বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: এপ্রিল ৮, ২০২৫, ০৯:১৭ এএম

থামছে না মৃত্যুর মিছিল

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: এপ্রিল ৮, ২০২৫, ০৯:১৭ এএম

থামছে না মৃত্যুর মিছিল

প্রতীকি ছবি

অব্যবস্থাপনার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের প্রধান সড়কগুলো মৃত্যুকূপে পরিণত হয়ে রয়েছে। সড়কগুলো মেরামতের নামে গত কয়েক বছর ধরে লুটেপুটে খেয়েছেন আওয়ামী লীগের লোকজন। 

দীর্ঘদিন অব্যবস্থাপনার কারণে ঈদুল ফিতরের ছুটি শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো স্থান থেকে ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনার খবর আসছে। এসব দুর্ঘটনায় কেউ ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছে, কেউ আবার গুরুতর আহত হয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা কিছুটা কমলেও থামছে না সড়ক দুর্ঘটনা। ঠেকানো যাচ্ছে না মৃত্যুর মিছিল!

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই থামছে না। দুর্ঘটনা রোধে প্রতিটি সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা শুনি। কিন্তু তাতে দুর্ঘটনা কমেনি, বেপরোয়া যান চলাচল বন্ধ হয়নি। এতে বোঝা যায়, দুর্ঘটনা রোধের পদক্ষেপগুলোয় অথবা সেসব কার্যকর করার ক্ষেত্রে নানা গলদ রয়ে গেছে। সেসব দূর করা খুবই জরুরি।

বিশেষজ্ঞদের দাবি, দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক উঁচু। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শতকরা ৮০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে বিরামহীন গাড়ি চালনা, অত্যধিক গতিতে গাড়ি চালনা এবং চালকের অসাবধানতার কারণে। এ

কজন চালক একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় গাড়ি চালাবেন, এটাই নিয়ম। কিন্তু দেশের কোনো চালকই এ নিয়ম পালন করেন না। 

ফলে একজন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত চালক যখন গাড়ি চালান, তখন স্বভাবতই দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে বেশি। এজন্য মূলত বাসমালিকদের অত্যধিক ব্যাবসায়িক মনোভাবই দায়ী। এই প্রবণতা রোধে সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

সচেতন মহল বলছে, একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না- কথাটি আমরা সবাই জানি। অথচ দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার হার বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন রক্তাক্ত হচ্ছে সড়ক। ঝরছে অসংখ্য প্রাণ। 

প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমে অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনার খবর চোখে পড়ে। দুর্ঘটনা রোধে আইনকানুন ও বিভিন্ন বিধিনিষেধ থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।

দুর্ঘটনায় প্রিয়জন হারিয়ে বিষাদে পরিণত হচ্ছে ঈদ আনন্দ: ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। এই আনন্দ বাড়িয়ে দেয় প্রিয়জনের সান্নিধ্য। প্রিয়জনের সঙ্গে উৎসবের আমেজ ভাগাভাগি করতে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর থেকে গ্রামে ছুটে চলা মানুষের আনন্দকে বিষাদে পরিণত করে সড়ক দুর্ঘটনা। 

দুর্ঘটনায় প্রতি বছরই হারিয়ে যায় অনেক পরিবারের আপনজন। তথ্যমতে, ঈদের আগের সাত দিন, ঈদের দিন ও ঈদের পর তিনদিন- এই মোট ১১ দিনকে ঈদযাত্রা হিসেবে ধরা হয়। 

এবারের ঈদযাত্রায় মোট কতগুলো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখনো কোনো মাধ্যম থেকে পাওয়া যায়নি। তবে সড়কে অব্যবস্থাপনা, দুর্ঘটনা রোধ নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গতকাল সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ঈদের আগে-পরে মিলিয়ে গত ২৬ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে মোট ২৫৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। 

এতে নিহত হয়েছেন ২৪৯ জন এবং আহত ৫৫৩ জন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়,  গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এ সময় আহত হয়েছেন ৫৫৩ জন। কিন্তু বাস্তবে আহতের সংখ্যা ২ হাজারে বেশি। 

শুধু ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালেই ঈদের ২ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ৫৭১ জন ভর্তি হয়েছেন উল্লেখ করে বিবৃতিতে জানানো হয়, আহতদের অধিকাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আক্রান্ত। এই বাস্তবতায় সারাদেশে আহতের সংখ্যা ২ হাজারের বেশি হবে। ৫৯ শিশু ছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১ জন নারী নিহত হয়েছেন।

সূত্রমতে, শুধু ঈদের দিন আট জেলায় সড়কে ঝরেছে ১৬ তাজা প্রাণ। অথচ সড়ক-মহাসড়কে সেদিন গাড়ি ছিল খুবই কম। সব মিলে ঈদের ছুটি শেষে হিসাব করলে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা হয়তো শত ছাড়িয়ে যাবে। 

বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ৫৯৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হয় ৫৭৮ জন। আহত হয় কমপক্ষে ১ হাজার ৩২৭ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে নারী ৭৮ ও শিশু ৮৭ জন। 

আর জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ৬২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬০৮ জন নিহতের তথ্য দিয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, ওই মাসে অন্তত ১ হাজার ১০০ জন আহত হয়।  নিহতের মধ্যে নারী ৭২, শিশু ৮৪ জন। ২৭১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয় ২৬৪ জন, যা মোট নিহতের ৪৩ দশমিক ৪২ শতাংশ।

গত বছরের তুলনায় এ বছর ঈদের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে: এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চলতি বছরে এবারের ঈদে কমেছে সড়ক দুর্ঘটনা। গত বছরের তুলনায় এ বছর ঈদের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনা কিছুটা কম। 

