দেশের মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে ‘ম্যানুয়াল’ তৈরি করা হয়েছে।
প্রথম পর্যায়ে দেশের ৬৪টি জেলার ৬১০টি স্কুলে এই ম্যানুয়াল অনুসরণ করে জলবায়ু সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়িত হবে। পর্যায়ক্রমিকভাবে দেশের সব মাধ্যমিক স্কুল এই কর্মসূচির আওতায় আসবে।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে স্কুলগুলোর জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস পাবে ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সহনক্ষমতা বাড়বে।
সচেতনতা কার্যক্রমের আওতায় স্কুলগুলোতে ‘গ্রিন স্কুলিং’-এর জন্য গাছ লাগানো, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সচেতনতা বাড়ানো, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ সম্পর্কে ধারণা, পরিবেশ রক্ষায় ইকো ক্লাব গঠন, অগ্নিকাণ্ডের জন্য ইভাকুয়েশন প্ল্যান ও ভূমিকম্পের সময় সুরক্ষার কৌশল শেখানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের আওতাধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) বাস্তবায়নাধীন ‘লার্নিং এক্সিলারেশন ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন (লেইস)’ প্রকল্পের আওতায় স্বতন্ত্র কর্মসূচি হিসেবে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মাউশির এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক।
প্রকল্পে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বা ৩ হাজার ২২৫ কোটি টাকা।
মোট টাকার মধ্যে বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে ৯৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ১ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্প শেষ হবে ২০২৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রকল্পের স্বতন্ত্র কর্মসূচি হিসেবে জলবায়ু সচেতনতা বৃদ্ধির এই কর্মসূচির বাজেট তৈরি চলছে। ম্যানুয়াল অনুমোদনের পর বাজেট বরাদ্দ অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু হবে। ম্যানুয়ালটি বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রথম পর্যায়ে স্কুলগুলোতে সচেতনতা কার্যক্রম শুরুর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন লেইস প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর শিপন কুমার দাস। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, সব প্রক্রিয়া শেষ করে ডিসেম্বর থেকেই প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
স্কুলের অবকাঠামো জলবায়ুসহনশীল করার লক্ষ্যে বিশেষ কোনো কার্যক্রম রয়েছে কি না প্রশ্নে-প্রকল্প পরিচালক বলেন, ম্যানুয়ালটি অনুমোদনের পর সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাছে যাবে।
যেমন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর যদি নতুন কোনো স্কুল স্থাপন করে সেক্ষেত্রে ম্যানুয়াল অনুসরণ করলেই ওই স্কুলের অবকাঠামো জলবাযু সহনশীল হবে।
ম্যানুয়াল বাস্তবায়ন হলে দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের স্কুলগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীর জীবনমান উন্নয়নে সুফল নিয়ে আসবে বলে আশাবাদী প্রকল্প পরিচালক।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা অভিঘাত যেমন- ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ, নদীভাঙন, আগাম বন্যা, বজ্রপাত, লবণাক্ততা, অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত এবং জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগ দেশের মধ্য ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর শিক্ষার্থীদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ুর প্রভাবে দেশের প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থী সরাসরি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে পারে বলে বিশ্বব্যাংকের জলবায়ু এবং উন্নয়ন প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৯ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়মিত বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রতিবছরই উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাসে স্কুলভবন ধসে পড়া, স্যানিটেশনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো সমস্যাগুলো বারবার দেখা দেয়।
বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা নীতিতেও (২০১০) শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস এবং জলবায়ু অভিযোজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে অধিকাংশ স্কুল প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও সম্পদ ঘাটতির কারণে সঠিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে না।
