রবিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৫

রাজধানীতে রিকশার দৌরাত্ম্য বাড়ছে যানজট-দুর্ঘটনা

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: এপ্রিল ১২, ২০২৫, ০১:১৩ এএম

রাজধানীতে রিকশার দৌরাত্ম্য বাড়ছে যানজট-দুর্ঘটনা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে যেন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তিন চাকার বাহন রিকশা। অনিয়ন্ত্রিত এসব রিকশা সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশকে। তা ছাড়া এদের কারণে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। 

এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে রিকশা ট্র্যাপার চালু হয়েছে। তবে বেশির ভাগ চালকই এর তোয়াক্কা করছেন না। রিকশাচালকেরা ট্র্যাপারের কাছাকাছি এসে গাড়িটি উঁচু করে পার করে রাস্তায় চলাচল করছেন।

এখন রিকশা ঢাকাসহ সারা দেশের মূল সড়কগুলোতে বেপরোয়াভাবে চলছে, যার কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। গতিবিধি, লাইন-লেন মানার কোনো বালাই নেই। সড়কের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যেন রাজপথ দখলে ব্যস্ত রিকশাচালকেরা। নিজের ইচ্ছামতো প্রবেশ করছেন গুরুত্বপূর্ণ সব সড়কে। রিকশার এমন আধিপত্যে বাকি সব বাহন যেন অসহায়।
তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বাড়ছে দুর্ঘটনা, বিদ্যুতের অপচয়:
অদক্ষ ও অপেশাদার চালকের হাতে নিয়ন্ত্রণহীন হ্যান্ডেল। এসব যানবাহনের বেপরোয়া গতিতে আতঙ্কে নগরবাসীসহ গোটা দেশ। 

যাত্রীরা প্রতিদিনই ভোগান্তি আর দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে এসব যানবাহনের কারণে। সিটি করপোরেশন ও বিআরটিএ কর্তৃক কোনো লাইসেন্স না থাকলেও ইজিবাইক ও রিকশা চলছে সড়কে। 

সুষ্ঠু তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অবৈধ যানের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে দুর্ঘটনা ও বিদ্যুতের অপচয়।

সব সড়কই অবৈধ ইজিবাইক ও অটোরিকশার দখলে:
এসব অবৈধ যানের কারণে সড়কে যানজট তৈরি হচ্ছে। এসব অবৈধ যানবাহনের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ। 

গড়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫টি ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। আর সড়কে পায়ে হেঁটে চলাচলও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে পথচারীদের। সচেতন মহলের দাবি, দ্রুত অবৈধ যানবাহন বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনস্থল সম্পূর্ণ সিলগালা করে দেওয়া হোক। 

রাজনৈতিক দল সমর্থিতরা রিকশা রাস্তায় নামাচ্ছেন: 
২০১৯ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বা বিলসের এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, ঢাকা শহরে ১১ লাখের বেশি রিকশা চলাচল করছে।  

এই সংখ্যা গত পাঁচ বছরে বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভেতরে বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ রিকশা চলাচল করছে। 

মোট অবৈধ রিকশার সংখ্যা একেবারেই ধারণার ওপর নির্ভর করে। সংখ্যাটা আরও বেশিই হবে। রিকশার ওপর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কোনো নিয়ন্ত্রণ কখনোই ছিল না। দুই সিটি করপোরেশেন এলাকায় ১৫ লাখের বেশি রিকশা চলাচল করছে। 

৩ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশাও চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সমর্থিত বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা অবৈধ রিকশা রাস্তায় নামানোর জন্য প্রধানত দায়ী।

রিকশার মালিকেরা বলছেন, একটি সাধারণ রিকশা তৈরিতে খরচ হয় ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এরপর লাইসেন্স নিতে খরচ হয় প্রায় একই রকম। 

কিন্তু ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে তৈরি করা যায় একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা। তাতে নেই লাইসেন্স নেওয়ার ঝামেলা। তাই অনেকেই এসব রিকশা কিনে কারও হাতে ধরিয়ে দিয়ে পথে নামাচ্ছেন।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামছুল হক জানান, জনবহুল এই নগরীতে পর্যাপ্ত গণপরিবহন না থাকার কারণেই অবৈধ রিকশা বেড়েছে। 

রিকশার কারণে অন্যান্য যানবাহনের গতি কমে যানজট হচ্ছে। বহু মানুষ এই পেশায় জড়িত। তাই রিকশা তুলে দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রিকশা চলাচলে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সবাইকে ভাবতে হবে। 

প্রধান সড়ক থেকে রিকশার পরিবর্তে বেশিসংখ্যক যাত্রী ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন যানবাহন নামানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

নেই লাইসেন্স ও প্রশিক্ষণ, মরণফাঁদে যাত্রীরা
একাধিক পথচারী জানান, সড়কে বেপরোয়া হয়ে উঠছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এরা অলিগলি থেকে শুরু করে মহাসড়কেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। 

এদের নেই কোনো লাইসেন্স, নেই কোনো প্রশিক্ষণ। এদের কারণে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। এ যেন মরণফাঁদে চলাচল যাত্রীদের!

