ঢাকা বুধবার, ০৯ এপ্রিল, ২০২৫

৭ বছর ধরে অকার্যকর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ

সেলিম আহমেদ
প্রকাশিত: এপ্রিল ৭, ২০২৫, ১২:৫২ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

নির্বাচন না হওয়া বিগত সাড়ে ৭ বছর থেকে অকার্যকর হয়ে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণের সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল। 

নির্বাচিত কমিটি না থাকায় কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ জেলা-উপজেলা সংসদের নেই কোনো কার্যক্রম। প্রশাসনিকসহ যতটুকু কার্যক্রম রয়েছে তাও চলছে আমলাদের দিয়ে। 

২০১৭ সাল থেকে সংসদের কেন্দ্রীয় প্রশাসকের অতিরিক্তি দায়িত্ব পালন করছেন সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব। বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়া তার পা পড়ে না সংসদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। 

এ ছাড়া জেলা সংসদে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা সংসদে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। 

তারাও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অফিসে প্রয়োজন ছাড়া না যাওয়ায় অধিকাংশ সময় তালাবদ্ধ থাকে কার্যালয়। ফলে এক সময়ের জমজমাট এই সংগঠনটির ক্রমেই অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপ নিচ্ছে। 

৩৩ মাস অনিয়মিত হয়ে পড়েছে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কর্মচারীদের বেতনও।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) হওয়ার আগে সব কাজ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল থেকে করা হতো। তখন সবচেয়ে জমাজমাট ছিল এটি। 

জামুকা গঠন হওয়ার পর কাজ কমে গেলেও নির্বাচিত কমিটি থাকায় প্রাণোচ্ছ্বল থাকত সংগঠনটি। এখন মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র, দিবস পালন ও প্রত্যয়নপত্র দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। 

নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা না আসায় এবং কোনো কার্যক্রম না থাকায় অনেক ভূতুড়ে প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে সংগঠনটি। 

এদিকে নির্বাচন না হওয়ার পেছনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জামুকাকেই দায়ী করছেন মুক্তিযোদ্ধারা। 

তারা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যকর হলে জামুকার নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে। তাই মন্ত্রণালয় ও জামুকা কৌশলে নির্বাচন আটকে রেখেছে। 

ভূতুড়ে পরিবেশ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, ৩৩ মাস থেকে নেই কর্মচারীদের বেতন: সরেজমিনে গতকাল রোববার রাজধানীর মগবাজারে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। 

কাজ না থাকায় অলস সময় পার করছেন অফিসের কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জরাজীর্ণ ভবনগুলোর দেয়ালের আস্তরণ খুলে খুলে পড়ছে। মাঠে বিশাল ময়লার স্তূপ। 

সংসদের ভবনগুলোর অধিকাংশ রুমের দরজা-জানালা ভাঙা। দু-একটি রুমে ভাঙাচূড়া চেয়ার-টেবিলে বসে দৈনন্দিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন কর্মচারীরা। 

প্রায় তিন ঘণ্টা অবস্থান করে দেখা মিলে একজন মুক্তিযোদ্ধার। দায়িত্বরত এক কর্মচারী বলেন, এক সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনায় দিনভর মুখর থাকত মুক্তিযুদ্ধ সংসদ কার্যালয়। 

প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনুষ্ঠান থাকত। কিন্তু সংসদের নির্বাচন ও কমিটি না থাকায় এখন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনো মুক্তিযোদ্ধা আসেন না। কমিটি না থাকায় সংগঠনটির কার্যক্রমও খুব একটা নেই। 

নামমাত্রভাবে শুধু সরকারি দিবসগুলো পালন করা হয়। কোনোদিন হাতেগোনা দুই-এক মুক্তিযোদ্ধা এলেও তাদের পরামর্শ দেওয়ারও কেউ নেই। 

শুধু তাই নয়; নির্বাচিত কমিটি না থাকায় সেখানে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনও অনেকটা অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। টানা ৩৩ মাস থেকে বেতন পাচ্ছেন না প্রতিষ্ঠানটির ২২ জন কর্মচারী। তবে বেতন সংকট সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, এক সময় বিভিন্ন হাট-বাজার ইজারার লভাংশ থেকে ৪ শতাংশ পেত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল। সেই আয় দিয়েই চলছে সংসদের কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য খরচ। 

