বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ১৪টি রোগে ভুগছে দেশের ৯০.৬৬ শতাংশ মানুষ। এসব রোগের মধ্যে রয়েছে কলেরা, টাইফয়েড, ডায়রিয়া ও গ্যাস্ট্রিক, ডেঙ্গু, ডায়াবেটিস, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা, নিউমোনিয়া ও মূত্রনালির সংক্রমণ।
এসব রোগের মধ্যে কোনো কোনোটির একাধিক ধরনেও আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ১৪টি রোগের মধ্যে তিন ধরনের নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের হার সর্বোচ্চ ৫৭.৬ শতাংশ। ৫৫ দশমিক ৮২ শতাংশ হার নিয়ে আক্রান্তদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে নারীরা।
এ ছাড়া ৩৩ দশমিক ১৩ শতাংশ শিশু আক্রান্তের হারও প্রচণ্ড উদ্বেগের কারণ বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে ১৮ দশমিক ২৭ শতাংশ আক্রান্তের হার নিয়ে দেশের ৮ বিভাগের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে রাজশাহী বিভাগ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা চট্টগ্রাম বিভাগে আক্রান্তের হার ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকৃত প্রখ্যাত স্বাস্থ্যবিষয়ক ‘প্লস ওয়ান’ জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রতিবেদনটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পিআর রিভিউড গবেষণা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।
২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সরকারের স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্যভাণ্ডার থেকে সংগৃহীত ২৮ লাখ মানুষের রোগের নমুনার তথ্য নিয়ে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
‘আন্ডারস্ট্যাডিং ক্লাইমেট- সেনসিটিভ ডিজিজেস ইন বাংলাদেশ ইউজিং সিস্টেমেটিক রিভিউ অ্যান্ড গভর্নমেন্ট ডাটা রিপোজিটরি’ শীর্ষক এই গবেষণা পরিচালনা করেন বাংলাদেশর একদল গবেষক।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ প্রমোশন ইউনিটের (সিসিএইচপিইউ) সমন্বয়কারী ও বিশিষ্ট রোগতত্ত্ববিদ প্রফেসর ডা. ইকবাল কবীরের নেতৃত্বে গবেষক দলে অন্যতম ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির গবেষক মো. নুরুজ্জামান খান।
গবেষণা পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের নথিভুক্ত তথ্যের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, রোগগুলোকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সব জলবায়ু-সংবেদনশীল রোগ সম্পর্কে প্রতিবেদন দেওয়া এবং নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। এ জন্য দ্রুত নীতিমালা ও কর্মসূচি তৈরি করা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে গবেষণার পটভূমি সম্পর্কে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের প্রতি সাতজনের একজন বাস্তুচ্যুত হবে।
এর ফলে দেশের মোট ভূমির প্রায় ১১ শতাংশ ক্ষতি হবে। ১৮ মিলিয়ন মানুষ স্থানান্তরিত হবে। দেশে প্রতিবছর সংঘটিত বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, আকস্মিক বন্যা এবং ভূমিধস এসব আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। পাশাপাশি ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, কালাজ্বর, কলেরাসহ জলবায়ু সংবেদনশীল রোগও বাড়ছে।
অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবায় অপর্যাপ্ত তহবিল, অবকাঠামো, সম্পদ, সরবরাহ এবং পরিষেবাব্যবস্থা ঝুঁকিকে মারাত্মক করে তুলছে। এতে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যাপক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে জলবায়ু সংবেদনশীল রোগগুলোকে চিহ্নিত করে জনস্বাস্থ্যে প্রভাব ও চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার পথ খোঁজার লক্ষ্যে এই গবেষণা পরিচালিত হয়।
জানা গেছে, ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ (আইসিডি)-দশম ভার্সন অনুযায়ী বিশ্বে ৫১০টি রোগকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্টি বলে নির্ণয় করা হয়েছে।
৫১০টি রোগকে ম্যাপিং করে গবেষণা পরিচালনা করতে গিয়ে গবেষক দল দেশে ১৪৩টি জলবায়ু-সংবেদনশীল রোগের অস্তিত্ব পায়। পরবর্তী সময়ে আরো বিশ্লেষণ করে ১৪৩টি রোগের মধ্যে মোটা দাগে ১৪টি রোগ জলবায়ু-সংবেদনশীল হিসেবে চিহ্নিত হয়।
গবেষণা পরিচালনার ক্ষেত্রে দুইভাবে পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ করা হয়। এর মধ্যে ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সরকারের স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য ভান্ডার থেকে সংগৃহীত ২৮ লাখ মানুষের রোগের নমুনা পর্যালোচনা করা হয়। আরেকটি হলো ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ১৪০০ গবেষণা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা।
গবেষণায় ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৮ লাখ মানুষের ১৪টি রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ও হারের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০২২ সালে ১৪টি রোগে আক্রান্তের হার সর্Ÿোচ্চ ৯০.৬৬ শতাংশ দেখা গেছে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছে ১৭.১৫ শতাংশ, টাইফয়েডে ১৬.৯৪, ডায়রিয়া ও গ্যাস্ট্রোএন্টারাইটিসে ১৮.৯৬, ডেঙ্গুতে ৪২.০৩, ইনসুলিন নির্ভর ডায়াবেটিসে ২৬.৯১, ইনসুলিন ছাড়া ডায়াবেটিসে ৩০.১৩, অপুষ্টি ও অনির্দেশিত ডায়াবেটিসে ২৫.৮৯, ফোবিক ও দুশ্চিন্তা ১৩.৮৬, দুশ্চিন্তা, প্যানিক ও এ-সংক্রান্ত সাধারণ রোগ ২০.২৯,