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাটারিচালিত অবৈধ ইজিবাইক ও রিকশা নিয়ন্ত্রণে নগর ট্র্যাফিক বিভাগ প্রতিদিন ৫ থেকে ১০টি লাইসেন্সবিহীন অবৈধ ইজিবাইক ও রিকশা আটক করে থাকেন। 

বেশ কিছুদিন আটকে রাখার পর সেগুলো আবার ৩ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ নিয়েও চলছে তুঘলকি কাণ্ড। মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয়ের বাণিজ্যে ফের রাস্তায় নেমে পড়ছে এসব অবৈধ ইজিবাইক ও রিকশা। 

তবে বিআরটিএ বলছে, নগরীতে আয়তনের তুলনায় অবৈধ ইজিবাইক ও রিকশার সংখ্যাই অনেক বেশি। এসব অবৈধ ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ নেওয়া খুব জরুরি।

অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ‘একটি ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত ভ্যান ও রিকশায় পাঁচটি করে ১২ ভোল্টের ব্যাটারি থাকে। ১২ ভোল্টের পাঁচ ব্যাটারির ধারণক্ষমতা ২ কিলোওয়াট। 

দিনে পাঁচটি ব্যাটারির একটি ইজিবাইক আট ঘণ্টা চার্জ দিলে খরচ হয় ১৪-১৫ ইউনিট বিদ্যুৎ। সে হিসাবে নগরীতে বর্তমানে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ ব্যয় হচ্ছে ইজিবাইক চার্জে। তাই এ বিষয়ে সরকারের জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।

ঢাকা শহরে যেন রিকশার রাজত্ব

সরেজমিন ঢাকার অলিগলি থেকে মূল সড়কÑ সবখানেই এখন একই চিত্র। অটোরিকশার অনিয়ন্ত্রিত চলাচল বাড়াচ্ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। একই সঙ্গে বাড়ছে যানজটও। দীর্ঘদিন এমন সমস্যার প্রতিকার না মেলায় নগরবাসীর কণ্ঠে কেবল অসহায়ত্বের সুর।

একজন পথচারী বলেন, ‘অটোরিকশাচালকেরা ডানেও দেখে না বামেও দেখে না, রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে।’ আক্ষেপের সুরে আরেকজন বলেন, ‘ঢাকা শহরে যেন রিকশাওয়ালাদের রাজত্ব চলছে। তারা পুলিশ বা ট্রাফিক পুলিশ কাউকেই মানে না।’

ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে রিকশা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং, অতিষ্ঠ ট্রাফিক পুলিশ: নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা না গেলেও বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী, রাজধানীতে বর্তমানে প্যাডেল ও অটোরিকশা রয়েছে ২২ লাখের বেশি। 

এর মধ্যে আবার বেশির ভাগেরই নেই লাইসেন্স। ফলে শুধু রিকশা সামাল দিতেই অতিষ্ঠ ট্রাফিক পুলিশ ও সহযোগীরা।

ট্রাফিক পুলিশ জানান, প্রথমত, অটোরিকশা বা প্যাডেল রিকশার কারণে রাস্তায় বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।

রিকশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ প্রশাসন
বারবার নিয়ম করেও রিকশা নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই ব্যর্থ প্রশাসন। এমনকি উচ্চ আদালত থেকে নিষিদ্ধ করা হলেও চালকদের আন্দোলনের মুখে সেটা তুলে নেন আদালত। 

তবে এবার বেপরোয়া চলাচল রোধে পরীক্ষামূলকভাবে রিকশা ট্র্যাপার স্থাপন করেছে ট্রাফিক বিভাগ। এতে দু-একটি আটকে গেলেও বেশির ভাগ রিকশাই পার হতে সক্ষম হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর ট্রাফিক বিভাগের তথ্য বলছে, ঈদের আগে ও পরে ১৫ দিনে অটোরিকশার কারণে ১৫০টিরও বেশি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে শতাধিক ব্যক্তি। মৃত্যুও ঘটেছে। 

এ অবস্থায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নগরবাসীকেও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ। অন্যদিকে অটোরিকশার অবাধ চলাচল ঠেকাতে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

একাধিক বাসের চালকেরা বলেন, এই গাড়িগুলোর ব্রেকের ঠিক নেই। গাড়িগুলো মূল সড়ক দিয়ে চলতে দেওয়া উচিত নয়। অটোরিকশাগুলো খুবই বেপরোয়া গতির। ওদের জন্য গাড়ি চালানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন পদক্ষেপ নিলে এই গাড়িগুলো মূল সড়কে চলতে পারত না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. সরওয়ার বলেন, ঈদে গণপরিবহন কম থাকায় যাত্রীরা বিকল্প হিসেবে অটোরিকশায় চলাচল করে। 

এ জন্য ঢাকার অনেক পথেই অটোচালকেরা সাহস করে বেরিয়ে পড়ছেন। তবে মূল সড়কে যেন অটোরিকশা উঠতে না পারে, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ট্রাফিক পুলিশকে বলা হচ্ছে।  

রমনা বিভাগের দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক সার্জেন্ট রায়হান জানান, ‘যারা অটোরিকশায় চড়বেন, তাদের অত্যধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। চালককে উদ্বুদ্ধ করবেন ধীরে-সুস্থে চালাতে। যেসব রাস্তায় এগুলো চলাচল নিষিদ্ধ, সেসব রাস্তা যাত্রীরা যেন ব্যবহার না করেন।’

এসব বিষয়ে বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুল নেওয়াজ মনে করেন, ‘থ্রি-হুইলার ও ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বাংলাদেশে দুর্ঘটনা বাড়তে থাকবেই। 

এই অধ্যাপক মনে করেন, অটোরিকশাগুলো যেখানে চার্জ দেওয়া হচ্ছে, সেই জায়গাগুলো বন্ধ করা দরকার। এ ছাড়া নির্দিষ্ট রাস্তা ছেড়ে মূল সড়কে যাতে গাড়িগুলো উঠতে না পারে, ব্যাপারটাও স্ট্রংলি মনিটরিং করা উচিত।’
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!