গত বছরের জুলাইতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাঝেই স্টার্টআপ সামিট আয়োজন করতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশ স্টার্টআপ কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সামি আহমেদ।
স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের হাত থেকে দেশ পুনরুদ্ধারে ছাত্র-জনতার রক্তে যখন রাজপথ রঞ্জিত, সেই রক্ত মাড়িয়েই বিদেশি বিনিয়োগের নামে স্টার্টআপ সামিট আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সামি।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ‘ইমেজ’ রক্ষার্থে সে সময়ের ২৭ জুলাই সামিট আয়োজনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সামি আহমেদের।
শুধু তাই নয়, পলকের নির্দেশনায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব পালনকালে স্টার্টআপে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বিবেচনায় নিতেন তিনি।
বিএসসিএলের গাইডলাইন ভঙ্গ করে প্রকাশ্যেই স্টার্টআপে বিনিয়োগের উদ্যোগ ছিল সামি আহমেদের। এমন প্রেক্ষাপটে অবশেষে বিএসসিএলের এমডি পদ হারাচ্ছেন তিনি।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটির এমডি হিসেবে নিয়োগ পান সামি আহমেদ। ফ্যাসিবাদি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার সাবেক আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সাথে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে এর আগেও আকর্ষণীয় পদে ছিলেন তিনি।
২০১২ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে থাকা এটুআইর টেকনোলজি এক্সপার্ট হিসেবে নিয়োগ পান সামি। ২০১৪ সালে সফটওয়্যার রপ্তানিকারকদের সংগঠন বেসিসের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন।
স্টার্টআপ কোম্পানির এমডি হিসেবে নিয়োগের পূর্বে আইসিটি বিভাগের এলআইসিটি প্রকল্পের আইটি-আইটিইএস পলিসি অ্যাডভাইজর ছিলেন তিনি।
আরও আগে একই প্রকল্পের ‘কম্পোনেট লিডার’ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ফ্যাসিবাদের সাহচর্চে মোটা বেতনের চুক্তিভিত্তিক এসব নিয়োগ বাগিয়েছিলেন সামি আহমেদ।
জুলাইতেই স্টার্টআপ সামিটের উদ্যোগ
জুলাইতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাঝেই ‘স্টার্টআপ সামিট’ আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সামি আহমেদ। পলকের ভাবমূর্তি বাড়ানোই ছিল সামিট আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য।
সূত্র বলছে, আবু সাঈদ শহিদ হওয়ার দিন অর্থাৎ, ১৬ জুলাই বিকেলে স্টার্টআপ সামিট আয়োজনে জরুরি এক বৈঠক আহ্বান করে সামিট। তথ্যপ্রযুক্তি এবং স্টার্টআপ খাতের শীর্ষ পর্যায়ের উদ্যোক্তারা সেই বৈঠকে আমন্ত্রণ পান।
‘পাঠাও’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফাহিম আহমেদ সেই বৈঠকের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, বৈঠকটি আয়োজনের উদ্দেশ্যই ছিল ২৭ জুলাই স্টার্টআপ সামিট আয়োজন করা। আমি তাকে (সামি) বললাম যে, দেশের এ অবস্থায় এমন আয়োজন করা ঠিক হবে না।
এ ধরনের আয়োজন তো দেশের তরুণদের জন্য। তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় আন্দোলন করছে। সেদিনই আবু সাঈদ শহিদ হলেন। এটাও তাকে বললাম। সামি বললেন যে, এগুলো (আন্দোলন) কোনো বিষয় না। এগুলো থেমে যাবে। প্রয়োজনে পুলিশ আর গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য নিয়ে সামিট করবেন বলে জানান।
৫ আগস্টের পর এ বিষয়টি সামিকে মনে করিয়ে দিয়ে স্টার্টআপ কোম্পানি থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান করেছিলেন ফাহিম আহমেদ। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে আয়োজিত এক সভায় এ বিষয়ে ফাহিম আহমেদ এবং সামি আহমেদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় বলে জানান ওই সভায় উপস্থিত একটি সূত্র।
