ফ্যাসিবাদ পতনের পর যে স্বস্তির আশায় বুক বেঁধেছিল দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি, সময় যত যাচ্ছে, সে আশায় গুড়ে বালি পড়ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। রাজনীতির মাঠে এখন আলোচনা- অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন কি দেবে শিগগির?
যদি নির্বাচন দেয়, তবে তা স্পষ্ট করছে না কেন? যদিও একাধিক বিদেশি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নির্বাচন ডিসেম্বরে অথবা ২০২৬ সালের জুনে হতে পারে। নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে বলে মনে করছে বিএনপি। নির্বাচনের দাবি তুলে জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিপক্ষ হয়েছে বিএনপি।
বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দলের নেতারা জানান, নির্বাচন নিয়ে সরকারের একেক সময়ে একেক বক্তব্যে একধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এতে রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি আরও অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে।
দেশ-বিদেশেও খারাপ বার্তা পৌঁছানোর আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। আবার অনির্বাচিত সরকার বেশি দিন ক্ষমতায় থাকলে এটি জাতির জন্য আরেকটি নেতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি হবে। এ জন্য উদার রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ডান ও বাম দলগুলোকে এক প্ল্যাটফর্মে আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এরই মধ্যে অভিন্ন দাবিতে এসব দল সোচ্চার রয়েছে। খুব শিগগির আনুষ্ঠানিক বৈঠকের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল নেওয়া হবে। সেখান থেকে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানানো হবে। একই সঙ্গে একই দাবিতে পৃথক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ভূমিকা রাখবে এসব দল।
এতেও কাজ না হলে ধীরে ধীরে কর্মসূচির তীব্রতা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে দলগুলোর। তবে আপাতত সরকারের ওপর সমর্থন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত রয়েছে। একটি বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে শিগগির রাজপথে নামছে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো।
চলতি এপ্রিল মাস থেকে শুরু হবে তাদের নানা কর্মসূচি। ধীরে ধীরে এ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে তারা। এর আগে সরকারের কাছে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে আগামী ১৬ এপ্রিল আবারও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করবেন বিএনপি নেতারা।
সেখানে নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানানো হবে। এ ছাড়া ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিও জানানো হবে।
এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও পাঁচ বছর দেখতে চায় দেশের মানুষ। বৃহস্পতিবার এমন কথা বলে আলোচনায় রয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
এর আগে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মন্তব্য করেন, সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচন হলে সেটি মেনে নেওয়া হবে না।
এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক মহলে নতুন একটি দাবির কথা উঠে এসেছে, যেখানে ইউনূস সরকারকে অন্তত ২০২৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সম্প্রতি ফেসবুকে এনসিপির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (উত্তরাঞ্চল) এ দাবি করেন। এমন পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ধোঁয়াশা রয়েছে।
বিভিন্ন দলের মধ্যে নির্বাচনের ইস্যুতে ঐকমত্যের অভাবও দেখা যাচ্ছে। মুখে মুখে ঐক্যের কথা বলা হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্রমশ বাড়ছে দূরত্ব।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু বুদ্ধিজীবীর পরামর্শে এ দাবি উঠে আসতে পারে, যা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতীয় সরকারে রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা হতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মনে করছেন, এই সরকারের মেয়াদ বাড়ানো দেশের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে, যার লাগাম টানতে পারছে না সরকার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতার মতে, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হলে এবং বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কোনো মৈত্রী তৈরি না হলে সংগত কারণে জামায়াত ক্ষমতার মধুচন্দ্রিমা থেকে ছিটকে পড়বে।
এ অবস্থায় জামায়াত চায় না শিগগির নির্বাচন হোক। জামায়াত প্রভাবিত ছাত্রদের অংশটিও নির্বাচন চায় না। তাদের সঙ্গে কিছু বুদ্ধিজীবীরও এটি চাওয়া। এ কারণে তারা নির্বাচনের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত প্রচারণা শুরু করেছেন। সরকারের একটি অংশ এর সঙ্গে জড়িত আছে বলে ধারণা তার।
বিএনপি মনে করছে, এই সরকার বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছে। শুরুতেই জামায়াত ও ইসলামপন্থিদের প্রতি সরকারের অতিরিক্ত সখ্যের কারণে উদারপন্থিরা সরকারের কাছ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে।
নানা রকমের বিভাজনের কারণে ছাত্রদের জনপ্রিয়তাও দিনে দিনে কমতে শুরু করেছে। নারীর প্রতি সহিংসতাসহ নানা ঘটনা সমাজে গভীর ভীতি তৈরি করেছে।
সারা দেশে মাজার ভাঙচুর, মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট, গানের অনুষ্ঠান বন্ধ করা, শিল্পীদের হুমকি-ধমকিতে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যাতে মনে হয় দেশে ইসলামপন্থি উগ্রবাদের ব্যাপক উত্থান ঘটেছে। বিশেষ করে যত্রতত্র মব তৈরি করার মধ্য দিয়ে যেভাবে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে বহু মানুষ উদ্বিগ্ন।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্থিতিশীল সরকার চায়। সেনাবাহিনীও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায় বলে বারবার জানিয়েছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নির্বাচন আয়োজন প্রাধান্য পাওয়া উচিত।
তা ছাড়া নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করলে সেই সরকার সব দিক থেকে জাতীয় সরকার হবে বলে বিএনপি বারবার বলে এসেছে। সেই সরকারেও ড. ইউনূসের দক্ষতা কাজে লাগানোর সুযোগ থাকবে। যদিও নির্বাচনের আগেই জাতীয় সরকার গঠন করতে চায় জামায়াত, এনসিপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল।
এরই মধ্যে চট্টগ্রামে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, একটি শক্তি ক্ষমতায় থাকার জন্য নতুন নতুন কায়দাকানুন বের করছে। রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে ফ্যাসিস্টরা দাঁড়াতে পারেনি।
পতন হয়েছে, পালিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। এই শক্তিও যাতে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য বাংলাদেশের মানুষ প্রস্তুত রয়েছে।
এরই মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান রয়টার্সের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন না হলে জনগণের মধ্যে জোরালো অসন্তোষ এবং দেশে অস্থিরতা তৈরি হবে। তার দায় সরকারকে নিতে হবে বলেও সতর্ক করেছেন তিনি।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক রূপালী বাংলাদেশেকে বলেন, মানুষ এই সরকারকে দুর্বল ও অকার্যকর মনে করায় নৈরাজ্যের বিস্তার ঘটছে। গণঅভ্যুত্থানের আট মাসেও মানুষের জীবনে স্বস্তি আসেনি।
এ অবস্থা চলতে দিলে জনগণের জান-মাল আরও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে। তাই এই সরকারের সময় বাড়ানোর যেসব কথা বলা হচ্ছে, সেটি না করাই উত্তম। সরকার যদি কারও কথায় প্রভাবিত হয়ে সময়ক্ষেপণ করে, তাহলে তাদের জন্য ঝুঁকি আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কিছুদিনের মধ্যে সরকার সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনের রোডম্যাপ না দিলে অতীতের মতো সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে নামব। যেমনটি আমরা করেছি ফ্যাসিবাদী আওয়ামীলীগকে বিতাড়িত করতে।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন মো. ফারুক রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দেশের মানুষ ভোট দিতে পারছে না দেড় দশক ধরে। মানুষ কী চায়, সেটি বুঝতে পারেনি বা বুঝতে চায়নি বলেই আওয়ামী লীগের মতো এত বড় একটি দল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
আমলা ও প্রশাসনের সর্বশক্তি দিয়েও টিকে থাকতে পারেনি তারা। পালিয়ে যেতে হয়েছে। জনগণের কাছাকাছি যেতে হলে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার জনগণের প্রত্যাশা।
বলতে পারেন তারা বিজনেস সামিট করে দেশে ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে যাচ্ছে। অনেক বিনিয়োগ আসছে। একটি সরকারের এটা রুটিন ওয়ার্ক। এটি করবে এটা তাদের দায়িত্ব।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কতটুকু বাস্তবায়ন হবে তা কিন্তু এখই আপনি-আমি কেউই বলতে পারছি না। ভালো কাজ করলে বাহবা পাবে। কিন্তু এসব দোহাই দিয়ে দীর্ঘ সময় তাদের ক্ষমতায় থাকার বাসনা থাকলে বিপদ হবে তাদের জন্যই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য এতদিন ধরে সরকারের কাছে যে আহ্বান জানিয়ে এসেছি, আগামী ১৬ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে চাই। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আহ্বান জানাব।
তিনি কী পদক্ষেপ নেন এবং কী ঘোষণা দেন, তার জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করব আমরা। এর পরও প্রত্যাশিত ঘোষণা না এলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরব।’
প্রধান উপদেষ্টা যদি একেক সময় একেক কথা বলেন, দেখতে হবে কেন এভাবে বলছেন। নির্বাচন পেছানো গেলে একটি দলের কিছু লাভ আছে। তারা চেষ্টা করছে নির্বাচন কীভাবে পেছানো যায়।
চলতি মাসে চিকিৎসা শেষ করে দেশে ফেরার কথা রয়েছে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার। তিনি দেশে ফেরার পর দলের নীতি-নির্ধারণী ফোরামের সফঙ্গ আলোচনা করে আমাদের রাজনৈতিক বক্তব্য মাঠে-ময়দানে, জনগণের কাছে কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তুলে ধরার পরিকল্পনা আছে।
সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে সতর্ক করতে বিএনপির নেতারা আগে থেকেই বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে আসছেন। ঈদের আগের দিন বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মির্জা ফখরুল বলেছেন, নির্বাচনের আগে সরকার নিরপেক্ষতা হারালে বিএনপি তা কোনোভাবেই মেনে নেবে না।
তারা সরকারের পূর্ণ নিরপেক্ষতা প্রত্যাশা করে অধ্যাপক ইউনূসের কাছ থেকে। যদি প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেন, তাহলে জনগণের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হবে যে, এই সরকার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :