অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর রাজধানীসহ সারাদেশে নানা ইস্যুতে এখন পর্যন্ত ছোট-বড় অন্তত দুই শতাধিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে অবস্থান-অবরোধ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর ঘিরে হয়েছে একের পর এক আন্দোলন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি।
পেশাজীবীর ব্যানারে যৌক্তিক ও অযৌক্তিক এসব আন্দোলন সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
আগ্রহ না থাকলেও আন্দোলনের মুখে অনেক দাবি মেনে নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এভাবে গত আট মাসে দুই শতাধিক আন্দোলন মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে চলছে সরকার।
যদিও এতে অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি দাবি মেনে নেওয়া আগামীর জন্য ‘কাল’ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
তাদের মতে, এসব দাবির নেপথ্যে বিগত ক্ষমতাচ্যুত সরকার কিংবা তাদের লোকজন কলকাঠি নেড়েছেন। সরকারকে উৎখাত করতে ও বেকায়দায় ফেলার চেষ্টায় বিরোধী শক্তি ইন্ধন দিয়ে অনেক অযৌক্তিক আন্দোলন-কর্মসূচি পরিচালনার পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত করে যাচ্ছে।
বিগত সময়ে কিছু দাবি যেমন যৌক্তিক ছিল, তেমনই অনেক দাবি ছিল পুরোপুরি অযৌক্তিত। সরকারকে চাপে ফেলে অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যাতে সরকারের দুর্বলতাও প্রকাশ পায়।
পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটিতে অবরোধ-আন্দোলন কর্মসূচি সাময়িক বন্ধ ছিল। ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলন পরবর্তী গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের শোচনীয় পতন হয়। এর কিছুদিন পরই ২৫ আগস্ট সচিবালয়ে আনসার বিদ্রোহ সবার নজর কাড়ে।
পরবর্তীতে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের প্রবল আন্দোলনে প্রায় নতজানু হয়ে পড়ে নবগঠিত সরকার। ‘অনৈতিকভাবে চাওয়া’ সেই ঘটনায় ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার অব্যাহতি চান।
শিক্ষক, চিকিৎসক, রিকশা শ্রমিক, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ‘বিশ্ববিদ্যালয় দাবি’ আন্দোলনে প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা।
‘অহিংস গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে উৎখাতের পাঁয়তারা করে গত বছরের ২৫ নভেম্বর তিন শতাধিক মাইক্রোবাস-বাস ভর্তি হয়ে লোক জড়ো হয় শাহবাগ-ঢাবি এলাকায়।
এখনো চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে চাকরিচ্যুত বিডিআরের সদস্যদের আন্দোলন চলমান। সর্বশেষ, জট নিরসনে ৪৪ থেকে ৪৭ পর্যন্ত চার বিসিএসের রোডম্যাপ দাবি করেছেন প্রার্থীরা। ‘রোডম্যাপ’ না দিলে ফের আন্দোলনে নামার হুমকি দিয়েছেন তারা।
ছাত্র-জনতার ‘বিপ্লবে’ গত বছর ৫ আগস্ট বিদায় নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। ওইদিনই ভারতে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই শুরু হয় লাগাতার আন্দোলন।
যাতে বিভিন্ন সময় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বর্তমান সরকার। এসব আন্দোলনের মধ্যে ৮০ শতাংশই হয়েছে বিভিন্ন পেশাজীবীর ব্যানারে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আন্দোলন আছে ৩০ ভাগ। এ ছাড়া শ্রমিক আন্দোলন আট ভাগ এবং অন্যান্য ব্যানারের আন্দোলন ১০ ভাগ। এর মধ্যেই বন্ধ হয়েছে ৯০ ভাগ আন্দোলন। ১০ ভাগ আন্দোলন এখনো চলমান।
৫ আগস্টের পর থেকে গত ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ২০০টি (কর্মসূচি) আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
এ ছাড়া খুন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সব শিক্ষার্থীর আবাসন নিশ্চিতসহ চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোসহ বেশকিছু দাবিতে আরও কয়েকটি আন্দোলন লক্ষ্য করা যায়। আন্দোলনসংশ্লিষ্ট অনেক বাহারি নামের সংগঠনের তৎপরতার বিষয়েও তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, গত আট মাসে আন্দোলনের হটস্পট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে জাতীয় প্রেসক্লাব, বাংলাদেশ সচিবালয়, রেলভবন ও কমলাপুর রেলস্টেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ মোড় এবং জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণ। সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হয়েছে জাতীয় প্রেসক্লাবে।
বেসরকারি শিক্ষকসহ একাধিক সংগঠন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে এখনো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায়। সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলনের প্রধান স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে সচিবালয়।
রেলওয়ে কর্মচারীদের আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হলো- রেলভবন ও কমালপুর রেলওয়ে স্টেশন। আর শিক্ষার্থীদর আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ মোড় ও জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণ।
এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গত আট মাসে যেসব দাবিতে আন্দোলন হয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ হলো- চাকরিচ্যুত ও পুনর্বহালের আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচার, শহিদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহতদের উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত, সরকারি চাকরিজীবীদের বিভিন্ন দাবি, শ্রমিক স্বার্থ, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আন্দোলন, সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর আন্দোলন এবং পরিবহন ও যানবাহনসংশ্লিষ্ট।
এসব আন্দোলনের মধ্যে অন্যতম আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলনের মাধ্যমে সচিবালয়ে প্রবেশ করে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অবরুদ্ধ করে রাখে।
সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে গেলে তাদের ওপর হামলা করেন বাহিনীর সদস্যরা। এতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আনসার সদস্যদের সংঘর্ষ বাধে।
এ ঘটনায় ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ছাড়াও শিক্ষার্থী-সাংবাদিকসহ অন্তত ৩৫ জন আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত হলে তাদের ওপরেও হামলা করেন আনসার সদস্যরা। এতে ৬ সেনাসদস্য আহত হন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আনসার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তির নাম কাদের। তিনি মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার ষাটঘর তেওতা (বিলপাড়া) এলাকার ফজলুল হকের ছেলে এবং তেওতা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক।
সূত্র মতে, অন্তর্বর্তী সরকার উৎখাতের জন্য অন্য একটি আলোচিত আন্দোলন ছিল ‘সরকারবিরোধী মহাসমাবেশ’। দেশের পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত নিয়ে আসবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সেই টাকা বিনা সুদে এক লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হবে।
এমন আশ্বাসে গত ২৫ নভেম্বর রাত থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ বাস ও মাইক্রোতে করে ঢাকায় জড়ো হয়। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকারবিরোধী মহাসমাবেশের ডাক দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করা।
রাজধানীর অন্যতম সমালোচিত আন্দোলন ছিল তিতুমীর সরকারি কলেজের আন্দোলন। এ কলেজের শিক্ষার্থী প্রায় অর্ধলাখ হলেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ‘কতিপয়’।
কলেজকে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ করার দাবিতে তারা যা যা করছিলেন, তা নিয়ে রাজধানীবাসীসহ গোটা দেশের মানুষ তাদের ওপর বিরক্ত হয়েছিলেন।
তাদের দাবি নিয়ে ফেসবুকে তারা যা প্রচার করতেন, সেখানে ‘হা হা’ রিঅ্যাক্টের বন্যা বয়েছে। এরপর তাদের এ আন্দোলন হাসি-ঠাট্টা-তামাশা, হালের ভাষায় যাকে বলে ‘ট্রল’ তাতে পরিণত হয়।
তবে, গত ১৭ মার্চ ঢাকার সরকারি সাত কলেজের জন্য নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি (ডিসিইউ)’র ঘোষণা আসে। বলা হয়, নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি চলবে ‘হাইব্রিড মডেলে’। এরপর তিতুমীর কলেজের আন্দোলন থেমে যায়।
নানা দাবিতে একের পর এক আন্দোলনের বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) এনামুল হক সাগর বলেন, যেকোনো সংগঠন তাদের অধিকার আদায়ের জন্য দাবি জানাতেই পারে। তবে কয়েক মাস ধরে যে প্রক্রিয়ায় দাবি জানানো হচ্ছে সেটা যথাযথ নয়।
কিছু হলেই আন্দোলন হচ্ছে। দখল করা হচ্ছে রাজপথ। এতে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে আমি বলব, দাবি আদায়ে রাস্তা নয়, আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান করুন।
সাধারণ মানুষ যাতে কোনো আন্দোলনের কারণে জনদুর্ভোগে না পড়ে সেই বিষয়ে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ শান্ত থাকে।
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকতা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর ভেঙে পড়া পুলিশ বাহিনী ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। পুলিশ শান্তিপূর্ণ কোনো আন্দোলনে বাধা দেয় না। বরং পুলিশকে উদ্দেশ্য করে একটি চক্র হামলা করে।
মাঠপর্যায়ের পুলিশের ওপর হামলার পর পুলিশ সরকারের ঊর্ধ্বতন ও শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের নির্দেশে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে পুলিশ নীরব থাকে। তবে অনেক আন্দোলনকারীরা পুলিশকে মানতে চায় না, সেই ক্ষেত্রে পুলিশ তাদের আন্দোলন নিরসন বা নিয়ন্ত্রণে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের ৮ মাসে নানা ইস্যুতে ২০০ আন্দোলন ঘিরে দেশে বড় অঙ্কের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের আগের ৩৬ দিনে (জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী প্রবল আন্দোলন) দেশে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলে তথ্য প্রকাশিত হয়। তবে, প্রতিষ্ঠান এখনো চলমান আন্দোলনে অর্থনৈতিক ক্ষতির সংখ্যা নির্ধারণ করে তথ্য প্রকাশ করেনি।
গতিপথ ও ধারাবাহিকতা পর্যালোচনায় দেখা যায়, আন্দোলনের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই। গত বছরের ১৩ থেকে ২৫ আগস্টের মধ্যে পালিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি কর্মসূচি। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আন্দোলনের সংখ্যা কিছুটা কমেছে।
একই মাসের ১০ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে আন্দোলন চালিয়েছে সরকারি চাকরিজীবী ও শিক্ষার্থীরা। অক্টোবর মাসে ফের আন্দোলনের চাপ বাড়ে।
মাসব্যাপী আন্দোলন চালায় সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো। নভেম্বর মাসে আন্দোলন কিছুটা হ্রাস পেলেও ৭ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত কিছু বড় কর্মসূচি ছিল।
আপনার মতামত লিখুন :