়েছেন, রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তরা নার্সারির চারা কেটে নষ্ট করেছে। কারা এবং কী কারণে চারাগাছ কেটে ফেলেছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পারেননি তিনি। তবে বন বিভাগের এই দাবিকে হাস্যকর বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। 

তারা বলেন, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নুরুল ইসলামের নির্দেশেই এসব চারাগাছ কেটে ফেলা হতে পারে। বিশ্বব্যাংকের বরাদ্দের অর্থ আত্মসাতের কৌশল ও বনায়ন সৃজন না করতে এবং কালক্ষেপণ করতে এই নাটকীয় কাজ করছে বলে অভিযোগ। 

স্থানীয় বাসিন্দা ও বনকর্মীরা জানিয়েছেন, কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম, সহকারী বন সংরক্ষক মনিরুল ইসলামসহ বনকর্মীরা ৩ এপ্রিল সকালে ওই নার্সারি পরিদর্শন করেন।

একই দিন টেকনাফ রেস্টহাউসে রাত্রি যাপন করেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম। ওই দিনই গভীর রাতে আড়াই লাখ গাছের চারা কেটে নষ্ট করার ঘটনা ঘটেছে।

এ ব্যাপারে সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ উখিয়া-টেকনাফ) মনিরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, আমরা ৩ এপ্রিল নার্সারি পরিদর্শন করার পরে ৪ এপ্রিল খবর পেয়েছি দুষ্কৃতকারীরা রাতে নার্সারির চারাগুলো কেটে নষ্ট করেছে। এ বিষয়ে আমরা থানায় জিডি করেছি। কারা, কী কারণে কেটেছে, তা উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছি।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নুরুল ইসলামের বক্তব্য জানতে সরকারি ও ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার কল করে ও খুদেবার্তা পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন বিভাগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নার্সারিতে গাছের চারা সৃজন থেকে শুরু করে জঙ্গল কাটা ও বনভূমিতে গাছের চারা রোপণ পর্যন্ত প্রতি হেক্টরের বিপরীতে লক্ষাধিক টাকা বরাদ্দ রয়েছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রেঞ্জ ও বনবিট কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রতি হেক্টরের জন্য লক্ষাধিক টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও মাঠ পর্যায়ে তারা বরাদ্দ বুঝে পাচ্ছে ৬৯ হাজার টাকা। কিন্তু বিল-ভাউচার এবং অন্যান্য ডকুমেন্টসে স্বাক্ষর করতে হয় এক লাখ টাকা বুঝিয়ে নেওয়ার। 

অবশিষ্ট ৩১ শতাংশ টাকা ডিএফওর ক্যাশিয়ার সহকারী বন সংরক্ষক মনিরুল ইসলাম ও ফরেস্টার আলী নেওয়াজের মাধ্যমে নগদে কমিশন হিসেবে কেটে নেওয়া হয়েছে। এই শর্তে রাজি না হলে বনায়ন বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া অথবা একেবারেই বনায়ন বরাদ্দ দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।

তারা আরও জানান, ৬৯ শতাংশ টাকা বরাদ্দ দিলেও সহকারী বন সংরক্ষণকেও ৫ শতাংশ কমিশন দিতে হয়। এভাবে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে বরাদ্দের অর্থ দাঁড়ায় ৪০ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশ টাকা। এতে করে সঠিক বনায়ন সৃজন ভেস্তে যাচ্ছে। 
শুধু বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নুরুল ইসলামই বিশ্বব্যাংকের হেল্প প্রকল্পের বরাদ্দের ২৫ কোটি টাকা থেকে ৮ কোটি টাকা একাই মেরে দিয়েছেন বলে অভিযোগ। 

এমন উদ্ভট নিয়ম নতুন ডিএফও নুরুল ইসলাম আসার পরই চালু করায় বন বিভাগে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। পাশাপাশি রেঞ্জ ও বিট কর্মকর্তারাও বনায়নের অর্থ লোপাটের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। বরাদ্দের টাকা সঠিক ব্যয় করে প্রতিটি প্রজাতির গাছের চারা সঠিকভাবে রোপণ ও পরিচর্যা করা হলে পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য লাভজনক হবেÑ এমনটাই অভিমত সচেতন মহলের।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!