তাই স্কুলগুলোকে জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামোগত টেকসই ব্যবস্থা, কারিকুলামে জলবায়ু শিক্ষা অন্তর্ভুক্তকরণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও শিক্ষার্থীদের জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করে তোলা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট দুর্যোগ থেকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সংকটমুক্ত রাখার লক্ষ্যে লেইস প্রকল্পের আওতায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে জলবায়ু সচেতনতা কর্মসূচি শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এজন্য তৈরি করা হয়েছে ম্যানুয়াল। ম্যানুয়াল তৈরির উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে একটি সমন্বিত ও কার্যকর দিক নির্দেশনা প্রদান।
যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সহজেই পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক কারণ, প্রভাব এবং সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। এ ছাড়া জলবায়ু অভিযোজন শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি।
এই ম্যানুয়ালের প্রত্যক্ষ ব্যবহারকারী হবেন সংশ্লিষ্ট স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি ও শিক্ষক-কর্মচারী। পরোক্ষ ব্যবহারকারী হবেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকাবাসী। এ ছাড়া ম্যানুয়াল বাস্তবায়নে প্রশাসনিক অংশীজন হিসেবে তদারককারী প্রতিষ্ঠান মাউশি।
মাউশির তত্ত্বাবধানে মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করবেন শিক্ষা কর্মকর্তারা। এ ছাড়া অন্যান্য অংশীজনের মধ্যে রয়েছে, স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও), রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলী এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থা।
অঞ্চল নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ অনুসারে ঝুঁকিপ্রবণ ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত ৬৪ জেলার ৬১০ স্কুলে প্রথম পর্যায়ে সচেতনতা কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ ঝুঁকিপ্রবণ ‘হটস্পট’ ৬টি অঞ্চল হলো- ১. উপকূলীয় অঞ্চল ২. বরেন্দ্র এবং খরাপ্রবণ অঞ্চল ৩. হাওর এবং আকস্মিক প্লাবনপ্রবণ অঞ্চল ৪. পাহাড়ি এবং চট্টগ্রাম অঞ্চল ৫. নদী অঞ্চল এবং মোহনা এবং ৬. নগরাঞ্চল।
উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯টি জেলার মধ্যে রয়েছে- বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, গোপালগঞ্জ, যশোর. ঝালকাঠী, খুলনা, লক্ষ্মীপুর, নড়াইল, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা ও শরীয়তপুর। এসব জেলার প্রতিটিতে ১০টি করে মোট ১৯০টি স্কুল রয়েছে।
বরেন্দ্র এবং খরাপ্রবণ অঞ্চলের ১৮টি জেলার মধ্যে রয়েছেÑ বগুড়া, চুয়াডাঙ্গ চুয়াডাঙ্গা, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, নওগাঁ, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নীলফামারী, পাবনা, পঞ্চগড়, রাজশাহী, রংপুর, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁও। এসব জেলার প্রতিটিতে ৮টি করে ১৪৪টি স্কুল রয়েছে।
হাওর এবং আকস্মিক প্লাবনপ্রবণ অঞ্চলের ৭টি জেলার মধ্যে রয়েছে- ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ।
এসব জেলার প্রতিটিতে ৭টি করে মোট ৪৯টি স্কুল রয়েছে।
পাহাড়ি এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৩টি জেলার মধ্যে রয়েছে- বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি। এই অঞ্চলের ৩টি জেলার প্রতিটিতে ৬টি করে রয়েছে মোট ১৮টি স্কুল।
নদী অঞ্চল এবং মোহনা অঞ্চলের ২৯টি জেলার মধ্যে রয়েছে- বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বগুড়া, চাঁদপুর, কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, জামালপুর ও খুলনা।
এসব জেলার প্রতিটিতে ৬টি করে রয়েছে মোট ১৭৪ স্কুল এবং নগরাঞ্চলের বরিশাল, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা, রংপুর ও সিলেট জেলার মধ্যে প্রতিটিতে ৫টি করে রয়েছে ৩৫টি স্কুল।
এসব অঞ্চলের স্কুলগুলো বর্তমানে বন্যা, লবণাক্ততা, নদী ও উপকূলীয় ভাঙন, মিষ্টি পানির সংকট, পানি প্রবাহ হ্রাস, পানি দূষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব, ভূমি দখল ও নগরায়ণের সমস্যায় জর্জরিত।
তবে এসব জেলার কোন স্কুলগুলো নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে সচেতনতা কার্যক্রম শুরু হবে তা নির্ধারণের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ নির্বাচনের মানদণ্ড নির্ধারণ করে জেলা/উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার তথ্যের ভিত্তিতে বিদ্যালয় নির্বাচন করবে।
পরবর্তীতে স্কুলগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব ও সহনক্ষমতার কার্যকারিতা পরিমাপের লক্ষ্যে পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবে মাউশির পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন উইং।
মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন এবং পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন উইংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সরবরাহে দায়িত্ব পালন করবেন মাউশির আঞ্চলিক উপপরিচালকের কার্যালয়, জেলা শিক্ষা অফিস, উপজেলা শিক্ষা অফিস। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান ও স্কুল পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে সমন্বয় করে কর্মকর্তারা পুরো বিষয়টি সমন্বয় করবেন।
আপনার মতামত লিখুন :