গত রোববার সকাল ঠিক ৭টা। কান্নাকাটি আর চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে বুঝতে পারলাম আমার বড় ভাইয়ের ঘর থেকে কান্নাকাটির শব্দ আসছে।
গিয়ে দেখি আমার ১ বছর ৪ দিন বয়সি ভাতিজার হঠাৎ খিঁচুনিতে অবস্থা গুরুতর। তাড়াতাড়ি মাথায় পানি দিয়ে অটোরিকশায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিতেই কর্তব্যরত চিকিৎসক শিশুর অবস্থা গুরুতর দেখে ভর্তি লেখেন নতুন বিল্ডিংয়ের ৬ তলার ৩১ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে।
তখন সকাল ঠিক ৮টা বাজে। হাসপাতালের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে নিতেই নার্স ভর্তির কাগজ দেখে বললেন, এখানে ডাক্তার নেই। পাশের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে যান। সেখানে নিয়ে যেতেই কর্তব্যরত নার্স একই কথা বললেন, এখানে ডাক্তার নেই, ৩১ নম্বর ওয়ার্ডেই নিয়ে যান।
তারপর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে নিলে কর্তব্যরত নার্স চিকিৎসক নেই বলে ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে পাঠান। তখন ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কর্তব্যরত চিকিৎসকের কক্ষের দরজা খোলা ছিল।
একজন পুরুষ চিকিৎসকের উপস্থিতি আমার চোখে পড়ে। আবার শিশুকে নিয়ে ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে গেলে আবারও নার্স ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে যেতে বলেন। সেখানে আসতেই আরও একজন নারী চিকিৎসকের উপস্থিতি চোখে পড়ে।
তখন নার্সের কাছে না নিয়ে ওই নারী চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে শিশুর অবস্থা দেখে তিনি তাড়াতাড়ি নার্সকে এন্ট্রি করার নির্দেশ দেন। পরে এন্ট্রি করে শিশুর ওজন মেপে আবার ওই নারী চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাই। ওই চিকিৎসক প্রয়োজনীয় ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ইনজেকশন লিখে দেন।
গত রোববার ঠিক এমন ঘটনাই ঘটে ময়মনসিংহ নগরীর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের চর ঈশ্বরদিয়া গ্রামের খালপাড় এলাকার মো. মোসলেম উদ্দিনের ছেলে মোফাখ্খারুল ইসলাম ও তার এক বছর বয়সি ছেলে সালমানের সঙ্গে। মোফাখ্খারুল ইসলাম ময়মনসিংহ জেলা জজকোর্টের আইনজীবী।
শুধু এখানেই শেষ নয়, এরপর শুরু হয় নার্স, ওয়ার্ডবয় ও আয়ার বঞ্চনার শিকার। বঞ্চনার কারণ, শিশু সালমানের সঙ্গে যারা গিয়েছিলেন, সবাই লুঙ্গি, টিশার্ট ও শার্ট পরে গিয়েছিলেন। যে কারণে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন তারা এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রেও হয়েছে অবহেলা।
সকাল ৮টায় কর্তব্যরত চিকিৎসক ইনজেকশন লিখে দেওয়ার পর নার্সের কাছে নিয়ে গেলে ক্যানোলা করে ইনজেকশন দেবেন বলে একটা চেয়ারে বসতে বলেন। চেয়ারে বসার পর নার্স এসে শিশুর হাতে ও পায়ে ক্যানোলা করার ইনজেকশন পুশ করেন।
কিন্তু রগ না পাওয়ায় কয়েকবার ইনজেকশন পুশ করেন। এভাবে ১০ মিনিট চেষ্টার পর ওই নার্স ব্যর্থ হয়ে চলে যান এবং এই চেয়ারেই বসে থাকতে বলেন।
৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পরে আরও একজন নার্স এসে তিনিও একই কায়দায় দুবার চেষ্টা করেও সফল হননি। তিনিও ফিরে যান। পরে ১০টার দিকে আরও একজন নার্স ও ওয়ার্ডবয় একসঙ্গে বসে একবার চেষ্টা করতেই শিশুর রগ পেয়ে যান এবং ইনজেকশন দেন।
পরে শুরু হয় ব্যাডশিট জোগাড়ের জন্য তাড়াহুড়া। যার কাছেই যাই, তিনিই বলেন, কোনোটাই নেই। এমতাবস্থায় কর্তব্যরত নার্সকে জিজ্ঞাসা করি, হাসপাতালে ব্যাডশিট আছে কি না। না থাকলে আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানাব।
পরে দৌড়ে গিয়ে একজন একটি ব্যাডশিট দেন। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো হাসপাতালে করানো হয়। এমতাবস্থায় দুপুর পর্যন্ত হাসপাতালের নার্স, ওয়ার্ডবয়, গার্ডের অবহেলা ও বঞ্চনার কারণে হাসপাতাল থেকে শিশুকে নিয়ে বের হয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে চলে যাই।
সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর আবারও নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোনো সমস্যা নেই বলে জানালে রাত ১০টার দিকে শিশুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি।
এই প্রতিবেদক মারধরের শিকার হয়ে গত ২০ মার্চ হাসপাতালে ভর্তি হন। তখন তিনি হাসপাতালে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে বেশ কিছু অনিয়ম দেখতে পান। এসব অনিয়মের মধ্যে রয়েছে হাসপাতালের চতুর্থ তলায় রোগীর সঙ্গে কুকুরের অবাধ বিচরণ।
এসব কুকুরকে অবাধে চলাফেরা করতে দেখে মনে হলো রোববার লুঙ্গি পরে শিশুকে নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনদের চাইতে হাসপাতালে অবাধে চলাফেরা করা কুকুরের মূল্যায়ন বেশি হয়।
কারণ হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের তাড়াতে লাঠিওয়ালা সিকিউরিটি গার্ড আছে। কিন্তু কুকুরগুলো তাড়ানোর মতো কাউকে চোখে পড়েনি। এই কুকুরগুলো সন্ধ্যার দিকে হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের সামনে জড়ো হয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে হাসপাতালে তোলপাড় সৃষ্টি করে, তবে কাউকে তাড়াতে দেখা যায়নি।
এদিকে নিয়মবহির্ভূতভাবে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে রোগীদের হয়রানি করেন বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির লোকজন। তারা চিকিৎসকের মতো করে তাদের ভর্তির কাগজ ও প্রেসক্রিপশন দেখেন।
বিষয়টি নজরে আসার পর আমারও প্রথমে মনে হয়েছিল এরা ডাক্তার হবেন। পরে তাদের পিছু নিয়ে বুঝতে পারি তারা ডাক্তার নন, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। পরে তারা সংবাদকর্মী পরিচয় পেয়ে অনেক অনুনয়-বিনয় করে বলেন, যেন তাদের পরিচয় প্রকাশ না করি।
এদিকে গত সোমবার সকালে খবর আসে হাসপাতালে অভিভাবকহীন দুটি নবজাতককে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, মোট তিন নবজাতককে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়াশরুম থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ওই তিন নবজাতকের একজন মারা গেছে। অপর দুই নবজাতক হাসপাতালের ২৫ নম্বর নবজাতক ওয়ার্ডের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (এনআইসিইউ) রয়েছে।
চিকিৎসক ও নার্সরা তাদের সেবা দিচ্ছেন। ওই তিন নবজাতক ঈদুল ফিতরের আগেও সুস্থ ছিল। কিন্তু ঈদের পর একজনের মৃত্যু হয়। বেঁচে থাকা দুই নবজাতক একই ওয়ার্ডের এনআইসিইউতে রয়েছে। তাদের মধ্যে একটি মেয়ে, আরেকটি ছেলে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ইনচার্জ শফিকুল ইসলাম বলেন, ওই তিন নবজাতক কোথা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে তিন নবজাতকের মধ্যে একটি মারা গেছে।
অপর দুটি হাসপাতালের ২৫ নম্বর নবজাতক ওয়ার্ডের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন। দেড় মাস আগে হাসপাতালের আউটডোরের ওয়াশরুমে একটি মৃত নবজাতক পাওয়া গিয়েছিল বলে আমার জানা আছে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন বলেন, হাসপাতালে ব্যাডশিটের কমতি নেই।
কিন্তু রোগীদের জায়গা দিতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। ৩০ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসক না থাকার কথা নয়। সব সময়ই চিকিৎসক থাকেন। আপনার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তা খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে চিকিৎসকের শিফট পরিবর্তন হওয়ার কারণে এমনটি হয়ে থাকতে পারে।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে অবাধে কুকুর চলাফেরার কিছু ছবি গতকাল আমার কাছে এসেছে। আমি বিষয়টি নিয়ে হাসপাতাল পরিচালক ও সিটি করপোরেশনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাছাড়া হাসপাতাল থেকে কুকুর তাড়ানোর জন্য আলাদা একজন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তিন নবজাতকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুনেছি তিনটি নবজাতক উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মারা গেছে।
অপর দুজন হাসপাতালের ২৫ নম্বর নবজাতক ওয়ার্ডের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসা শেষে তাদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে নবজাতক কোথা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, তা আমার জানা নেই।