রবিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৫

বৃহত্তর ঐক্য নিয়ে আসছে বাম জোট

এফ এ শাহেদ

প্রকাশিত: এপ্রিল ১২, ২০২৫, ০২:১৮ এএম

বৃহত্তর ঐক্য নিয়ে  আসছে বাম জোট

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বাম, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, উদারনৈতিক ও স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে শক্তিশালী নতুন জোট গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বাম দলগুলো নিয়ে বৃহত্তর জোট গঠনের প্রক্রিয়া জোরালোভাবে এগিয়ে চলেছে। 

নিজেদের মধ্যে একাধিক বৈঠক হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে সময় নিচ্ছেন দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। সামনের সব আন্দোলন ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে লড়বেন বাম নেতারা। 

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), জাতীয় সমাজান্ত্রিক দলসহ (জাসদ) আরও কিছু বাম দল থেকে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 

বাম দল ছাড়াও বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন, পেশাজীবীদের জোটে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া রয়েছে। জোট প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।

তিনটি দলের দায়িত্বশীল বেশ কয়েকজন নেতা জানান, বৃহত্তর জোটের এই প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলো অগ্রসর হয়েছে। নিজেদের মধ্যে আলোচনার পাশাপাশি অন্য দল ও সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও শুরু হয়েছে। 

দীর্ঘদিনের শাসক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিদলীয় মেরুকরণের বাইরে একটি গণতান্ত্রিক জোট গড়ে তুলতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে নেতারা জানান।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বাম গণতান্ত্রিক জোট দীর্ঘ সময় ধরেই একাধিক দলের সঙ্গে যুগপৎ ধারায় যৌক্তিক আন্দোলনে যুক্ত। 

বাংলাদেশ জাসদ, ঐক্য ন্যাপ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম জোটের সঙ্গে আমরা বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করছি কিছু করার জন্য। জোট গঠন হলে আমরা একসঙ্গে আন্দোলন ও নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাব। 

নানামুখী আলাপ-আলোচনা থাকবে, রাজনীতির বাইরে যেমন দলিত ও আদিবাসী সংগঠন, পাহাড়ি সংগঠন, চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিও সঙ্গে থাকবে। এ ছাড়া বুদ্ধিজীবী ও পেশাভিত্তিক সংগঠনকে জোটের পাশে রাখার চেষ্টা চলছে। 

তিনি বলেন, ‘আমরা চাই চলতি বছরই নির্বাচন হোক। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন নিয়ে যতই কালক্ষেপণ করবে, দেশে ততই নানা জটিলতা বাড়বে। 

আমাদের বাম গণতান্ত্রিক জোট এবং অন্যান্য বাম গণতান্ত্রিক শক্তি সঙ্গে নিয়েই নির্বাচন করব। বৃহত্তর জোট গঠনের মধ্য দিয়ে আমরা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছি।’

বাম দলগুলো নিয়ে বৃহত্তর শক্তিশালী জোট করার প্রক্রিয়া জোর গতিতে এগিয়ে চলেছে। এই জোটে সিপিবি-বাসদের নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোটের দলগুলো থাকছে। থাকবে বাংলাদেশ জাসদও। আলোচনা চলছে গণফোরামের সঙ্গেও। 

এই জোটে আরও আসতে পারে ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম জোটের দলগুলোও। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, ঐক্য ন্যাপ, পাহাড়ি সংগঠন, দলিত ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের যেসব সংগঠন এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নেতৃস্থানীয় যারা আছেন, তাদেরও এই জোটে টানার প্রক্রিয়া আছে। 

এরই মধ্যে কোনো কোনো দল ও জোটের সঙ্গে একাধিকবার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শিগগির আনুষ্ঠানিকভাবে ধারাবাহিক আলোচনা শুরু হবে বলে নেতারা জানান। 

বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত থাকা নাগরিক ঐক্য ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে বৃহত্তর জোট গঠন নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন বাম নেতারা।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হলে এবং বিদ্যমান পদ্ধতিতে ভোট হলে বাম জোটের ব্যানারে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা থাকবে। দলীয় নেতাদের পাশাপাশি প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। এরই মধ্যে ভোটের জন্য নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। 

নেতারা বলছেন, এই জোট গঠন হলে সেটি নির্বাচনি জোটে রূপ নেবে। এর আগে কর্মসূচিভিত্তিক জোট হবে। বিভিন্ন ইস্যুতে কর্মসূচি দিয়ে দলগুলো জোটবদ্ধভাবে মাঠে নামবে। এরপর আগামী নির্বাচনে জোটবদ্ধভাবে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়া হবে। 

বাসদের নতুন এই জোট গঠনের উদ্দেশ্য ও জোট সম্পর্কে নেতারা বলছেন, গণআন্দোলনের যে চেতনা ও আকাক্সক্ষা ছিল বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা; পুঁজিবাদী, বুর্জোয়া, সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দলগুলো দিয়ে এই লক্ষ্যপূরণ সম্ভব নয়। 

সেখানে জনগণের সামনে একটি বিকল্প রাজনৈতিক জোট দরকার। যে জোট এই চেতনাগুলো ধারণ করবে। এই জোট আগামী নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নেবে।

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘আমরা চাই আগমী নির্বাচন ঘিরে বিকল্প শক্তি হিসেবে শক্ত অবস্থান জানান দিতে। বাম, গণতান্ত্রিক দলগুলোর বৃহৎ একটি বলয় আমরা গড়ে তুলতে চাই। 

