আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমুর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ফখরুল মজিদ কিরণের বিরুদ্ধে ঝালকাঠি জেলায় দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি, দখল, ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
আমুর আপন ভায়রা ও এপিএস পরিচয়ে বিগত ১৫ বছরে ব্যাপক দাপট চালিয়েছেন এই কিরণ। ঝালকাঠি-নলছিটিতে একচ্ছত্র টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ বাণিজ্য, দলের কমিটি গঠন, নির্বাচনে মনোয়ন বাণিজ্যসহ যেকোনো কাজ থেকে কমিশন বাণিজ্য চালিয়ে তিনি অবৈধভাবে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার মালিক বনেছেন। ঢাকা ও নরসিংদীতে করেছেন সম্পদের পাহাড়। বিগত সরকারের শেষের দিকে আমুর পরিবর্তে এই কিরণই যেন নলছিটির এমপি বনে গিয়েছিলেন। মূলত তার কথামতোই চলতে বাধ্য হতো স্থানীয় প্রশাসন। একই সময়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেত্রাকর্মীদের মামলা ও পুলিশ দিয়ে হয়রানি চালিয়ে এলাকাছাড়া করেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও বিভিন্ন দলের নেতারা।
তবে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতন ও আমির হোসেন আমুর গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে পলাতক রয়েছেন সেই দাপুটে এপিএস কিরণ। একই সঙ্গে তিনি সাবেক মন্ত্রী নূরুল মজিদ হুমায়ুনের আপন ছোট ভাই হওয়ায় কেবল একজন এপিএস হওয়ার পরও তিনি বেপরোয়া ও ব্যাপক ক্ষমতাসীন ছিলেন। বিগত আট মাসেও তাকে গ্রেপ্তার করে আইনে মুখোমুখি করতে পারেনি পুলিশ। একই সঙ্গে তার অঢেল অবৈধ সম্পদের উৎস খতিয়ে দেখতে দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি পতিষ্ঠানকে আহ্বান জানিয়েছেন ঝালকাঠি-নলছিটিবাসী।
নরসিংদির মনোহরদী উপজেলার বাসিন্দা ফখরুল মজিদ কিরন সম্পর্কে আমির হোসেন আমুর ভায়রা। এই আত্মীয়তার সূত্র ধরেই তিনি বহু বছর ধরে আমুর ছত্রছায়ায় থেকে ঝালকাঠির প্রশাসন, রাজনীতি এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যেও প্রভাব খাটাতেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। উন্নয়ন প্রকল্পে ভাগবাঁটোয়ারা, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ বাণিজ্য সবকিছুতেই তার ‘কমিশন কালচার’ চালু ছিল বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়। এভাবে গত এক যুগে শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
ঝালকাঠি-নলছিটির অনেক স্থানীয় নেতা অভিযোগ করে বলেন, আমুর সঙ্গে দেখা করতে হলেও আগে কিরনের অনুমতি লাগত। এমনকি তিনি ছিলেন যেন একজন বেনামি মন্ত্রী।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে ঝালকাঠি শহরে বিএনপির একটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা, ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার প্রায় দুই বছর পর, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঝালকাঠি সদর থানায় একটি বিস্তৃত মামলা দায়ের করা হয়।
ওই মামলায় আমুর দুই এপিএসসহ মোট ৯৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়, যার মধ্যে কিরন সরাসরি অভিযুক্ত। মামলার বাদী বিএনপির এক স্থানীয় নেতা অভিযোগ করেন, হামলার সময় পুলিশের উপস্থিতিতেও হামলাকারীরা নির্বিঘ্নে তাণ্ডব চালায়। ২০১৯ সালের মে মাসে ঝালকাঠি সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ‘দোয়াত-কলম’ প্রতীকের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী সুলতান হোসেন খান লিখিত অভিযোগে জানান, আমু ও তার এপিএস কিরন প্রকাশ্যে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করতে নেতাকর্মীদের বাধ্য করা হচ্ছিল, এমনকি ভোটের মাঠে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছিল।
ফখরুল মজিদ কিরনের পরিবারও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। তার বড় ভাই নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন ছিলেন সাবেক শিল্পমন্ত্রী। আরেক ভাই খায়রুল মজিদ মাহমুদ চন্দন ছিলেন ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তাদের বাবা এম এ মজিদ ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
বর্তমানে ফখরুল মজিদ কিরনের অবস্থান নিয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। কেউ বলছেন, তিনি এরই মধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, আবার কেউ বলছেন ঢাকাতেই আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুর এপিএস ফখরুল মজিদ কিরনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার পরও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ঝালকাঠি জেলা বিএনপির নেতারা।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জেলা বিএনপির সদস্যসচিব মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, আমাদের বরাবরই একই দাবি হাসিনার শাসনামলে ঝালকাঠিতে যারা জুলুম-নিপীড়ন চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, এফআইআর হয়েছে। কিন্তু তাদের কেন এখনো গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না! ফখরুল মজিদ কিরন তাদের একজন। তারা আমার বাসা, আমাদের বিএনপি অফিস ভাঙচুর করেছে, নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা, মামলাসহ নানা ধরনের অপরাধ করেছে।
তিনি আরও বলেন, কিরন শুধু একজন এপিএস ছিলেন না, তিনিই ছিলেন ঝালকাঠির অঘোষিত আমু। কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। যদিও তার বাড়ি এখানে নয়, তবু তিনি আমুর ছায়ায় ঝালকাঠিকে জিম্মি করে রেখেছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঝালকাঠি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান বলেন, ফখরুল মজিদ কিরনের বিরুদ্ধে থানায় নিয়মিত মামলা রুজু আছে। আমরা ঘটনাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি এবং এরই মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলো যাচাইবাছাই করা হচ্ছে। তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।