ঢাকা বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫

আগামী বাজেট হবে সংকোচনমূলক

হাসান আরিফ
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৫, ২০২৫, ১১:৫১ পিএম
ছবি : রূপালী বাংলাদেশ

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার বিষয়টি মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। অপরদিকে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটেও রাজস্ব আয়ে উন্নতি ঘটবে, তেমন কোনো জাদু সরকারের হাতে নেই। ফলে ঝামেলা এড়াতে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার ছোট করতে যাচ্ছে সরকার।

অপরদিকে প্রতি অর্থবছরই রাজনৈতিক সরকারের সময় যেসব অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হয় তা পরিহার করবে আন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমিয়ে আনতে সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেট বাস্তবভিত্তিক করতে চায়। মূলত যে করেই হোক, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে যাবে। বিপরীতে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা ও পরিমাণ বাড়ানো হবে, যাতে মানুষের কষ্ট কম হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ে আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রাবিনিময় হার-সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সভাপতিত্ব করেছেন। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী কর্তকর্তারা অনলাইনে নিজ নিজ কক্ষে বসে অংশ নিয়েছেন।

কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল সূত্রে জানা গেছে, অর্থসংকটের কারণে আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে কম হওয়ার পরও বাজেট ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। সরকারের আয় কম, শুল্ক-কর আদায়ও খুব বেশি বাড়েনি। আবার বিদেশি সহায়তার ঋণ পরিশোধেও বিপুল অর্থ খরচ হচ্ছে। ফলে ঘাটতির অঙ্কটা তুলনামূলক বড়ই হতে যাচ্ছে।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে সরকার। যা দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঘটতে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।

এযাবত দেশে ৫৩টি বাজেট দেওয়া হয়েছে। যা প্রতিবারই বিগত বাজেটের তুলনায় বেড়েছে। এবার প্রথমবারের মতো ৫৪তম বাজেটে ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাত ধরে। বৈঠক সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের জন্য সরকার মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করতে পারে ৬.৫ শতাংশ। যা চলতি অর্থবছরও ছিল মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে।

আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫.৫ শতাংশ। যা চলতি অর্থবছর ছিল মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশ। মূলত আগামী বাজেটে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার সম্ভাবনা রয়েছে ৬৩ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর বাজেট ঘাটতি ধরা হতে পারে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। যা জিডিপির ৩.৬২ শতাংশ।

এই হিসাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে (এনবিআর) সরকারের আয়ের লক্ষ্য হতে পারে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার মতো। বাকি টাকা ব্যাংকিং ব্যবস্থা, সঞ্চয়পত্র ও বিদেশি উৎসসহ অন্যান্য ব্যবস্থা থেকে সংগ্রহ করতে হবে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এনবিআরের। 
জানা গেছে, এনবিআর চাচ্ছে ৫ লাখ টাকার লক্ষ্য নিতে।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই লক্ষ্যমাত্র ৫ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণের জন্য চাপ অব্যাহত রেখেছে। জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে আগের কোনো সরকারই টার্গেট বাস্তবায়ন করতে পারিনি। চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৪.৫-এর বেশি হবে না।

আবার আগামী অর্থবছরের বাজেটে যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.৫ ধরা হয়, তাহলে প্রবৃদ্ধি ১০০ বেসিস পয়েন্ট বাড়বে। বিপরীতে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলে ২০০ বেসিস পয়েন্ট কমাতে হবে। যা কোনোভাবেই বাস্তবায়নযোগ্য না। এদিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) জন্য সরকার আগামী অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে পারে। যা চলতি অর্থবছরে রয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে অবহেলিত গ্রামীণ অবকাঠামো খাতে জোর দেওয়া হবে আগামী বাজেটে। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় সুবিধাভোগীদের ভাতা কিছুটা বৃদ্ধি এবং শিক্ষকদের দাবিদাওয়া পূরণের চেষ্টা থাকবে আগামী বাজেটে। 

জুলাই আন্দোলনের চেতনা এবং শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের সুপারিশের প্রতিফলন আগামী বাজেটে থাকবে বলেও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাজেটের আকার না বাড়লেও সরকারের বেতন-ভাতা, সুদাসলসহ দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধ। এসবের খরচ কিছুটা বাড়বে।  বিপরীতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে খরচ কমানো হবে। আবার নানা খাতে ভর্তুকি কমানোও সরকারের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ থাকবে। চলতি বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।

এরই মধ্যে সেই লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) এনবিআর রাজস্ব আদায় করেছে প্রায় ১ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা।

এ সময়ে সংস্থাটির রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি ৫১ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় খুব বেশি বৃদ্ধি না পাওয়ায় বেকাদায় রয়েছে সরকার।

বাস্তবভিত্তিক বাজেট বলতে সরকার কী বুঝাতে চায়? এই বিষয়ে রূপালী বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এই অঙ্কটাও বাস্তবভিত্তিক না। মূলত একটা কাল্পনিক সংখ্যার সঙ্গে আরেকটা কাল্পনিক সংখ্যার তুলনা হতে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এদিকে ঘাটতি গত বছরের তুলনায় জিডিপি অনুপাতে কমলেও টাকার অঙ্কে চিত্রটা অন্যরকম হবে। ফলে বিদেশি উৎস থেকে যা পাওয়া যাবে তা-ও খুব একটা সুখকর না। ফলে ঘাটতি পূরণে ব্যাংকব্যবস্থার ওপরই বেশি নির্ভর করতে হবে।

এতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ অন্য সরকারের বাজেটের মতোই নেতিবাচক ধারায় ধাকবে। ফলে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ খুব একটা থাকবে না। আর বেসরকারি খাতে টাকার প্রবাহ কম হলে ডলারের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে, কমবে না।