ঢাকা রবিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৫

সিলভা ফার্মায় অর্থের নয়ছয়

শাহীনুর ইসলাম শানু
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২৫, ১২:২৩ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। ২০১৮ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে ৩০ কোটি টাকা উত্তোলন করে কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ। 

তবে ৭ বছরেও তা ব্যবহার করতে পারেনি। অন্যদিকে, আর্থিক হিসাবে গরমিল, ব্যাবসায়িক কার্যক্রম ও আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় ১৯ মার্চ আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

তবে ‘১৫টি শর্ত নির্ধারণ করা’ তদন্ত কমিটি গঠনের চিঠি এখনো হাতে পায়নি বলে জানিয়েছে সিলভা ফার্মা কর্তৃপক্ষ। এতে সংবেদনশীল খাতে কোম্পানির ইমেজ নষ্ট এবং নেতিবাচক তথ্যে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে দাবি করেন তারা।

কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ‘একটি তদন্ত শেষে শাস্তি ঘোষণার আগেই’ আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন মাস আগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। 

সেই প্রতিবেদন অনুসারে শাস্তি ঘোষণার আগেই আবারও তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এবার কোম্পানির ৫ বছরের সম্পদ, আর্থিক সক্ষমতা ও ব্যাবসায়িক কার্যক্রম তদন্ত করে দেখবে বিএসইসি। তার আগে (প্রথম) আইপিও অর্থের নয়ছয়সহ আরো কয়েকটি বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে অনুসন্ধান কমিটি।

২০১৮ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে ৩০ কোটি টাকা উত্তোলন করে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি এখন ‘বি’ ক্যাটাগরিতে। কোম্পানির মোট পরিশোধিত মূলধন ১৩৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা, শেয়ার ১৩ কোটি ৬৫ লাখ। ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কোম্পানির স্বল্পমেয়াদি ঋণ রয়েছে ৪ কোটি ৭৭ লাখ ১০ হাজার টাকা।

অন্যদিকে, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিটির অর্থ নয়ছয়ের কারণে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। প্রতিষ্ঠানটির বিগত পাঁচ বছরের ব্যাবসায়িক কার্যক্রম এবং আর্থিক সক্ষমতা খতিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। 

এ লক্ষ্যে ১৫টি শর্ত নির্ধারণ করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ৬০ দিনের মধ্যে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছে কমিশন। কমিটির সদস্যরা হলেন-বিএসইসির উপপরিচালক মো. মাওদুদ মোমেন, সহকারী পরিচালক তন্ময় কুমার ঘোষ এবং মো. মারুফ হাসান।

বিএসইসি জানায়, ২০২০ সালের ৩০ জুন থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন (৫ বছর) পর্যন্ত আর্থিক প্রতিবেদন, সম্পদ, দায়, নগদ প্রবাহ, কাঁচামাল সংগ্রহ ও ব্যবহার, ব্যাংক লেনদেনসহ একাধিক বিষয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান চালানো হবে। 

বিশেষ করে আইপিও অর্থ ব্যয়ে অনিয়ম, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা এবং হিসাবপত্রে অসংগতির বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে। একই সঙ্গে আইপিওর আগে মূলধন সংগ্রহ ও ব্যবহার, প্রাক-আইপিও সম্পদের মালিকানা, প্রকৃত দখল এবং প্রসপেক্টাসে প্রকাশিত তথ্যের সত্যতাও যাচাইয়ের আওতায় পড়বে।

তবে তদন্ত কমিটি গঠন নিয়ে সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কোম্পানি সেক্রেটারি ইকবাল হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা এখনো কোনো চিঠি পাইনি। 

কোন বিষয়ে কমিশন তদন্ত কমিটি করেছে, তা-ও জানি না। তবে দু-তিন মাস আগে একবার ডিএসই তদন্ত করেছে।’ নতুন কমিটি নিয়ে তিনি অজ্ঞাত বলে জানান তিনি।

দ্বিতীয় দফায় তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘পূর্বে একবার তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমাও হয়েছে। সেই তদন্তের এখন শাস্তি ঘোষণা বাকি। নতুন করে ১৯ মার্চ তিন সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি করা হয়ছে। তাদের চিঠিও পাঠানো হয়েছে।’

বিএসইসি জানায়, ১৯ মার্চ গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি ৫ বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করবে। সম্পদের ভারসাম্য যাচাই এবং তথ্য অনুযায়ী তা নিশ্চিত করা (ভূমি ও জমির উন্নয়ন, ভবন, ভবন সজ্জা, উদ্ভিদ ও যন্ত্রপাতি, সমস্ত সরঞ্জাম, মূলধনের কাজ চলছে, বাণিজ্য এবং অন্যান্য প্রাপ্য, তালিকা, সমস্ত ব্যাংক ব্যালেন্স, নগদ এবং নগদ সমতুল্য ইত্যাদি)।

মূলধন ও দায়ের ভারসম্য যাচাই এবং তথ্য অনুযায়ী তা নিশ্চিত করা (ভূমি ও জমির উন্নয়ন, ভবন, ভবন সজ্জা, উদ্ভিদ ও যন্ত্রপাতি, সমস্ত সরঞ্জাম, মূলধনের কাজ চলছে, বাণিজ্য এবং অন্যান্য প্রাপ্য, তালিকা, সমস্ত ব্যাংক ব্যালেন্স, নগদ এবং নগদ সমতুল্য ইত্যাদি)। 

আইপিওর আগে মূলধন সংগ্রহ এবং প্রাক-আইপিও পরিশোধিত মূলধনের ব্যবহার নিরীক্ষা করা। কোম্পানির আইপিও প্রসপেক্টাসে প্রকাশ করা (প্রাক-আইপিও সম্পদের মালিকানা জমি, বিল্ডিং, গাছপালা এবং যন্ত্রপাতি ইত্যাদি) এবং প্রকৃত দখলে আছে কি না সে তথ্য তথ্য নিরীক্ষা করা এবং আর্থিক প্রতিবেদনে নগদ অর্থের প্রবাহ যাচাই করা হবে।

একই সঙ্গে ব্যাংক ব্যালেন্স, পণ্যের মূল্য, আয় এবং ব্যয় ইত্যাদির নিশ্চিতকরণ, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক স্টেটমেন্টসহ বিক্রয় থেকে আয় যাচাই, কাঁচামাল সংগ্রহ প্রক্রিয়া এবং কাঁচামালের ব্যবহার যাচাই, সরবরাহকারীদের সঙ্গে সরাসরি চুক্তির মাধ্যমে প্রদেয় কাঁচামালের কোনো মিথ্যা বা অতিরিক্ত ক্রয় এবং সরবরাহকারী বা সংশ্লিষ্ট ক্লায়েন্টকে অতিরিক্ত বা মিথ্যা পেমেন্ট আছে কি না তা পর্যালোচনা করা এবং সব এলসি পরীক্ষা করা হবে। বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল মজুদ থাকা সত্ত্বেও কাঁচামাল ক্রয়ের ন্যায্যতা যাচাই করবে বিএসইসি।

২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সমাপ্ত বছরের জন্য কর্মীদের নিয়োগপত্র এবং উপস্থিতি পত্র বিবেচনা করে সব বেতন/মজুরি/ভাতার বিপরীতে অর্থ প্রদান যাচাই করা। 

অ্যাকাউন্টিং নীতি, আর্থিক প্রতিবেদন এবং প্রকাশিত তথ্য ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএএস), ইন্টারন্যাশনাল ফাইনান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএফআরএস) এবং ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অন অডিটিং (আইএসএ) অনুসারে করা হয়েছে কিনা তা যাচাই ও নিশ্চিত করা, আইপিও সম্পর্কিত পক্ষের লেনদেন এবং তার প্রকাশিত তথ্য যাচাই, ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সমাপ্ত বছরের জন্য স্ট্যাটুটরি অডিটরদের ভূমিকা পর্যালোচনা ও তদন্ত করা হবে।

আইপিওর অর্থ ব্যবহারে অক্ষমতা: তালিকাভুক্তির পর থেকে বিগত ৭ বছরেও আইপিওর মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ ব্যয় করতে পারেনি। এরই মধ্যে আইপিওর অর্থ ব্যবহারে কোম্পানিটি ৫ দফা সময় বাড়িয়েছে। 

এবার কোম্পানির বিরুদ্ধে আইপিওর অর্থ ব্যয়ে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইপিওর অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত প্রতিবেদন নিরীক্ষা করেছে পিনাকী অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস।

আর্থিক চিত্র: ২০২৪ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত হিসাববছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালসের পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য নামমাত্র ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।

সর্বশেষ ৩০ জুন, ২০২৪ হিসাব বছরে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান (ইপিএস) হয়েছে (০.৪৭) টাকা। আগের হিসাব বছরে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল (০.২৪) টাকা। ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ১৬.৫৩ টাকা।

সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০২৪) কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান (ইপিএস) হয়েছে (০.১৯) টাকা। গত হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল (০.০৬) টাকা। 

অন্যদিকে, অর্ধবার্ষিক বা ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর, ২০২৪) কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান (ইপিএস) হয়েছে (০.৪৩) টাকা। গত হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল (০.১২) টাকা। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ার প্রতি সম্পদ (এনএভি) হয়েছে ১৬.০২ টাকা।