প্রথম ইউনিটের তিনটি সঞ্চালন লাইনের মধ্যে দুটির কাজ আরও ছয় মাস আগেই শেষ হয়েছে। কিন্তু পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে নির্মিত হতে যাওয়া তৃতীয় লাইনটির কাজ শেষ হয়নি এখনো।
তাই উদ্বোধনের সব প্রস্তুতি শেষ করেও উৎপাদনে আসতে পারছে না দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
কেন্দ্রটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার রোসাটমের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে জানানো হয়েছে শিগগিরই পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে চায় তারা। সরকারের বিভিন্ন পক্ষ থেকেও বলা হয়েছিল গত মার্চেই উদ্বোধন হবে কেন্দ্রটির।
কিন্তু মার্চ পেরিয়ে এপ্রিলের মাঝামাঝি হতে চললেও এখনো সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হওয়ায় কবে নাগাদ কেন্দ্রটি উৎপাদনে যেতে পারবে বলতে পারছে না দায়িত্বশীলদের কেউ।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাশিয়ার স্টেট করপোরেশন ফর নিউক্লিয়ার এনার্জি রোসাটমের মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচোভ জানান, প্রকল্পের ড্রাই রান চলছে। শিগগিরই পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হবে।
তিনি আশ্বাস দেন, রোসাটম নিরাপত্তা, গুণগত মান এবং আন্তর্জাতিক মান মেনে চলার দিকে মনোনিবেশ করে প্রকল্পটির সমাপ্তিতে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ সময় প্রধান উপদেষ্টাও যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া রোসাটমকে ধন্যবাদ জানান।
অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টাও বিভিন্ন সময় গত মার্চেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদনে আসার কথা বলেছিলেন। কিন্তু হলে কি হবে, এখনো যে এর সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজই শেষ হয়নি।
রূপপুর প্রকল্পসংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, পরমাণু কর্মসূচি একটি জটিল প্রক্রিয়া। এ ধরনের প্রকল্প চালুর ক্ষেত্রে গ্রিড, টেলিকমিউনিকেশন, ভৌত নিরাপত্তাসহ নানা বিষয় রয়েছে।
তবে এ মুহূর্তে রূপপুরের প্রথম ইউনিট চালুর জন্য অন্তত তিনটি লাইন চূড়ান্ত করার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছেন রুশ প্রকৌশলীরা। বর্তমানে দুটি লাইন প্রস্তুত রয়েছে। আরেকটির কাজ চলমান। এটি শেষ না হলে গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব নয়।
জানা যায়, প্রথম ইউনিটের জন্য তিনটি সঞ্চালন লাইনের মধ্যে দুটির কাজ শেষ হয়েছে গত বছরের মাঝামাঝিতেই। বাকি একটি লাইনের (রূপপুর-গোপালগঞ্জ) কাজ শেষ হয়নি। এ ছাড়া কেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় চালু করার জন্য যমুনা ও পদ্মা রিভার ক্রসিংয়ের কাজও চলমান।
এগুলোর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৩৭ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রূপপুরের কমিশনিং, ফিজিক্যাল স্টার্টআপ, ফুয়েল লোডিং ও আন্তর্জাতিক শর্ত পূরণসাপেক্ষে কেন্দ্রটি চালু হতে চলতি বছরের শেষ নাগাদ লেগে যেতে পারে।
পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ (পিজিসিবি) জানিয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন তৈরির কাজ সাতটি প্যাকেজের মাধ্যমে চলছে। এর মধ্যে রূপপুর থেকে বাঘাবাড়ী পর্যন্ত ৬৫ দশমিক ৩১ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজের অগ্রগতি শতভাগ।
আমিনবাজার থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৯০ শতাংশের বেশি। রূপপুর থেকে ঢাকা (আমিনবাজার-কালিয়াকৈর) ১৪৭ কিলোমিটার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ।
এ ছাড়া গোপালগঞ্জ পর্যন্ত ১৪৪ কিলোমিটারের অগ্রগতি ৭০ শতাংশের মতো, ধামরাই পর্যন্ত ১৪৫ কিলোমিটারের অগ্রগতি ৬০ শতাংশের কিছু বেশি, বগুড়া পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটারের অগ্রগতি ৬০ শতাংশের মতো এবং ৯টি বে এক্সটেনশন নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৩০ শতাংশের ওপরে।
সব মিলিয়ে স্থলভাগের প্রায় ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে জানিয়ে প্রকল্পের পরিচালক মো. মাসুদুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এখন ছোট ছোট কিছু কাজ বাকি রয়েছে।
এর মধ্যে তিনটি টাওয়ার নির্মাণ হচ্ছে। টাঙ্গাইল এবং ভেড়ামারার কাজ চলছে। বাকিটাও শেষ হয়ে যাবে। আর কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের শতভাগ কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করছি।
তবে জটিলতা তৈরি হয়েছে জলভাগ তথা নদী পারাপার নিয়ে। গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতীয় কোম্পানিগুলোর সব কর্মী বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়।
যার ফলে ভারতীয় ঠিকাদারদের দায়িত্বে থাকা সঞ্চালন প্রকল্পগুলো স্থবির হয়ে পড়ে বেশ কিছুদিন। ফলে কাজ পিছিয়ে যায়।
সঞ্চালন লাইন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসির (পিজিসিবি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ফিজিক্যাল স্টার্টআপের জন্য যতটুকু সঞ্চালন লাইনের প্রয়োজন, সেটা প্রস্তুত আছে। ইভাক্যুয়েশনের জন্য রূপপুর-গোপালগঞ্জ লাইনের ৪০০ কেভি পদ্মা রিভার ক্রসিং সঞ্চালন লাইনটি প্রয়োজন হবে। তবে এ কাজ থমকে রয়েছে মূলত আর্থিক সংকটের কারণে। বকেয়া পড়েছে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিল। সরকারের কাছে এরই মধ্যে বকেয়া পরিশোধের জন্য অর্থ চেয়েছে পিজিসিবি।
সঞ্চালন লাইনের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পিজিসিবি চেয়ারম্যান ড. এম রেজওয়ান খান সাংবাদিকদের বলেন, এটি মার্চের ভেতরে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু আমাদের আরও সময় লাগবে। তবে এ লাইনটার কারণে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র থেমে আছে বিষয়টি এমন নয়, কারণ বিদ্যমান যে সঞ্চালন লাইন রয়েছে তা দিয়ে কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্র রান করা যেতে পারে। রুশ কোম্পানির পক্ষ থেকে দেওয়া তিনটি সঞ্চালন লাইনের শর্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ কথাটি ঠিক নয়।
কারণ তাদের অরিজিনাল চুক্তির মধ্যে যে ধরনের শর্ত ছিল, তা দিয়ে কিন্তু সম্পন্ন করা যায়। তবে এ লাইনের কারণে তাদের (রূপপুর) বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়া না হওয়ার বিষয়টি আটকে থাকার কোনো কারণ নেই।
পিজিসিবি সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের গ্রিডলাইন প্রকল্প শুরুতে ভারতীয় ঋণে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ঋণ ছাড় দীর্ঘায়িত করায় বাংলাদেশ সরকার পরে গ্রিডলাইন নির্মাণ প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ থেকে বেরিয়ে আসে।
পাশাপাশি করোনা মহামারির কারণে প্রকল্পে কর্মকর্তাদের যোগ দেওয়ায় ধীরগতি নামে। এতে পিছিয়ে পড়ে সঞ্চালন লাইনের কাজ। বর্তমানে পিজিসিবি ও সরকারের অর্থায়নে গ্রিড লাইনের কাজ চলছে।
সঞ্চালন লাইনের কাজের বিপরীতে এখন প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পড়েছে। এর মধ্যে সঞ্চালন লাইনের ঠিকাদারের বিল বকেয়া ২৫ মিলিয়ন ডলার। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে পিজিসিবি বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে ২৫ মিলিয়ন ডলার ছাড়ের অনুরোধ জানিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্পটির এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, রূপপুর কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চালুর জন্য তিনটি সঞ্চালন লাইন প্রয়োজন। তবে যেহেতু একটি লাইন এখনো সম্পন্ন হয়নি, ফলে সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে আমরা রাশিয়ান ঠিকাদারকে অনুরোধ করেছি। ডিজাইন চেঞ্জ করে হলেও তিনটি লাইন চূড়ান্ত করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা যায়।
দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজের সঙ্গে এতদিন সঞ্চালন লাইনের কাজও তাল মিলিয়ে চলছিল।
কিন্তু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা কীভাবে কাটিয়ে উঠবে তা নিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা আশা করছিলাম গত বছরের ডিসেম্বরেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।
কিন্তু যেহেতু একটা গণঅভ্যুত্থান দেশে হয়ে গেছে। তাই কিছুটা স্থবিরতা থাকবে এটা স্বাভাবিক। তবে আমরা বিশ্বাস করি, অন্তর্বর্তী সরকার এই সংকট কাটিয়ে উঠবে এবং শিগগিরই সঞ্চালন লাইনের কাজও শেষ হবে।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ প্রকল্পে সিংহভাগ অর্থায়ন দিয়েছে রাশিয়া। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে রাশিয়ার অর্থায়ন রয়েছে ৯৩ হাজার কোটি টাকা।
এ প্রকল্পের ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিটের সক্ষমতা মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। চলতি বছরে প্রথম ইউনিট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ।
২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর রূপপুর প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের কংক্রিট ঢালাইয়ের মধ্য দিয়ে রূপপুর প্রকল্পের মূল পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। পরবর্তী বছর ২০১৮ সালের ১৪ জুলাই প্রকল্পের দ্বিতীয় ইউনিটের কংক্রিট ঢালাই উদ্বোধন করা হয়।
পূর্ব নির্ধারিত শিডিউল অনুযায়ী, ২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট এবং ২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল।
শিডিউল অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১৩ অক্টোবর প্রথম ইউনিট আর ২০২৫ সালের ১৭ অক্টোবর দ্বিতীয় ইউনিটের চূড়ান্ত হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।