২০০৬ সালের দিকে সেই লভ্যাংশ নিয়ে নেয় মন্ত্রণালয়। তারপর থেকে শুরু হয় অর্থ সংকট। এরপর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের আয় থেকেও ২০২২ সাল পর্যন্ত কর্মচারীদের বেতন হতো। 

কিন্তু সেই ক্রীড়া চক্রের কার্যক্রমও স্থগির হয়ে যাওয়ায় পুরোপুরি অর্থসংকটে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। তিনি আরও বলেন, যখন নির্বাচিত কমিটি ছিল তখন এই সমস্যাগুলো হতো না। 

তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে সরকারি-বেসরকারি বরাদ্দ এনে জমজমাট পাবে সংগঠনটি পরিচালনা করতেন। 

যেভাবে আটকে যায় সংসদের নির্বাচন: সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ ছিল তিন বছর। ২০১৭ সালের ৮ জুন সর্বশেষ কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। 

কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক মাস আগে তৎকালীন চেয়ারম্যান হেলাল মোর্শেদ খান ও মহাসচিব এমদাদ হোসেন মতিনের নেতৃত্বাধীন কমিটি গঠনতন্ত্র সংশোধন করে তাদের মেয়াদ ৫ বছর করার জন্য প্রস্তাব চূড়ান্ত করে। 

এভাবে নির্বাচিত কমিটি তাদের নিজেদের মেয়াদ বাড়ানোয় ক্ষোভ জানিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে মন্ত্রণালয় ও জামুকায় অভিযোগ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। এরপর বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিটও করেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। 

মেয়াদ বাড়ানোর ইস্যুতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃত্ব নিয়ে দেশব্যাপী অচলাবস্থা তৈরি হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্যে ওই বছরের ১২ জুলাই হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ প্রশাসক নিয়োগের আদেশ দেন।

এরই ধারাবাহিকতায় মন্ত্রণালয় থেকে একই বছরের ১৯ জুলাই সংসদ পরিচালনার জন্য পৃথক প্রশাসক নিয়োগের অফিস আদেশ জারি করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। 

দেশে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একটি কেন্দ্রীয় কমান্ড, ৭টি মহানগর কমান্ড, ৬৪টি জেলা ও ৪৭০টি উপজেলা কমান্ড কাউন্সিল রয়েছে। এর নেতৃত্বে এখন ডিসি ও ইউএনওরা। 

সর্বশেষ ২০২৩ সালের ১৩ মে সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করেছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু পরবর্তীতে সেই নির্বাচন স্থগিত করা হয়। 

এরপর নির্বাচন নিয়ে আর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও এই নির্বাচন নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা নেই বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। 

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকটি সূত্র বলছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাচাই করার উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য  মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ করে জামুকা অধ্যাদেশ তৈরি করা হচ্ছে। 

অধ্যাদেশটি  চূড়ান্ত হওয়ার পরেই বড় পরিসরে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই শুরু করা হবে দেশজুড়ে। এই কাজে মাঠপর্যায়ে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করা হবে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে। 

মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে সক্রিয় ও সংসদের নির্বাচনের ধারাও সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া আছে জামুকার খসড়া অধ্যাদেশে। আগামী এপ্রিলের মধ্যেই অধ্যাদেশটি উপদেষ্টা পরিষদের সভায় চূড়ান্ত হতে পারে।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য: জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ইশতিয়াক আজিজ উলফাত বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন নিয়ে খুব একটা ভাবছেন না। 

তারা সিলেকশন করে সংসদ চালাবে। জাতীয় নির্বাচনের নির্বাচিত সরকার এসে এই সংসদেরও নির্বাচন দিয়ে সংসদকে কার্যকর করা উচিত বলে আমি মনে করি। 

এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে সক্রিয় করতে চাই। এর জন্য জামুকা অধ্যাদেশ পাস করতে হবে। এখন সংসদে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রয়েছে। প্রশাসকে কাজ হচ্ছে না। সংসদ গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত।