২০২৩ ও ২০২৪ সালের প্রায় পুরোটা বছর দৌরাত্ম্য ছিল এডিসবাহিত ডেঙ্গু মশার। ২০২৩ সালের শেষের দিকে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও ২০২৪ এর শুরু থেকে আবারও বাড়তে থাকে আক্রান্তের সংখ্যা। একই ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে চলতি বছরও।
গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছুঁয়েছে ২ হাজারের ঘর। মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। মৌসুম শুরুর আগেই আক্রান্ত ও মৃত্যুর এমন সংখ্যা আতংক জাগাচ্ছে সাধারণ মানুষের মনে। তবে এবার ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি।
কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার বাইরের অঞ্চলগুলোতে এডিস মশার ঘনত্ব বেশি। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে মশা নিধন কর্মসূচিতেও।
দেশের কোনো সিটি করপোরেশনেই মেয়র বা কাউন্সিলর না থাকায় মশা মারতে মানা হচ্ছে না কোনো ‘চেইন অব কমান্ড’। ফলে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে এবার সংক্রমণের সংখ্যা পূর্বের সব রেকর্ড ছাড়াতে পারে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৮ এপ্রিল ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৯৯৭ জন। যেই সংখ্যা গত বছরের এ সময়ে ছিল ১ হাজার ৫৬৬ জন। এ সময়ের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর অন্যতম কারণ এডিস মশার বিস্তার।
এখনই মশা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে এ বছর পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গত বছর পুরোটা সময় ডেঙ্গুর যে ধরন আমরা দেখেছি তাতে চলতি বছর আক্রান্তরা আরও বেশি শকে যাবে।
ডেঙ্গু রোগী ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইনে কোনো সমস্যা নেই। এ বছর অবস্থা আরও খারাপ হবে কারণ আমাদের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, টারশিয়ারি লেভেলে সংক্রমণ হচ্ছে। আমরা আমাদের মতো রোগীর সেবা দিতে সব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।
কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভরা মৌসুমে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনই ভাবাচ্ছে আমাদের।
মৌসুমের শুরুতেই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা: ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয় মূলত বর্ষাকালে। আগস্ট থেকে বাড়তে থাকে এর ভয়াবহতা। কিন্তু চলতি বছর এপ্রিলের শুরুতেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে এডিস মশারা তাদের প্রজননে উপযুক্ত আবহাওয়া পেয়ে যাচ্ছে।
এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে এপ্রিল-মে’তে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়ার আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এর অন্যতম কারণ হিসেবে ডেঙ্গুর প্রজননস্থল ধ্বংসে ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন তারা।
একই সঙ্গে আবহাওয়ার তারতম্যও সমানভাবে দায়ী উল্লেখ করে তারা বলছেন, এখনি এডিসের জীবাণুবাহী মশার প্রজননস্থল ধ্বংস না করতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
দায়ী উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া: কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক, অধ্যাপক প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া থাকার কারণে বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য উত্তম জায়গা।
উপযুক্ত তাপমাত্রা, আর্দ্রতার সঙ্গে যোগ হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গুর চোখ-রাঙানি আরও আতঙ্কিত করে তুলেছে নগরবাসীকে।
এমন পরিস্থিতিতে আর নির্দিষ্ট সময় না বরং সারা বছর এডিস মশা নিধনে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থা এবং স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা এডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হলে অবশ্যই ভালো ফল আসবে। তবে তাদের এই কার্যক্রম নিয়মিতভাবে মনিটরিং করতে হবে।
প্রতিরোধে নেই কার্যকর ব্যবস্থা: গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকারের অধীনে দেশের সব সিটি করপোরেশন, জেলা-উপজেলায় কোনো জনপ্রতিনিধি নেই।
ফলে মশা নিধনে নিয়োজিত কর্মীদের তৎপরতা যতটা থাকার কথা ততটা নেই। অনেক জায়গায় হাজিরা খাতায় কর্মীদের উপস্থিতি থাকলেও মাঠ পর্যায়ে নেই। এতে করে মশারা বংশ বিস্তারে উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মশা নিধনে এখন পর্যন্ত কি কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আপনারা জানেন দেশে একটা রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে না। এর ফলে ঢাকার দুই সিটিসহ দেশের কোনো সিটি করপোরেশনেই মেয়র নেই। প্রশাসকরা যদিও তাদের কাজ চালাচ্ছেন কিন্তু তা ততটা কার্যকর হচ্ছে না।
কিন্তু একটা পূর্ণাঙ্গ ‘চেইন অব কমান্ড’ না থাকলে যা হয় তাই ঘটেছে। কর্মীরা কেউ কথা শুনছে না। রাজধানীতে কয়েকটি জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে মশার ওষুধ ছিটালেও অন্যান্য জায়গায় তেমন কার্যক্রম নেই।
আক্রান্ত বাড়ার কারণ খুঁজে বের করা তাগিদ: সবাই মিলে কাজ করলেও রোগী বাড়ছে, মৃত্যুও বাড়ছে। এর কারণ খুঁজে বের করা জরুরি উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রতিবছরই এডিস মশা নিধনে কাজ করা হয়।
কিন্তু তাও বছর শেষে একটা বড় সংখ্যার মানুষের করুণ মৃত্যু হয় ডেঙ্গুর সংক্রমণে। চলতি বছরের শুরুতেই রোগ বাড়ছে, রোগী মারা যাচ্ছে। কোথাও তো ঝামেলা আছে। সেই বিষয়টি নিয়ে গবেষণার ওপর গুরুত্ব দেওয়া খুব জরুরি।
এডিস মশা নিয়ে গবেষণার জায়গায় একটা দুর্বলতা হচ্ছে, আমাদের দেশে মেডিকেল এন্টোমলজিস্ট আসলেই নেই। যারা কাজ করেন তারা হয় প্রাণিবিদ্যা অথবা কৃষি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন।
স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি: তবে ডেঙ্গু রোধে স্বাস্থ্য বিভাগের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে বলে দাবি করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ডেঙ্গু মোকাবিলায় বিভিন্ন হাসপাতালের পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি আমরা। যেখানে হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখার কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া ডাক্তার ও নার্সদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডেঙ্গু একার চেষ্টায় কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনগণকে সচেতন করার জন্য আমরা বিভিন্ন মহলকে যুক্ত করেছি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক আছেন, ছাত্রছাত্রী আছেন, তাদের মাধ্যমে এটা প্রচার করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও যুক্ত করা হয়েছে, যারা জনগণকে সতর্ক করতে পারেন, কীভাবে ডেঙ্গুরোগ থেকে বাঁচা যায়, মশার কামড় থেকে বাঁচা যায় এবং ডেঙ্গু হলে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা নেওয়া যায়।
এ বিষয়ে প্রচারের জন্য পোস্টার, ব্যানার এবং টিভিতে বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :