ঢাকা শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫

আওয়ামী লীগে সর্বনাশ জাতীয় পার্টির!

এফ এ শাহেদ
প্রকাশিত: এপ্রিল ১০, ২০২৫, ১২:৩৫ এএম

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শুধু শেখ হাসিনা সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের কপাল পোড়ার পাশাপাশি কপাল পুড়েছে তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র জাতীয় পার্টিরও। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই রাজনীতির মাঠে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক দলটি। 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো সভা-সংলাপে ডাকা হচ্ছে না তাদের। মাঠের কর্মসূচি দিলেও পণ্ড করে দিচ্ছে ছাত্র-জনতা। হামলা-মামলার শিকার হচ্ছে জাতীয় পার্টির শীর্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ের নেতারাও। দলটির নিষিদ্ধের দাবিও তুলছেন অনেকে। 

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটি অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না তাও নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। সব মিলিয়ে দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত অন্তত দুই দশকে আওয়ামী লীগের অতিমাত্রায় লেজুরবৃত্তি ও পতিত সরকারের সঙ্গে নিজেদের একাকার করে ফেলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টি নিজেকে নিঃশেষ করেছে। 

এখন নিজেদের রাজনীতি বলতে তাদের কিছু নেই। বছরের পর বছর স্বৈরাচার হয়ে ওঠা আওয়ামী লীগের সংসদে বন্দনামুখর হয়ে তথাকথিত বিরোধী দলের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে জাতীয় পার্টি। যে কারণে, গৃহপালিত বিরোধীদলের তকমা স্থায়ীভাবে জুড়েছে দলটির কপালে। ফলে আগামী দিনে দলটির ঘুরে দাঁড়ানো দুঃসহ হবে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সঙ্গত কারণেই ৫ আগস্টের পর জনতার তীব্র গণরোষে পড়েছে জাতীয় পার্টি। সেইসাথে, দেশের রাজনীতিতে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে দলটি। 

জাতীয় পার্টিকে ডাকা হয় না অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দলের সংলাপেও। প্রথমে ভোল পাল্টে দলটি সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিংবা বিএনপির সহানুভূতি নেওয়ার চেষ্টা করলেও এতে ব্যর্থ হয়েছে। 

এরপর নানা কর্মসূচি দিলেও ছাত্র-জনতার তোপের মুখে কোনো কর্মসূচিই সফল করতে পারেনি। দলটির বনানী অফিসের ভেতরে সংক্ষিপ্ত সভা-সমাবেশ আর প্রেস রিলিজেই চলছে রাজনৈতিক কার্যক্রম। ঢাকার বাইরে সারা দেশ এমনকি জাতীয় পার্টির দূর্গ হিসেবে খ্যাত রংপুরেও একই অবস্থা। 

রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভবিষ্যতে দলটি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠা কষ্টকর। কারণ গেল তিন দশকের ভুল রাজনীতি তাদের নিঃশেষ করে দিয়েছে। 

আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে দলটির প্রেসিডেন্ট জি এম কাদের তার আসনে জয়লাভ করতে পারবে কি না তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। রংপুরে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগসহ সবার ভোট বাড়লেও, কমেছে জাপার। 

সবদলের অংশগ্রহণে জোটমুক্ত একক ভোট হলে জাপা রংপুরের সব আসনেই হেরে যেতে পারে। এরশাদের জীবদ্দশায় একাই রংপুরের ৫ আসনে জিতে দলটার মান বাঁচাতেন তিনি। কিন্তু বাস্তবতা এখন পুরোটাই ভিন্ন।

এদিকে, জাপার তৃণমূলের প্রায় সব নেতা নানা সময় আপত্তি করলেও আওয়ামী লীগের গৃহপালিত হয়ে জাপা এমপিরা নির্বাচনে গেছেন বিগত সময়গুলোতে। ভোটহীন ক্ষমতার মজাটা তারা ধরে রাখতে চেয়েছেন। 

কিন্তু বিএনপি, ইসলামী আন্দোলন, জামায়াত, গণতন্ত্র মঞ্চ, ইসলামী ঐক্য জোটের একাংশ নির্বাচনে না যাওয়ায়, নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানোর দায়ে শেখ হাসিনাকে বিকল্প প্রার্থী ও ডামি প্রার্থীর কৌশলে যেতে হয়েছে। এতে জাপা এমপিরা বুঝতে পারছেন তারা স্বতন্ত্র কিংবা ডামি প্রার্থীর কাছে হেরে যাবেন। এটাই সঠিক ক্যালকুলেশন। 

যে কারণে সমালোচনার মুখে জাতীয় পার্টি: ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় পার্টি। ওই বছরের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। 

দলটির ভোটের হার ছিল ৬৬.৩১ শতাংশ। বিএনপি ওই নির্বাচন বর্জন করলেও অংশ নেয় আওয়ামী লীগসহ ২৮টি রাজনৈতিক দল। এরপর ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। 

আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করেছিল। ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে পতন ঘটে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের। এরপর থেকে জাতীয় পার্টি দিন দিন জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করে। 

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক তৎপরতা সাধারণ গতিতে চললেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসে ধরা খায় দলটি। আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এ নির্বাচনের আয়োজন করে। 

কিন্তু বিএনপি-জামায়াত, বাম জোটসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করে। নির্বাচনে ৩৪টি আসন নিয়ে বিরোধী দল হয় জাতীয় পার্টি। এরপর একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের হয়ে জাতীয় পার্টি ২৫টি আসনে জয়ী হয়ে সংসদে ফের বিরোধী দল হয়। 

এ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট ভরাডুবির কবলে পড়ে। বিএনপি পায় মাত্র ৭টি আসন। সর্বশেষ ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬টি আসনে সমঝোতা করলেও জাতীয় পার্টি জয়ী হয় মাত্র ১১টিতে। বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করে। 

সর্বশেষ তিন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে দশম ও দ্বাদশ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নেবে না বলে ঘোষণা দিলেও নানা নাটকীয়তার পর অংশগ্রহণ করে। 

আবার জয়লাভের পর মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ নানা সুবিধা নিয়েছে। এমনকি ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের দায়িত্বও পালন করেছে এ দল। 

এই দুই নির্বাচনে দলটি অংশ না নিলে আওয়ামী লীগ সরকার অনেকটাই চাপে পড়ত। নির্বাচনে বৈধতা পেতেও বেশ বেগ পেতে হতো বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। 

তারা বলেন, জাতীয় পার্টি এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার আয়োজিত প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যা বলছেন
রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আওয়ামী লীগ এখনো নানারকম গোলোযোগ করার চেষ্টা করছে। 

আর জাতীয় পার্টি একটা এতিম দলে পরিণত হয়েছে, যার কারণ হচ্ছে তাদের সুবিধাবাদি রাজনীতি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তাদের কিছুটা সন্তোষজনক অবস্থান ছিল, যেখানে তারা ৩৫টি আসন পেয়েছিল। 

কিন্তু পরবর্তীতে তাদের জনপ্রিয়তা এবং ভোটের মাঠে গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকে এবং নির্বাচনেও তারা ’৯১ এর মতো ভালো করতে পারেনি। 

যার ফলে তারা ক্ষমতার রাজনীতিতে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। জাপার কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি নেই। পলিসিগত সংস্কার প্রস্তাবনা নেই। এমনকি জনস্বার্থ ইস্যুতেও তার কোনো স্টেইক নেই। 

জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জাপার জনপ্রিয়তা কমেনি, আর প্রিয়তা নির্ধারণ করবে সরকার নয়, জনগণ। 

জাপার জনপ্রিয়তা আগের চেয়েও বেড়েছে। এমনকি আগামীতে নির্বাচনের বাইরে থাকা দলের ভোটও যাবে লাঙ্গল মার্কায় বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আমাদের অস্তিত্বের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হাত দিয়েছে। 

তারা আমাদের সংগঠন নষ্ট করার চেষ্টা করছে এবং আমাদের রাজনীতি নষ্ট করার চেষ্টা করছে। আমাদের কর্মীদের ওপর মিথ্যা মামলা দিয়ে, ভয় দেখিয়ে তাদের ঘরের ভেতর থাকতে বলা হচ্ছে। আবার একই সঙ্গে আমাদের রাজনীতি নিয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে। 

একইসাথে, রাজনৈতিক বৈঠকগুলোতে সরকার আমাদের রাখার প্রয়োজন মনে করছে এটি তাদের বিষয়; তবে জনগণ তাদের মত প্রকাশ করবে ভোটের মাধ্যমে। সরকার থেকে জনগণ কি বলছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে। 

তিনি  বলেন, সবাই জানে আমরা আগে কোন পরিস্থিতিতে ছিলাম। আমরা কোন প্রেক্ষাপটে কখন কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি। এবারও সঠিক নির্বাচন হলে প্রচুর মানুষ আছে যারা আমাদের ভোট দেবে। যদি বর্তমান সরকার সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারে তবে সব আসনে প্রার্থী দিবে জাপা। 

যারা অন্য কোনো দলকে ভোট দেবে না তাদের জন্য বিকল্প হিসেবে হয়তো আমরাই দাঁড়িয়ে যাব। আগামী দিনে জাতীয় পার্টি নিয়ামক শক্তির রাজনীতি করবে না ক্ষমতার জন্যই রাজনীতি করবে।  

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, জাতীয় পার্টি এখন দেশের ৩য় বা ৪র্থ দল নয়। আওয়ামী লীগ আমলের গত ১৫ বছরের স্থানীয় ও উপনির্বাচনগুলোতে তারা ইসলামী আন্দোলনের চেয়েও কম ভোট পেয়েছে। 

শুধু কম না, অধিকাংশ এলাকায় অনেক কম পেয়েছে এবং জাপা প্রার্থীরা জামানত হারানোর পর্যায়ে চলে গেছে। 

বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনের পরে তারা এখন দেশের সর্বোচ্চ ৫ম দল হতে পারে। গণঅধিকার মঞ্চসহ বেশকিছু নতুন দল এসেছে বলে জাতীয় ভোটে তাদের প্রকৃত পজিশন এর চেয়েও পেছনে হতে পারে।