প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাসকৃত মহানগরী ঢাকার সিংহভাগ মাদক সরবরাহ হয় বস্তিগুলো থেকে। মাদক সিন্ডিকেটের মাফিয়ারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে নিরাপদে বস্তিতে মাদক মজুত করে। বস্তিগুলো থেকে ঢাকা শহরের গলিতে গলিতে মাদক পৌঁছে যায়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বস্তি হলো রাজধানীর মাদকের হাব। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ঢাকায় ঢোকার পর মাদক মজুত হয় বস্তিতে। মজুতকৃত মাদক বিভিন্ন হাত ঘুরে পৌঁছে যায় রাজধানীর সব ধরনের মাদকসেবীদের কাছে। অল্প পরিশ্রমে বেশি টাকার লোভে বস্তিগুলোর নারী-শিশু মাদক বহন ও বিক্রিতে জড়িত।
প্রকাশ্যে মাদক কেনাবেচা হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামমাত্র অভিযান চালিয়েও কাজে দিচ্ছে না। মাঝে মধ্যে বস্তির ছোট কারবারিরা ধরা পড়লেও নেপথ্যের হোতারা থেকে যায় অধরা। যারা বস্তিবাসীকে ব্যবহার করে বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছে মরণনেশা মাদকের কারবার।
রাজধানীর বস্তিবাসীদের মানবেতর জীবনের নানা গল্প হরহামেশা গণমাধ্যমে উঠে আসে। তবে এর উল্টো দিক বিশেষ করে অন্ধকার জগত নিয়ে বেশিরভাগ সময় অজানা থেকে যায়।
সরেজমিনে ঢাকা শহরের বস্তিগুলো ঘুরে দেখা গেছে, এখানকার বেশির ভাগ বাসিন্দা মাদক ব্যবসায় জড়িত। তবে, বস্তিবাসীরা কিন্তু মূল মাদক ব্যবসায়ী নয়।
তারা শুধু বহনের কাজ বা খুঁচরা বিক্রেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। বস্তিবাসীকে ব্যবহার করে রাজধানীর মাদক মাফিয়া সিন্ডিকেট সদস্যরা বছরে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করছে।
মহানগরীর মূল সমস্যা মাদক। রাজধানীতে মাদকের বিস্তার রোধ করাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে বস্তির কারণে। বস্তিগুলোতে অভিযান চালিয়ে সফলতার মাত্রা সীমিত।
মাদকবিরোধী অভিযানে গেলেও বস্তিবাসী একতাবদ্ধ হয়ে চড়াও হওয়ার গল্প নতুন নয়। অভিযান শেষ হলে ফের শুরু হয় প্রকাশ্য মাদক কেনাবেচা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো (উত্তর) কার্যালয়ের উপপরিচালক শামীম আহম্মেদ রূপালী বাংলাদেশকে জানান, রাজধানীর বস্তিগুলোতে আমাদের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
সবসময় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রতিদিন গ্রেপ্তার ও উদ্ধার করা হচ্ছে। বস্তিগুলোতে যাতে মাদক ব্যবসা বৃদ্ধি না পায় সেজন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদস্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
রাজধানীতে পাঁচ হাজারের বেশি বস্তি রয়েছে, যেখানে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের বসবাস। এর মধ্যে সর্ববৃহৎ কড়াইল বস্তিই ৫০ হাজারের বেশি মানুষের আবাসস্থল।
তবে শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্বের শহুরে জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের বাস বস্তিতে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ১১০ কোটি মানুষ শহরে বস্তি কিংবা বস্তির মতো পরিবেশে বসবাস করছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, আগামী ৩০ বছরে আরও ২০০ কোটি মানুষের ঠিকানা হবে বস্তি।
সম্প্রতি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা, মহানগরীর বস্তিকে ব্যবহার করে মাদক ব্যবসা বিস্তার নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দাখিল করে।
এই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মূলত বস্তিগুলো থেকেই রাজধানীর মাদক ব্যবসার বিস্তার ঘটছে। সংঘবদ্ধ মাদক সিন্ডিকেটের সদস্যগণ রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এলাকাগুলোকে ব্যবহার করছে নিরাপদ জোন হিসেবে।
বস্তিগুলোতে মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, প্যাথেডিন, চরশসহ সব ধরনের মাদক পাওয়া যায়। মাদক ব্যবসায়ীরা বস্তিতে অবস্থান করে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। পর্দার আড়ালে থেকে দেড় শতাধিক গডফাদার ঢাকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে।
যাদের নেতৃত্বে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ সহযোগী সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন স্পটে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য বিক্রি করছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া ও পাবলিক রিলেসন্স বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে জানান, থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ প্রতিদিন অভিযান পরিচালনা করে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করছে। বস্তিগুলোতে যাতে মাদক ব্যবসার বিস্তার না ঘটে সেদিকে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
ঢাকার বস্তিগুলো মাদকের করাল গ্রাসে বুঁদ হয়ে আছে। কিশোর থেকে শুরু করে তরুণ, এমনকি মাঝবয়সি ব্যক্তিরাও নেশায় আসক্ত হয়ে সমাজ, সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন।
পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সি নারী মাদক সেবন ও ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। সরেজমিনে বস্তিবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে মাদক সিন্ডিকেট বস্তিবাসীকে মাদক সরবরাহ কাজে ব্যবহার করা হয়।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী, রাজধানীতে পাঁচ শতাধিক মাদক স্পট রয়েছে। এসব স্পটে মাদক বিক্রেতা, মাদকসেবী, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) ইনামুল হক সাগর রূপালী বাংলাদেশকে জানান, পুলিশ মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। পুলিশের সবকটি ইউনিট নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
বস্তিবাসীদের নানা সংকটকে কাজে লাগিয়ে রাজধানীর মাদকের মাফিয়া সিন্ডিকেট মাদক ব্যবসায় ব্যবহার করে থাকে। সীমান্ত এলাকা থেকে ইয়াবা, বিভিন্ন ট্যাবলেট, গাঁজা, হেরোইন ও ফেন্সিডিল এনে মজুত করা এবং পরবর্তীতে তা মহানগরীতে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেয়। এর মধ্যে একটি অংশ খুঁচরাও বিক্রি করে তারা।
বস্তিবাসীর অনেকেই নেশা করে। যারা নেশা করে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও নেশার কারণে খারাপ হয়ে গেছে। আবার যারা কাজ পায় না, তাদের অবস্থাও খারাপ।
মাদকের ওপর তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সারা দেশে বিস্তৃত মাদক সিন্ডিকেটের মূল লগ্নিকারীরা মাদকদ্রব্য ধরে না, ছুঁয়েও দেখে না, তারা কেবল মধ্যস্থানে অবস্থানকারী লোকের মাধ্যমে মাদক ব্যবসায় কোটি কোটি টাকা পুঁজি বিনিয়োগ করে। তাই তারা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে।
মধ্যস্থানীয় ব্যবসায়ীরাও পর্দার আড়ালে থেকে সুকৌশলে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। তারাই প্রশাসন ও রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের ম্যানেজ করে। একেবারে নিম্ন পর্যায়ে অবস্থান করে স্থানীয় পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা।
সুকৌশলী মাদক সিন্ডিকেট অত্যন্ত চতুরভাবে মাদক ব্যবসায় মেয়েদেরকে ব্যবহার করছে। শিশু থেকে বৃদ্ধা সব বয়সি মহিলাদের ব্যবহার করছে তারা।
এ ব্যবসায় অনেকে মাদক সম্রাজ্ঞী হিসেবে ইতোমধ্যেই বেশ পরিচিতি অর্জন করেছে। গোয়েন্দা সূত্রমতে, রাজধানীর ৭০টি মাদক স্পট নিয়ন্ত্রণ করে মাদক সম্রাজ্ঞীরা। এসব সম্রাজ্ঞীর একেকজনের বাহিনীতে রয়েছে ১০-১২ সদস্য এবং রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণকারী প্রায় ২০০ সক্রিয় মহিলা মাদককর্মী রয়েছে এসব বাহিনীর সঙ্গে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস রূপালী বাংলাদেশকে জানান, রাজধানীর বস্তিগুলোতে মাদকের বিস্তাররোধে র্যাবের সংশ্লিষ্ট ব্যাটালিয়নগুলো সার্বক্ষণিক নজরদারি রেখেছে। পাশাপাশি নিয়মিত অভিযান চালিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করছে।
রাজধানীতে প্রায় দেড় হাজার ফেরারি আসামি মাদক ব্যবসায় জড়িত। মহানগরীতে প্রায় পাঁচ শতাধিক মাদক স্পট রয়েছে। প্রতিদিন এসব স্পটে মাদক সরবরাহ করার জন্য বস্তিগুলোকে ‘হাব’ বা কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহার হয়।
মাদক ব্যবসায় জড়িত দেড় হাজার দাগি আসামি বস্তিগুলোতে প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনার আলাদা আলাদা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। মাদক বেচাকেনা, চোরাচালান এবং হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১০-১২টি করে মামলা থাকলেও তারা মাদক বেচাকেনার আখড়া বসিয়ে প্রকাশ্যে ব্যবসা করছে।
মাদক সম্রাট দুর্ধর্ষ এ অস্ত্রবাজদের নাম ও আখড়াগুলোর তালিকা রয়েছে পুলিশ, গোয়েন্দা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে। বছর শেষে সে তালিকা পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও। মাঝে মাঝে লোকদেখানো অভিযান চলে প্রশাসনের, আটক করা হয় খদ্দের ও নিরপরাধ পথচারীদের।
সোর্সদের মাধ্যমে পথচলা মানুষের পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়েও গ্রেপ্তার-হয়রানির অসংখ্য নজির রয়েছে। তবে বরাবরই মাদকের মূল বেপারিরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে, বহাল তবিয়তে।
ডিএমপির বনানী থানার ওসি রাসেল সরোয়ার বলেন, কড়াইল বস্তিতে দুই অংশ মিলে প্রায় কয়েক লাখ মানুষের বসবাস। প্রতিদিন মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে জামিনে বেরিয়ে তারা আবারও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে।
বস্তিবাসীরা জন্ম থেকেই নেশায় আসক্ত বা মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার কারণে সহজে তারা এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।