এ বিষয়ে ফাহিম আহমেদ বলেন, আন্দোলনে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে সামি আহমেদকে পদত্যাগ করতে বলেছিলাম। তার নৈতিক যোগ্যতা নেই ওই পদে থাকার। তিনি ছিলেন ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিভিন্ন সুবিধা পাইয়ে দেওয়া ব্যক্তি।
রাজনৈতিক বিবেচনায় বিনিয়োগ
রাষ্ট্রীয় অর্থে গড়ে তোলা বাংলাদেশ স্টার্টআপ কোম্পানির অর্থ বিনিয়োগে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সামির বিরুদ্ধে।
জুলাই আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় আয়মান সাদিকের প্রতিষ্ঠান ‘টেন মিনিট স্কুল’-এ ৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব বাতিল করেছিল বিএসসিএল।
সে সময় সামির সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করেছিলেন এমন একাধিক সূত্র রূপালী বাংলাদেশকে জানান যে, ‘ওপর মহল’ এর নির্দেশে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
এ ছাড়াও আরেক এডটেক প্ল্যাটফর্ম ‘শিখো’ এর বিনিয়োগ প্রস্তাব প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে বাতিল করেন সামি। অভিযোগ ছিল, ‘শিখো’ এর একজন উদ্যোক্তার আত্মীয় জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। তবে বিষয়টিকে এমন দৃষ্টিতে দেখতে নারাজ শিখো’র প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও শাহির চৌধুরী।
রূপালী বাংলাদেশকে শাহির চৌধুরী বলেন, এটা ঠিক যে, প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে শিখো’র বিনিয়োগ প্রস্তাব বাতিল হয়েছে এবং এর পেছনে কোনো কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।
তাই বলতে পারছি না যে, রাজনৈতিক কারণেই বিনিয়োগ বাতিল হয়েছে। পাশাপাশি মনে হয় না যে, সামি আহমেদ একা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আরও বড় কোনো পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত এসেছে। ৫ আগস্টের পর স্টার্টআপ বাংলাদেশের সাথে নতুন করে যোগাযোগ হয়েছে। নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছি।
রাজনৈতিক বিবেচনায় বিনিয়োগ প্রস্তাব বাতিলের পাশাপাশি বিনিয়োগ করারও নজির রয়েছে সামি আহমেদের। আওয়ামীপন্থি সাবেক মেয়র আনিসুল হকের ছেলে নাভিদুল হকের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘বঙ্গ’তে ৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ করে বিএসসিএল।
২০২৩ সালের আগস্টে পলকের উপস্থিতিতে এ বিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এমনকি, বঙ্গ আয়োজিত ‘শার্ক ট্যাংক’ অনুষ্ঠানে বিএসসিএল’র পৃষ্ঠপোষকতাও দেন সামি। রাজনৈতিক বিবেচনায় আরেক বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’কে নানা সুবিধা দিয়েছেন সামি।
পরিচয় গোপনের শর্তে দেশের প্রতিষ্ঠিত একটি স্টার্টআপের সিইও বলেন, সামির আয়োজিত দুটি স্টার্টআপ সামিট দেখলেই বোঝা যাবে, তিনি কীভাবে কাদের ‘ফ্যাসিলিটেড’ করেছেন। ‘নগদ’কে ফান্ডিং দিয়েছেন।
নগদের এমডি (সাবেক) তানভীর এ মিশুককে শেখ হাসিনার সামনে ৪০ মিনিট বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল সামি।
কীভাবে কাকে সুবিধা দিয়ে ওপর মহলের উদ্দেশ্য হাসিলের মাধ্যমে নিজের ক্যারিয়ারের উন্নতি করতে হবে, সে বিষয়ে সামি সিদ্ধহস্ত।