সোমাটোফর্ম ডিসঅর্ডারে ১৭.৭৭, ভাইরাল নিউমোনিয়া ১৫.৬৭, ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া ২২.৫২, অন্যান্য নিউমোনিয়া ১৯.৫২ ও মূত্রনালির সংক্রমণ ২২.২৮ ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ২২.৫১ শতাংশ মানুষ।
২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তুলনামূলক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে কলেরা, টাইফয়েড, ডায়রিয়া ও গ্যাস্ট্রোএন্টারাইটিস এই তিনটি রোগের কোন রেকর্ড না থাকায় আক্রান্তের হার জানা যায়নি।
তবে ২০১৭ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার ০.৭২ শতাংশ হলেও পাঁচ বছর পর ২০২২ সালে এই হার এসে দাঁড়ায় ৪২ শতাংশে। অর্থাৎ এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বেড়েছে ৪১ শতাংশ। আবার ইনসুলিন ছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার ২০১৭ সালে মাত্র ৭.৭০ শতাংশ থাকলেও ২০২২ এসে তা দাঁড়ায় ৩০.১ শতাংশে।
অর্থাৎ পাঁচ বছরে এই রোগে আক্রান্তের হার বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। অপুষ্টিজনিত এবং অনির্দেশিত রোগে ২০১৭ সালে আক্রান্তের হার ৯.৭০ থাকলেও ২০২২ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ২৫.৮ শতাংশে।
এ ছাড়া বিগত পাঁচ বছরে ১৪টি রোগে আক্রান্তের হার বছরওয়ারী কমবেশি থাকলেও ২০২২ সালে দু-একটি ছাড়া বাকি সবগুলোতেই আক্রান্তের হার উর্দ্ধমুখি দেখা গেছে।
লিঙ্গ বিবেচনায় আক্রান্তদের মধ্যে ৫৫.৮২ শতাংশ হার নিয়ে শীর্ষে রয়েছে নারীরা। মোট আক্রান্ত ২৮ লাখের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১৬ লাখ। ৪৪.১৬ শতাংশ হার নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পুরুষ।
আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। ৩৩.১৩ শতাংশ হার নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ৫ বছর বয়সি শিশুরা। তবে তৃতীয় স্থানে থাকলেও মোট সংখ্যার মধ্যে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ শিশুর আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি চরম বিপৎসংকেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে দেশের ৮ বিভাগের মধ্যে রাজশাহীতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। ১৮.২৭ শতাংশ আক্রান্তের এই বিভাগ শীর্ষ স্থানে রয়েছে। দ্বিতীয় আক্রান্তের সংখ্যা চট্টগ্রামে ৫ লাখ। আক্রান্তের হার ১৭.৬ শতাংশ।
এরপর পর্যায়ক্রমে স্থান অনুযায়ি রয়েছে ঢাকায় সাড়ে ৪ লাখ। আক্রান্তের হার ১৬.১৪। খুলনায় আক্রান্ত সাড়ে ৪ লাখ। আক্রান্তের হার ১৪.৭১। রংপুরে আক্রান্ত ৩ লাখ ১২ হাজার।
আক্রান্তের হার ১০.৯২। সিলেটে আক্রান্ত ২ লাখ ২১ হাজার। আক্রান্তের হার ৭.৭৩। বরিশালে আক্রান্ত ২ লাখ। আক্রান্তের হার ৭.৪৩ এবং ময়মনসিংহে আক্রান্ত ২ লাখ ও আক্রান্তের হার ৬.৩৬ শতাংশ।
এ বিষয়ে প্রধান গবেষক সিসিএইচপিইউ’র সমন্বয়কারী ও বিশিষ্ট রোগতত্ত্ববিদ প্রফেসর ডা. ইকবাল কবীর বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের জনস্বাস্থ্যে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে,
কোন ধরনের রোগে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে তা নির্ণয়ের পাশাপাশি এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত গ্রহণ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানভিত্তিক আরও কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেটাই মূল লক্ষ্য ছিল।
বৈশ্বিক করোনাকালে ২০২০ সালে অন্য কোনো রোগের তথ্য সংরক্ষিত না থাকায় গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লিখিত বছরে আক্রান্তের হার শূন্য দেখালেও এ সময়ও মানুষ আক্রান্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন এই রোগতত্ত্ববিদ।
অন্যদিকে দেশের উপজেলা হাসপাতালগুলোতে শিশুদের অপুষ্টি মাপার (নির্ণয়ের) ভালো ব্যবস্থা থাকায় প্রতিবেদনে অপুষ্টিজনিত রোগের তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন প্রফেসর ডা. ইকবাল কবীর। কলেরার ক্ষেত্রে আক্রান্তের হার পাঁচ বছরে কমেছে বলে প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, বিজ্ঞানের দিক থেকে সাধারণত রোগতাত্ত্বিক বিষয়ে একটি সূচক দিয়ে কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করা যায় না।
তবে ব্যাপক সংখ্যায় নারী ও শিশু আক্রান্তের হার জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে চরম উদ্বেগজনক বলে তিনি মন্তব্য করেন। স্বাস্থ্যসেবায় এই প্রতিবেদন কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে- প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রতিবেদনটি জার্নালে প্রকাশের পাশাপাশি সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগেও পাঠানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগ গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লিখিত বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা নিতে পারে। এতে দেশের জনস্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এই রোগতত্ত্ববিদ।
আপনার মতামত লিখুন :