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এবং মানুষের শান্তিপূর্ণভাবে ঈদ উদ্যাপনে বর্তমান সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ায় সড়কে দুর্ঘটনা কমেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এ বছর ঈদের আগে থেকে সারা দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সড়কে কঠোর নজরদারি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে। 

সে কারণে সড়কে দুর্ঘটনার হার কমছে। এ বছর ঈদের ছুটিতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি ও আনসার কেউ ছুটিতে বাড়ি যায়নি। রাজধানী ঢাকার নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। টার্মিনালের প্রবেশমুখে পুলিশ ও র‌্যাবের কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের তথ্য অনুযায়ী ২৪ মার্চ ২০২৫ থেকে ৪ এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত ঈদের আগে ও পরে ২১৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩৯ জন নিহত হয়েছে এবং ৫১৬ জন আহত হয়েছে। ২০২৪ সালে ঈদের আগে ও পরে ৩৯৯টি দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৯৮ জন আহত হয়েছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গাড়ির বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, সড়কের নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, চালক, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা এবং চালকের অদক্ষতা ও ট্রাফিক আইন-সংক্রান্ত অজ্ঞতার কারণে সড়কে দুর্ঘটনাগুলো হয়।

এ ছাড়া পরিবহনের চালক ও মালিকের বেপরোয়া মনোভাব, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন বা হেডফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের কারণেও সড়কে দুর্ঘটনা হচ্ছে।

তিনি বলেন, দেশব্যাপী নিরাপদ, আধুনিক ও স্মার্ট গণপরিবহনব্যবস্থার পরিবর্তে টুকটুকি-ইজিবাইক-ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশানির্ভর গণপরিবহনব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়ার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেই চলেছে।

দুর্ঘটনা রোধে যানজট নিরসনে মনিটরিং জোরদার করা, রাস্তার ওপর হাট-বাজার না বসানো, ফুটপাত দখলমুক্ত রাখা, ট্রাফিক আইন জোরদার করা, সড়কে আলোকসজ্জা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব।

সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক জানান, এখনো ঈদযাত্রা শেষ হয়নি এবং অনেক তথ্য আসেনি। ফলে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা প্রাথমিক পরিসংখ্যান থেকে বেড়ে যেতে পারে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সেক্রেটারি মো. সাইফুল আলম মনে করেন, দুর্ঘটনার মূল কারণ অদক্ষ চালকের হাতে গাড়ি দেওয়া হয়, বিশেষ করে ঈদের সময় এমনটা বেশি হয়।

সাইফুল আলম বলেন, ‘সচরাচর মহাসড়কে যে গাড়িগুলো দেখি আমরা, সারা বছর যারা চলে, তারা ওই রুটে এক্সপার্ট। প্রতি বছর ঈদের সময় দুর্ঘটনা হয়, তাই আমরা এবার ঈদে সিটি সার্ভিসের বাসগুলো যাত্রী নিয়ে কোথাও যেতে দেইনি। পাহারা বসাইছিলাম টার্মিনালে। কিন্তু ফেরার পথে অনেক লোকাল বাস রিজার্ভ যাত্রী নিয়ে রওনা দেয়।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান দুর্ঘটনার কিছু কারণ চিহ্নিত করে জানান, দুর্ঘটনা কোনো একক কারণে হয় না। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে অনেক সময় দ্রুতিগতির কথা বলা হলেও বাস্তবতা হলো, দুর্ঘটনায় অনেকগুলো বিষয় নিহিত থাকে।

এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সড়কের গঠনে ত্রুটি থাকতে পারে, চালক অদক্ষ ও ক্লান্ত হতে পারেন, যানবাহনের ফিটনেসে ঝামেলা থাকতে পারে ইত্যাদি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে জানান, সড়ক দুর্ঘটনার নানাবিধ কারণ রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ গাড়িচালকদের বেপরোয়া মনোভাব। 

গাড়িচালকেরা যখন গাড়ির স্টিয়ারিং ধরেন, তখন তারা নিজেদের রাজা ভাবেন। গতির নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকা সত্ত্বেও তারা তা মানতে নারাজ। কেউ কেউ তো আছেন, যারা মদ পান করেই গাড়ি চালান। ফলে জরুরি অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। 

তিনি বলেন, আমাদের একটি কমন বিষয় হচ্ছে যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্ক করা। অনেক মানুষ আছে, যারা গাড়ি কিনে টাকার জন্য ভাড়া দেন। কিন্তু যিনি গাড়িটি নিয়ে যান, তিনি অদক্ষ, মাদকাসক্ত, অপ্রাপ্তবয়স্ক হতে পারেন। সেক্ষেত্রে চালকের মাথায় একটি কথাই ঘুরপাক খায়, প্রথমে মালিকের টাকা পরিশোধ করা, তারপর নিজের জন্য আয়। 

এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই তারা বেপরোয়া হয়ে পড়েন। এভাবেও অনেক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। রাস্তায় গাড়িচালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখা যায়, এ কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে এবং ফলস্বরূপ মৃত্যু। 

আমার মনে হয়, আমাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়ার কারণেও বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। এভাবেই নীরবে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে শত শত মানুষ। এর দায়ভার কাদের? আর কত প্রাণ শেষ হলে আমরা সতর্ক হব? 

অবশ্য এসব বিষয়ে পুলিশ বলছে, আমরা সড়কে আর মৃত্যু দেখতে চাই না। এজন্য সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে সিটবেল্ট বাঁধতে হবে। 

নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য মনোযোগ থাকতে হবে। একটু অমনোযোগী ড্রাইভিংয়ের কারণে ঘটতে পারে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। কারণ, বেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে অদক্ষ চালকের জন্য।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!