৫ আগস্টের পর একবারও কি নিজের বিতর্কিত ভূমিকার জন্য প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন তিনি? করেননি, তাহলে এই পদে কীভাবে থাকেন? সরকারের একটি মহলকে ‘ম্যানেজ’ করে এই পদে এতদিন আছেন তিনি।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের একটি সূত্র জানান, সরিয়ে দেওয়া হলে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা পড়বে- এমন গল্পের ফাঁদ পেতে ৫ আগস্টের পরেও নিজের পদ টিকিয়েছেন সামি।
বিষয়টির ইঙ্গিত পাওয়া যায় প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যবের বক্তব্যেও। রূপালী বাংলাদেশকে ফয়েজ তৈয়্যব বলেন, সামির অপসারণে যারা আন্দোলন করেছিল তাদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করেছি।
সে সময় দুটি অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি চলছিল- ইয়ুথ সামিট এবং স্টার্টআপ সামিট। স্টার্টআপ সামিট পরবর্তীতে বিডা’র ইনভেস্টমেন্ট সামিটের সাথে একীভূত হয়। আন্দোলনকারীদের থেকে এই সামিট পর্যন্ত সময় চেয়েছিলাম। এরপর আরও একটি গ্রুপ আসে।
তাদেরও বলেছি, সামনে একটি সামিট আছে। সামিটের আগে (সামিকে সরিয়ে) অস্থিরতা চাই না। বিষয়টা যেহেতু আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট’দের সাথে যোগাযোগ রক্ষার বিষয়, এখানে আমাদের ‘গ্রেসফুললি’ কাজ করতে হবে।
নিয়ম না মেনেই বিনিয়োগ
বিএসসিএল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হলেও বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত একাই নিতেন সামি আহমেদ। রিয়েলিটি শো ‘শার্ক ট্যাংক’ এর প্রথম সিজনে অন্তত ১৪টি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ বা অর্থ লগ্নি করেছেন বা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সামি।
প্রায় ৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা শেয়ারের বিনিময়ে বিনিয়োগ, সুদের বিনিময়ে লোন এবং অনুদান হিসেবে ঘোষণা দেন সামি। অথচ এসব অর্থই রাষ্ট্রের জনগণের টাকায় গঠিত বাংলাদেশ স্টার্টআপ কোম্পানির।
প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন পর্যালোচনায় দেখা যায়, কোনো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করতে হলে কমপক্ষে সাতটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়।
এসব ধাপে অন্তত এক ডজন বিষয় দেখভালের পর বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। আর সেই সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার কোম্পানির বোর্ডের।
কিন্তু শার্ক ট্যাংকে রাষ্ট্রীয় অর্থের খরচের সিদ্ধান্ত একাই নিয়েছেন সামি আহমেদ। এসব বিষয়ে বক্তব্যের জন্য দুই দিন যোগাযোগের চেষ্টা করেও সামি আহমেদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে ফয়েজ তৈয়্যব বলেন, ওনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় আন্দোলন হয়েছে। কিছু লোকের ধারণা যে, তিনি আর্থিক অনিয়মের সাথে জড়িত। এর সত্য-মিথ্যা দুটো দিকই আছে।
তবে তদন্তে গুরুতর কোনো প্রমাণ পায়নি। একটা ঘটনা এমন হতে পারে যে, ব্যর্থ অনেক কোম্পানিতে ফান্ডিং করেছে যেটিকে মোকাবিলার জন্য সফল কিছু কোম্পানিতে ফান্ডিং করে সেটিকে মার্কেটিং করেছে। অর্থাৎ সফলতা দেখিয়েছে।
আর পলকের সাথে ঘনিষ্ঠ থাকার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। কিন্তু শুধু এটার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে সরানো যায় না; কারণ এটা একটা কোম্পানি, যার নিজস্ব কোম্পানি আইন আছে।
ইতোমধ্যে সামিকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি ২০ দিনের মতো ছুটিতে আছেন। এই ছুটি কাটাতে কাটাতে এপ্রিল শেষ হয়ে যাবে।
কোম্পানি আইন মেনে ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’ করতে হয়। আইন পরিপন্থি কিছু করব না। আশা রাখছি, মে মাসের কোনো এক সময় স্টার্টআপ কোম্পানির নতুন এমডি খুঁজে পাব।
আপনার মতামত লিখুন :