রবিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৫

বর্ষবরণ ঘিরে নৈরাজ্যের পাঁয়তারা

শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২৫, ১২:৫০ এএম

বর্ষবরণ ঘিরে নৈরাজ্যের পাঁয়তারা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

পহেলা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা ঘিরে অরাজকতার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশের পট পরিবর্তনে রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হওয়া টানাপোড়েনের মাঝে নতুন করে আলোচনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গোপন গতিবিধি। 

আশঙ্কা করা হচ্ছে, বর্ষবরণ ঘিরে রাজধানীতে অস্থিরতা তৈরি কিংবা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরানোর দাবিতে আন্দোলন বা অরাজকতায় যেতে পারে দলটির নেতাকর্মীরা। গত এক সপ্তাহ ধরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঢাকামুখি হচ্ছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। 

তাদের এই সম্ভাব্য ‘শক্তি প্রদর্শন’ ঘিরে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একাধিক রিপোর্টে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ বিষয়ে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। 

এ ছাড়া গতকাল ভোরে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে ফ্যাসিবাদী মুখাকৃতি পুড়ে ছাই ও শান্তির পায়রা মোটিফ আংশিক পুড়ে যাওয়ায় নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে ঢাকাসহ সারা দেশে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। 

আনন্দমুখর পরিবেশে বৈশাখ উদযাপনের জন্য কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যেকোনো ধরনের নাশকতা মোকাবেলায় কয়েকস্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। দি নটি নির্বিঘ্নে উদযাপন করতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। 

সার্বক্ষণিক নজরদারিতে থাকবে র‌্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম। প্রস্তুত থাকবে র‌্যাবের কমান্ডো টিম ও হেলিকপ্টার। এদিকে বর্ষবরণে র‌্যাবের নিরাপত্তাব্যবস্থা তুলে ধরে রমনা বটমূলে ব্রিফিং করবেন বাহিনীটির  মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি এ কে এম শহিদুর রহমান।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঢাকার রমনা বটমূলসহ বর্ষবরণকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানের প্রতিটি স্থানে স্যুইপিং করা, আর্চওয়ে, মেটাল ডিটেকটর দিয়ে তল্লাশি করাসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।

 যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় সারা দেশ নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা সদস্য ছাড়াও আনসার সদস্যরা এ সময় মাঠে তৎপর থাকবে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ স্পটগুলোতে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে।

রাজধানীতে বাংলা নববর্ষের এবারের শোভাযাত্রার নাম হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। এত দিন এই শোভাযাত্রা হতো ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে। এবারের শোভাযাত্রার স্লোগান হবেÑ ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। 

এ প্রতিপাদ্যের আলোকে শোভাযাত্রায় তুলে ধরা হবে বাংলার চিরায়ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও লোকজ সংস্কৃতির রূপ। পাশাপাশি গত বছরের জুলাই-অগাস্টে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষাপটে যে ‘ফ্যাসিবাদ’ বিদায় নিয়েছে, তা যেন আর কখনো ফিরে না আসে-এ বার্তাও ছড়িয়ে দেওয়া হবে শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে।

 এবারের প্রতিপাদ্য সামনে রেখে আনন্দ শোভাযাত্রার প্রধান মোটিফ ছিল ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’। কিন্তু গতকাল দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে যায় ফ্যাসিবাদী মুখাকৃতি। অভিযোগ উঠেছে, ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার মোটিফ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। 

এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি উঠেছে। এ ঘটনায় দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, হাসিনার দোসররা চারুকলায় ফ্যাসিবাদের মুখাবয়ব পুড়িয়ে দিয়েছে। এই দুঃসাহস যারা দেখিয়েছে- সফট আওয়ামী লীগ হোক বা আওয়ামী বি টিম হোক- তাদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আসতে হবে, দ্রুত।
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী সংগঠিতভাবে ঢাকামুখী হচ্ছেন। ধারণা করা হচ্ছে, তারা রাজধানীতে অস্থিরতা তৈরি কিংবা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরানোর দাবিতে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। 

এই সম্ভাব্য ‘শক্তি প্রদর্শন’ ঘিরে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একাধিক রিপোর্টে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ বিষয়ে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগপন্থি কিছু ব্যক্তির সরাসরি সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার অভিযোগও সামনে এসেছে। 

পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, সরকার পতনের পর চট্টগ্রামে দলীয় আধিপত্য ও প্রতিশোধপরায়ণ রাজনীতির কারণে হামলা, দখল ও চাঁদাবাজির ঘটনা বেড়েছে। চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিএসবি) থেকে জেলার সব থানায় পাঠানো হয়েছে একটি বিশেষ চিঠি। 