শাসক শ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতে বিকল্প একটি রাজনৈতিক জোট প্রয়োজন। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে বেশ কিছু বৈঠক হয়েছে। পুঁজিবাদ, সুবিধাবাদ টিকিয়ে রেখে গণআন্দোলনের চেতনা বাস্তবায়ন হবে না।

 এজন্যই আমরা বাম, গণতান্ত্রিক এবং যারা পুঁজিবাদ-সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে, তাদের নিয়ে একটি জোট করতে চাই। 

বাম গণতান্ত্রিক জোটের বাইরে সমমনা দলগুলো নিয়ে বৃহত্তর জোট গঠনের আলাপ-আলোচনা চলছে। বাংলাদেশ জাসদ, গণফোরামসহ অন্যান্য দল নিয়ে জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। 

বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামি দলগুলো ছাড়াও নতুন দল এনসিপি আছে, তাদের বাইরে একটি বৃহত্তর জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। এসব দলের বাইরে একটি বিকল্পধারা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। 

জোটের নাম এখনো ঠিক হয়নি। আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে ‘বাম গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্ট’- এমন নাম আলোচনায় রয়েছে। দলের রূপরেখা ও নাম চূড়ান্ত হলে ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে সমাবেশ করে তা ঘোষণা দেওয়া হবে।

সূত্র বলছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সব রাজনৈতিক দল জোট গঠনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ডানপন্থি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী জোট গঠনের উদ্দেশ্যে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। 

এই দৌড়ে পিছিয়ে নেই বামপন্থি দলগুলোও। ডানপন্থি দলগুলোর বাইরে বাম দলগুলো নিয়ে বৃহত্তর জোট গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বৃহত্তর বাম দলগুলোর জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে খুব শিগগির বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের জন্মের পর গত ৫৩ বছর ধরে দেশ শাসন করেছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মতো বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল, যারা মূলত ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। 

যে কারণে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। এজন্য বুর্জোয়াদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই জোরদার করতে বাম-প্রগতিশীলদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম জরুরি। সেই তাগিদ থেকেই বৃহত্তর জোট গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। 

বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, আগমী নির্বাচন সামনে রেখে বৃহৎ একটি জোট গঠনের উদ্যোগ রয়েছে। আমরা আলোচনা শুরু করেছি। সিপিবি, বাসদ, গণফোরামের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। 

বাম, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, উদারনৈতিক দল নিয়ে এ ধরনের একটি জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। জোটের রূপরেখা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে আশা করি, শিগগির আমরা জোট সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারব।

এদিকে শুধু বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো নয়, তাদের সঙ্গে প্রগতিশীল ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো মিলিয়েই একটা বৃহত্তর জোট গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 

জোট গঠনের জন্য কয়েকটি নাম নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে তাদের নাম এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই জোট প্রধানত নির্বাচনকেন্দ্রিক হবে। পাশাপাশি ইস্যুভিত্তিক যুগপৎ আন্দোলনও করবে। ত্রয়োদশ নির্বাচনে জোট থেকে ৩০০ আসনেই মনোনয়ন দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। 

বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্তর্ভুক্ত ছয়টি রাজনৈতিক দল ও ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চার অন্তর্ভুক্ত সাতটি রাজনৈতিক দল এই জোট গঠনে কাজ করছে। 

গণতন্ত্র মঞ্চ জোটের একাধিক শরিকও জোটে থাকতে পারে। গণফোরাম, ঐক্য ন্যাপ, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির মতো দলগুলো আসতে পারে। 

এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, পাহাড়ি সংগঠন, দলিত ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের যেসব সংগঠন এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নেতৃস্থানীয় যারা আছেন, তাদেরও এই জোটে টানার প্রক্রিয়া আছে। এরই মধ্যে কোনো কোনো দল ও জোটের সঙ্গে একাধিকবার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।  

বাম গণতান্ত্রিক জোট হচ্ছে বামপন্থি রাজনৈতিক আদর্শের ছয়টি রাজনৈতিক দলের জোট। ছয়টি দলের ভেতরে দুটি দল সিপিবি ও বাসদ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত। বাকি চারটি দলের নিবন্ধন নেই। সেগুলো হলো- গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)।

অন্যদিকে ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চার সাতটি বামপন্থি রাজনৈতিক সংগঠন হলো- বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন, নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চা, গণমুক্তি ইউনিয়ন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), কমিউনিস্ট ইউনিয়ন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চ।

সূত্রমতে, নির্বাচনি পরিবেশ সৃষ্টি হলে এবং বিদ্যমান পদ্ধতিতে ভোট হলে জোটের ব্যানারে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা থাকবে। নির্বাচনে দলীয় নেতাদের পাশাপাশি বাম ও প্রগতিশীল এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া হবে।  

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের লক্ষ্যে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নাগরিক ঐক্য এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গেও ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে কয়েক দফা  বৈঠক করেছেন বাম নেতারা। পাশাপাশি গণফোরামের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। 

বাম নেতারা মনে করেন, আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি শরিকদের খুব বেশি আসন ছাড় না-ও দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্র মঞ্চের দলগুলো তেমন সুবিধা পাবে না বলে আলাদা অবস্থান নিতে চাইবে। তাই প্রগতিশীল ধারাতেই যুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে তাদের।

 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!