সেখানে বলা হয়েছে, ঢাকায় সম্ভাব্য আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম থেকে দলীয় কর্মীরা সংগঠিত হচ্ছে। ফলে ঢাকামুখী যাত্রা প্রতিহত করতে এবং কোনো ধরনের সহিংসতা ঠেকাতে থানাগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকতে বলা হয়েছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) মাহমুদা বেগম সাংবাদিকদের জানান, নগরীর বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে পুট ও নাইট পেট্রোল, নতুন চেকপোস্ট স্থাপন এবং মিনি টিম গঠন করে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিরিক্ত ফোর্সও মোতায়েন করা হয়েছে।

র‌্যাব জানায়, নববর্ষে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র‌্যাব ঢাকাসহ সারা দেশব্যাপী গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। আজ থেকে নববর্ষের অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে নিজ নিজ দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক র‌্যাব সদস্য মোতায়েন থাকবে। 

এছাড়া রাজধানীর রমনা বটমূল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র সরোবর, শিল্পকলা একাডেমি, বিআইসিসি ভবন, নজরুল একাডেমি, উত্তরা মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। এসব এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র‌্যাবের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। 

এছাড়া টিএসসি, শাহবাগ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং রমনা বটমূলকে আউটার অ্যান্ড ইনার পেরিমিটারে বিভক্ত করা হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত চেকপোস্ট, টহল ও অবজারভেশন পোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি রমনা বটমূল, টিএসসি ও চারুকলা ইনস্টিটিউটসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে র‌্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াড দ্বারা সুইপিং শেষ করা হবে।

সারা দেশব্যাপী নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠান চলাকালীন সার্বিক নিরাপত্তার জন্য থাকবে র‌্যাবের কন্ট্রোলরুম, স্ট্রাইকিং রিজার্ভ, আউটার পেরিমিটার, পেট্রোল, মোটরসাইকেল পেট্রোল, ফুট পেট্রোল, বোট পেট্রোলিং, সি সেক্টর, ভেহিকল স্ক্যানার, অবজার্ভেশন পোস্ট, চেকপোস্ট এবং সিসিটিভি মনিটরিং। 

এ ছাড়া র‌্যাব এয়ার উইংয়ের হেলিকপ্টারও সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকবে। ব্যাটালিয়নগুলো নিজ নিজ কন্ট্রোলরুমের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করবে। র‌্যাব সদর দপ্তরে কন্ট্রোলরুমের মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশে নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ ও সমন্বয় করা হবে।

ডিএমপি জানায়, রাজধানীতে পহেলা বৈশাখ উৎসবমুখর ও নিরাপদে উদযাপনে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কয়েক স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকবে। 

রমনা বটমূলসহ আশপাশের এলাকায় এসবি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) সদস্যরা ইক্যুইপমেন্ট ও ডিএমপির ডগ স্কোয়াড দিয়ে সুইপিং করবেন। পুরো এলাকা সিসিটিভি, ড্রোন পেট্রোলিং ও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে মনিটরিং করা হবে। পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা প্রবেশপথে মেটাল ডিটেক্টর, আর্চওয়ের মাধ্যমে তল্লাশি করবেন।

ডিবি-এসবিসহ অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সাদা পোশাকে অবস্থান করবেন। এ ছাড়া যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সোয়াত টিম, ডগ স্কোয়াড ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট স্ট্যান্ডবাই থাকবে। 

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, বর্ষবরণ নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে উদযাপনের জন্য ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। 

প্রতিবছরের ন্যায় এবারও পহেলা বৈশাখে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা ধরনের অনুষ্ঠান উদযাপন করা হবে। পহেলা বৈশাখ আনন্দঘন উৎসবমুখর পরিবেশে ও নিরাপদে উদযাপনের লক্ষ্যে ডিএমপি তৎপর থাকবে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, পহেলা বৈশাখের উৎসবকে ঘিরে দেশে কোনো ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। নববর্ষ উপলক্ষে রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে। 

দিনটিতে যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবে। রমজান মাসের মতোই উৎসবকালীন নিরাপত্তাব্যবস্থা কঠোর ও কার্যকর থাকবে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রমনা বটমূল, হাতিরঝিল, রবীন্দ্র সরোবরসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উৎসবকে কেন্দ্র করে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হবে। বাড়তি নজরদারিতে থাকবে জনসমাগমপূর্ণ এলাকা ও সাংস্কৃতিক মঞ্চগুলো।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!